
মঙ্গলবার বিকাল পাঁচটা। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রধান কার্যালয়ের সামনে মানুষের ভিড়। কি হচ্ছে এখানে? পাশেই আর ডি শপিংমল। এই মার্কেটে কেনাকাটা করতে এসেছেন উত্তর মতসুপুর গ্রামের রফিকুল। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ অফিস দখল করছে বিএনপি’র লোকজন। এ অফিসটি গত বছর ৫ই আগস্টের পর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। একবছর পর এটি দখলে নেয়া হচ্ছে। অথচ এ অফিসের জমি আওয়ামী লীগের নামে দলিল করা। নূর উদ্দিন হেলাল নামে এক ব্যবসায়ী দখলে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ইট, বালু দিয়ে নতুন করে প্লাস্টার করছেন। এলাকাবাসী বলছেন, বিএনপি’র লোকজন হেলালকে দিয়ে এটি দখলে নিয়ে নিলো।
কোম্পানীগঞ্জ দেশের দুই রাজনৈতিক তারকার এলাকা। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ আর ওবায়দুল কাদের। দুজনই একই আসনের এমপি ছিলেন। ছিলেন দাপুটে নেতা। দুজনই হয়েছেন মন্ত্রী। দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতা। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা এ দু’নেতার একজন মওদুদ আহমদ মারা গেছেন। আর গতবছর ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালালে আত্মগোপনে চলে যান ওবায়দুল কাদের। আর কোম্পানীগঞ্জের গডফাদারখ্যাত ওবায়দুল কাদেরের ভাই মির্জা কাদেরের নিজ এলাকা থেকে পালাতে সময় লেগেছিল সাতদিন। এলাকাবাসীর ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ থেকে বাঁচতে সাতদিন কাটিয়েছেন করুণ জীবন। এরপর এক রাতে অদৃশ্য হয়ে যান। এর সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানীগঞ্জে গড়ে তোলা মির্জা কাদেরের সাম্রাজ্য হয়ে পড়ে অরক্ষিত। কিন্তু এটি পূরণ করতে সময় লাগেনি। বিএনপি’র স্থানীয় নেতাকর্মীরা এ জায়গা দখল করেন।
চাঁদাবাজি, দখলবাজিসহ সব অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে যায় তাদের নাম। তবে এবার আর মির্জা কাদেরের মতো এককভাবে কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। ১১ জন এসব অপকর্মের সঙ্গে রয়েছেন। এলাকাবাসী নাম দিয়েছে ১১ খলিফা। বিএনপি নেতাকর্মীদের দখল, নৈরাজ্য, লুটপাটের খবর চলে যায় কেন্দ্রীয় বিএনপিতে। কেন্দ্র থেকে এসব অপকর্ম না করতে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু এমন নির্দেশনা তেমন কাজে আসেনি। উল্টো এতদিন আওয়ামী লীগের দখলে থাকা বাসস্ট্যান্ড, সিএনজিস্ট্যান্ড, বাস মালিক সমিতি, খাস জায়গা, বাজার, ঘাট, বালু উত্তোলনসহ অন্যান্য স্থাপনা একে একে চলে গেছে বিএনপি’র কব্জায়। এ ধরনের নানা অভিযোগ ওঠায় কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপি’র কমিটি ঘোষণা স্থগিত করে দেয়া হয়। এ ছাড়া কবিরহাট উপজেলায় একাধিক নেতার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ থাকায় সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়। আসলে নোয়াখালী-৫ আসনটি কবিরহাট এবং কোম্পানীগঞ্জ এই দুইটি উপজেলা নিয়ে গঠিত। স্থানীয়রা জানান, আওয়ামী লীগ শাসনামলের ১৬ বছর কোম্পানীগঞ্জের নিয়ন্ত্রণ ছিল ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আব্দুল কাদের মির্জা এবং তার অনুসারীদের হাতে। কাদের মির্জার চাঁদাবাজি ও অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিলেন এই উপজেলার সব দলের মানুষ। