
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ক্ষমতা ও দায়িত্বে পরিধি কতদূর হবে ইসির সুপারিশে তা চূড়ান্ত করে খসড়া প্রকাশ করেছে অর্ন্তবর্তী সরকার। এতে সর্বক্ষেত্রেই কর্মকর্তাদের ক্ষমতা বেড়েছে। এখন থেকে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের মধ্যে কোনো ধরনের মতবিরোধ দেখা দিলে নির্বাচন কমিশনই (ইসি) অগ্রাধিকার পাবে। বিগত নির্বাচনে কারচুপির কালেমার কালো দাগ কর্মকর্তাদের উপর পড়লে তারা তা অস্বীকার করে। তাদের মতে আমরা এখানে শুধু আদেশ পালন করি। যারা আমাদের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাদেরকে নির্বাচনের আগে সরকার থেকে নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে। নির্বাচন পরিচালনা শেষ হলে তারা আবার নিজস্ব স্থানে ফিরে যান এতে নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা স্বাভাবিক ভাবেই কম থাকে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে নির্বাচন কমিশন স্বতন্ত্রভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা রাখলেও তা সম্ভব হয়নি। ফলে নির্বাচনের আগে সচিব, উপ সচিব, অতিরিক্ত সচিবের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিতে পারে নি কমিশন। কর্মকর্তারা নির্বাচন কমিশন সার্ভিসের দাবি করে এবং ভোটকেন্দ্রে কর্মকর্তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি ও নির্বাচন কর্মকর্তা আইন- ১৯৯১ সংশোধনের জন্য গত ১৫ সেপ্টেম্বর অর্ন্তবর্তী সরকারের কাছে অনুমোদনের জন্য একটি খসড়া পাঠায় ইসি।
গত বৃহস্পতিবার অর্ন্তবর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সভা থেকে জানা যায়, সরকার ও নির্বাচন কমিশনের মধ্যে কোনো ধরনের মতবিরোধ দেখা দিলে নির্বাচন কমিশনই (ইসি) অগ্রাধিকার পাবে। সেই সঙ্গে নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে কোনো মন্ত্রণালয় বা বিভাগের কর্মকর্তার ব্যবস্থা নেওয়ারও ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইন-১৯৯১ সংশোধনে এমন কর্তৃত্ব পেল ইসি।
সংশোধিত আইনে নির্বাচন কর্মকর্তাকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে নতুনভাবে। এতে নির্বাচন সংক্রান্ত কোনো দায়িত্ব বা কর্মে নিযুক্ত কোনো ব্যক্তি বা নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনো ব্যক্তি বা রিটার্নিং অফিসার বা ভোটকেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত ভোট গ্রহণকারী কর্মকর্তাদেরও (প্রিসাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার, পোলিং অফিসার বা আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্বে নিয়োজিত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য) নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
নতুন আইনে আরও কিছু বিষয় স্পষ্ট করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-অসদাচরণ করলে তার (নির্বাচন কর্মকর্তা) নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ তাকে চাকরি থেকে অপসারণ বা বরখাস্ত করতে পারবে। বাধ্যতামূলক অবসর, পদাবনতি, পদোন্নতি বা বেতন বৃদ্ধি অনধিক দুই বছরের জন্য স্থগিত রাখতে পারবে। অসদাচরণ করলে অনধিক দুই মাসের জন্য সাময়িকভাবে চাকরি থেকে বরখাস্তের আদেশ দিতে পারবেন এবং ওই বরখাস্তের আদেশ তার নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক তার চাকরিবিধি অনুযায়ী প্রদত্ত হয়েছে বলে গণ্য হবে এবং সে অনুযায়ী কার্যকর হবে।