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এসব থেকে মুক্তি পাবেন এলাকাবাসী- এমন আশায় মানুষের মনে স্বস্তি ফিরে আসে। কিন্তু একদিন যেতে না যেতেই সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ নেন বিএনপি’র নেতাকর্মীরা।
এখনো সেই একই আতঙ্ক কোম্পানীগঞ্জে। স্থানীয়রা ১১ খলিফার মধ্যে কয়েকজনের নাম প্রকাশ করেন। এর মধ্যে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপি’র সাবেক আহ্বায়ক নুরুল আলম সিকদার, সাবেক সদস্য সচিব মাহমুদুর রহমান রিপন, উপজেলা বিএনপি’র সাবেক যুগ্ম-আহ্বায়ক আফতাব আহমেদ বাচ্চু, বসুরহাট পৌর বিএনপি’র আহ্বায়ক আব্দুল মতিন লিটন, সদস্য সচিব আবদুল্লাহ আল মামুন, উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক ফজলুল কবির ফয়সাল, সদস্য সচিব জাহেদুর রহমান রাজন, বসুরহাট পৌর যুবদলের আহ্বায়ক ওবায়দুল হক রাফেল, সদস্য সচিব মাজহারুল ইসলাম তৌহিদ।
স্থানীয় এক বিএনপি নেতা বলেন, ষোল বছরে অত্যাচার নির্যাতনেও আমাদের শিক্ষা হলো না। আওয়ামী লীগ যে পথে গেছে আমরাও সে পথে যাচ্ছি। সূত্র মতে, ২০২২ সালের মার্চ মাসে আব্দুল কাদের মির্জার নির্দেশে তার ঘনিষ্ঠ সহচর উপজেলার মুছাপুর ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য আলী আজগর জাহাঙ্গীর ও তার ছোট ভাই জালাল উপজেলার মুছাপুর ক্লোজারে ভুয়া ভূমিহীন সাজিয়ে ৬০০ একর সরকারি খাসজমি দখল করে। তারপর ওই এলাকা থেকে অবৈধ ভাবে প্রায় ৬ কোটি টাকার বালু উত্তোলন করে। এখন সেই খাস জায়গা-বালুর ব্যবসা নিজের কব্জায় রেখেছেন উপজেলা বিএনপি’র সাবেক আহ্বায়ক নুরুল আলম সিকদার। আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর-জালাল গত বছর ৫ই আগস্টের দিন সকালে আওয়ামী লীগের পক্ষে মিছিল করে। আর বিকালে বিএনপি’র পক্ষে আরেকটি মিছিল করে বিএনপি বনে যায়। এ ব্যাপারে নুরুল আলম সিকদার বলেন, কোরআন ছুঁয়ে বলতে পারি আমি কোনো অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত নই। আর জাহাঙ্গীর আর জালাল ওরা তো আওয়ামী লীগ আমলে আমার নিজের জমি দখল করে রেখেছে। সেটা এখনো উদ্ধার করতে পারছি না। তাকে প্রশ্ন করা হয়-এখন তো উদ্ধার করতে পারেন? নুরুল আলম সিকদার বলেন, এখন উদ্ধার করতে গেলে তো আপনারাই বলবেন তাদের জমি দখল করে রেখেছি। কমিটি ভেঙে দেয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ায় নোয়াখালীর ১৭টি কমিটি স্থগিত করে জেলা কমিটি। ইতিমধ্যে কয়েকটিতে নতুন কমিটি দেয়া হয়েছে।
বসুরহাট পৌরসভার একজন বিএনপি নেতা বলেন, ভাই লজ্জায় মুখ দেখাতে পারিনি। এ কারণে কি স্বৈরাচারকে হটানো হয়েছে? তিনি বলেন, বসুরহাট পৌরসভার তিনটি উন্নয়ন কাজের কোটি টাকার ইজিপি টেন্ডারের লটারি উপেক্ষা করে নিজের লোক দিয়ে কাজ করান উপজেলা বিএনপি’র সাবেক সদস্য সচিব মাহমুদুর রহমান রিপন। এ ছাড়া বর্তমানে বসুরহাট পৌরসভা যুবদলের সদস্য সচিব ও সাবেক কাউন্সিলর মাজহারুল ইসলাম তৌহিদের নেতৃত্বে বসুরহাট পৌরসভা দখলে রেখেছেন বিএনপি’র কতিপয় নেতা। এই সিন্ডিকেটের লোকজন সকাল থেকে পৌরসভার কর্মকর্তাদের অফিসে অবস্থান নেন। নানা অপকর্মে জড়িত রয়েছেন তারা। এমনটাই অভিযোগ করেন এলাকাবাসী। এ ছাড়া বসুরহাট বাজারে সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে কোটি টাকা চাঁদা আদায় করা হয় বিএনপি নেতাদের নামে।
গত আগস্ট মাসে চরএলাহী ঘাটের চাঁদাবাজির টাকা আদায়কে ঘিরে রক্তাক্ত জনপদে পরিণত হয় কোম্পানীগঞ্জের দক্ষিণাঞ্চল। এ ঘাট দিয়ে মাছ, শাকসবজি ছাড়াও মাদকের বড় চালান যায়। যার সঙ্গে এই ১১ খলিফার কয়েকজন জড়িত। সূত্র মতে, চর এলাহী ঘাটটি সরকারি বিধি মোতাবেক ইজারা নিয়েছিলেন চরএলাহী ইউনিয়নের যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক শেখ বেলাল। ৫ই আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পরে ঘাটটির নিয়ন্ত্রণ নেন বিএনপি’র একটি গ্রুপ। বিএনপি’র দুই পক্ষের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত আগস্ট মাসে হামলার শিকার হন একাধিক নেতা। এক বাস মালিক জানান, সরকার পতনের পর বসুরহাট বাসস্ট্যান্ডে চাঁদাবাজি শুরু করেন বিএনপি’র নাম ভাঙিয়ে কিছু লোক। শুরুতেই বাস মালিক সমিতির সভাপতির পদ দখল করে নেন উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক ফজলুর কবির ফয়সাল। এ ছাড়া পরিবহন সিন্ডিকেটের চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন বিএনপি’র পরিচিত ক’জন নেতা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক বাস মালিক বলেন, যে সরকারই আসুক বাসস্ট্যান্ডে সব সময় জিপির নামে চাঁদাবাজি করেন দলীয় নেতাকর্মীরা। পতিত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার লুটপাটের অন্যতম দোসর দেশের আর্থিক খাতের শীর্ষ লুটেরা এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন পদ্মা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান ছিলেন বর্তমান ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপি’র সাবেক সদস্য ফখরুল ইসলাম।
এস আলম গ্রুপের মালিক মোহাম্মদ সাইফুল আলম ওরফে মাসুদের দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন অন্যতম সহযোগী সাবেক জামায়াত নেতা বর্তমানে বিএনপি নেতা এই ফখরুল ইসলাম। ফখরুল প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান থাকাকালীন দেশ-বিদেশে এস আলম গ্রুপের নানা আর্থিক অনিয়মের সহযোগী ছিলেন। ২০২৪ সালের ২৭শে আগস্ট রাতে চরএলাহী ঘাট দখলকে কেন্দ্র করে একদল অস্ত্রধারী বিএনপি নেতা ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল মতিন তোতাকে কুপিয়ে হত্যা করে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কবিরহাট পৌরসভা বিএনপি’র এক কর্মী বলেন, গত ১৭ বছর নিজের টাকা খরচ করে বিএনপি করেছি। ভালো লাগতো, সাধারণ মানুষ বিএনপিকে ভালোবাসতো। কিন্তু এখন আমাদের সিনিয়র নেতারা যেভাবে চাঁদাবাজি, সালিশ বাণিজ্য, জবর দখলে জড়িয়েছে। তারা আওয়ামী লীগের মতো হয়ে গেছে। ভয়ে তাদের সামনে আজ কেউ কথা বলে না।