কর্তৃপক্ষ প্রস্তাব পাওয়ার এক মাসের মধ্যে ওই প্রস্তাব বাস্তবায়ন করবে এবং সেই সম্পর্কে কমিশনকে জানাবে। কমিশনের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে যে কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে, তা ওই কর্মকর্তা বা ব্যক্তির ব্যক্তিগত নথি, চাকরি বই এবং বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদনে লিপিবদ্ধ ও ডোসিয়ারে অন্তর্ভুক্ত থাকবে এবং সেই সম্পর্কে কমিশনকে জানাতে হবে। সরকার এবং কমিশনের মধ্যে এই ধারার কোনো বিধান সম্পর্কে ভিন্নমত দেখা দিলে সে বিষয়ে কমিশনের সিদ্ধান্ত প্রাধান্য পাবে বলেও সংশোধিত আইনে বলা হয়েছে। এছাড়াও
বর্তমানে জনবল পূরণে পিএসসির (পাবলিক সার্ভিস কমিশন) সহায়তা নিয়ে থাকে ইসি। এক্ষেত্রে ইসি কর্মকর্তারা পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত সচিব হতে পারলেও সচিব আসে সরকার থেকে। এছাড়া অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিবের ফাঁকা পদগুলোও সরকার থেকে নিয়োগ দেওয়া হয়। আবার আইন শাখার কর্মকর্তাদের প্রেষণে আনা হয় জুডিশিয়াল সার্ভিস থেকে। নির্বাচনের সময় রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকেন সরকারের কর্মকর্তারাই। ইসি কর্মকর্তারা কেবল সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকেন। ফলে তাদের দ্বারা ভোটে হস্তক্ষেপের সুযোগ থেকে যায়। সেই সংকট থেকে উত্তরণের জন্যই মূলত ‘ইলেকশন সার্ভিস কমিশন’ গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। নির্বাচনের আর বাকি কয়েক মাস তবে এখনো বাস্তবায়ন হয় নি এই কমিশন।
উপজেলা, থানা ও সমমান ইলেকশন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা নির্বাচন কমিশন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের আলোকে দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন কমিশন সংশোধন অধ্যাদেশ ২০২৫ জারি করে নির্বাচন সার্ভিস কমিশন গঠন করা এবং দ্রুত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করার দাবী জানান। ফলে আইন মন্ত্রণালয় ও ইসি সূত্র জানায়, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সংস্কার প্রস্তাবগুলোর মধ্যে আলাদা সার্ভিস গঠনের জন্য নির্বাচন কমিশন সচিবালয় আইন তৈরির কথা বলা হয়েছিল এবং এটি দ্রুত বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছিল। এ বিষয়ে সংস্কার কমিশনের সুপারিশের সঙ্গে নাসির উদ্দিন কমিশন একমত প্রকাশ করে আইন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায়। এরপর আইন মন্ত্রণালয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মতামত চাইলে মন্ত্রিপরিষদের বিভাগ একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে যাচাইয়ের জন্য কমিটি গঠন করে। সে কমিটি নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে জন্য আলাদা সার্ভিস কমিশন গঠনের ‘নির্বাচন কমিশন সার্ভিস’ গঠনের বিধান অন্তর্ভুক্তির যৌক্তিকতা আরও যাচাইয়ের ওপর মত দেয়। অনুমোদিত খসড়ার সংশোধনীতে নির্বাচনে কোনো কর্মকর্তাকে নিয়োগ করা হলে তা কিভাবে গন্য হবে তা সংশোধন করা হয়েছে। সংশোধনীতে বলা হয়েছে, নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ অর্থ কোনো ব্যক্তিকে চাকুরীতে নিয়োগকারী কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ’ র পরিবর্তে বিভাগ, মন্ত্রণালয়, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে গণ্য হবে। সে মতে নির্বাচন কমিশন সার্ভিসের কাজ করার বৈধ্যতা প্রকাশ পেল এবং তা নিয়োগের ক্ষেত্রে পথ খুলে দিল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এ বিষয়ে কথা হলে নির্বাচনব্যবস্থা বিশ্লেষক আব্দুল আলীম বলেন, নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) সংশোধনের মাধ্যমে ইসির কর্তৃত্ব বাড়লো। এর মাধ্যমে কেউ কোনো অনিয়ম করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এতে জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তাব সংস্কার কমিশন থেকে দিয়েছিলাম আমরা। এটা খুব ইতিবাচক পদক্ষেপ সরকারের।