
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন ও আইনি ভিত্তি নিশ্চিত করতে ‘সংবিধান আদেশ’ ও গণভোটের প্রস্তাব করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
কমিশনের প্রস্তাব আগামী ফেব্রুয়ারিতে যেদিন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, একইদিন গণভোটের মাধ্যমে সনদের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তবে গণভোটের তারিখ (দিনক্ষণ) নিয়ে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা রয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) বলছে, জাতীয় নির্বাচনের পরে গণভোট। তবে সবাই একমত হলে নির্বাচনের দিন হতে পারে। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে হবে আলোচনার টেবিলে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী চায় জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোটের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়ন করতে। আর সনদের ভিত্তিতেই হবে জাতীয় নির্বাচন। এ ব্যাপারে ইতোমধ্যে তারা রাজপথে আন্দোলনে নেমেছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলছে সংবিধান ইস্যুতে গণপরিষদ নির্বাচন জরুরি। এই গণপরিষদের মাধ্যমে নতুন সংবিধান তৈরি করতে চায়। আর গণভোট নিয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত জানাবে। তবে মতভিন্নতার মধ্যেও আশার আলো দেখছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
জানতে চাইলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও আইনি ভিত্তি ইস্যুতে ঐকমত্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। আমি আশাবাদী দ্রুতই এ ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছানো যাবে।’ তিনি বলেন, বিষয়টি একটু কঠিন। তবে অসম্ভব নয়।
‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ বাস্তবায়ন ও আইনি ভিত্তির জন্য সরকারকে একটি ‘সংবিধান আদেশ’ জারির সুপারিশ করার উদ্যোগ নিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। এই প্রক্রিয়ায় সংবিধানসংশ্লিষ্ট সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হবে। তবে এই ‘সংবিধান আদেশ’ একটি গণভোটের মাধ্যমে জনগণের চূড়ান্ত অনুমোদন লাভ করবে। আগামী সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোটও অনুষ্ঠিত হবে। বুধবার ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠকে এসব বিষয় উঠে আসে।
এ ব্যাপারে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক শেষে বুধবার বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, সাংবিধানিক আদেশ আজ বা কাল চ্যালেঞ্জ হতে পারে। কিন্তু জাতির সামনে খারাপ উদাহরণ তৈরি করা ঠিক হবে না।
সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোট আয়োজনের প্রস্তাব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সবাই মতামত দিলে বিবেচনা করা যায়। তবে যারা নির্বাচিত হবেন, তারা সনদে স্বাক্ষর করেই জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবেন। এমন কিছু মৌলিক সংস্কারমূলক বিষয় আছে, যা বাস্তবায়নে সংসদীয় গণভোটেরও প্রয়োজন হতে পারে। তাহলে একই বিষয়ে দুবার গণভোটের প্রয়োজন কেন? এসব বিষয় আলোচনার টেবিলেই নির্ধারিত হওয়া উচিত।’ একইদিন জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর
রহমান আযাদ বলেছেন, ‘রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন হবে, এরপর সে বিষয়ে গণভোটের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে এ গণভোট হবে। আমরা চাই জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট দেওয়া হোক। এতে সংস্কারের বিষয়ে জনগণের মতামত প্রতিফলিত হবে। কেউ কেউ বলছেন, এটা নির্বাচনের আগে সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা মনে করি সেটা সম্ভব। শুধু ব্যবস্থাপনার ব্যাপার।’
তিনি আরও বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্য না হলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব জনগণের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। তারাই গণভোটের মাধ্যমে ঠিক করবে, কতটুকু সংস্কার হবে, কী কী সংস্কার হবে।’
প্রসঙ্গত, জুলাই সনদে মোট ৮৪ ধারা বা সিদ্ধান্ত আছে। এর মধ্যে বেশ কিছু সিদ্ধান্তে কোনো কোনো দলের নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) রয়েছে। সনদ বাস্তবায়নে তিন ধরনের প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে। বেশ কিছু সিদ্ধান্ত সরকারের নির্বাহী আদেশে বাস্তবায়ন করা যায়। কিছু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অধ্যাদেশ জারি করতে হবে। আর প্রায় ৩৪টি ধারা বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধন করতে হবে।
এক্ষেত্রে নির্বাহী আদেশ এবং অধ্যাদেশ দিয়ে যেসব ধারা বাস্তবায়ন করা যাবে, সেক্ষেত্রে সব দল একমত। তবে যেসব ধারা বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধন করতে হবে, সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে বিভক্তি আছে। সর্বশেষ গণভোটের ব্যাপারে বিএনপি ও জামায়াত একমতে এসেছে। তবে পার্থক্য গণভোটের সময় নিয়ে।
এ ব্যাপারে অধ্যাপক আলী রীয়াজ যুগান্তরকে আরও বলেন, ইতোমধ্যে জুলাই সনদে যেসব বিষয় আছে, সে ব্যাপারে সবগুলো দল একমত। কয়েকটি ধারায় মতভিন্নতা (নোট অব ডিসেন্ট) থাকলেও আমরা সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছি। কিন্তু সমস্যা হলো এর আইনি ভিত্তি ও বাস্তবায়ন এবং প্রক্রিয়া নিয়ে। ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি বলেন, জুলাই সনদ ইস্যুতে আমরা সম্মিলিতভাবে আজকের যে অবস্থানে পৌঁছেছি, শুরুতে এটি খুবই কঠিন ছিল। তবে আমরা মনে করেছিলাম এটি অসম্ভব নয়। শেষ পর্যন্ত সেটিই হয়েছে।
দীর্ঘ আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলো একটি অবস্থানে আসতে পেরেছে। অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান আছে। এই অবস্থান থাকাটাই স্বাভাবিক। আর ভিন্ন ভিন্ন এই অবস্থান থেকে একমতে নিয়ে আসতেই ঐকমত্য কমিশন কাজ করছে। একবাক্যে ওনারা সবাই যদি সবকিছু মেনে নিতেন, তাহলে আমাদের (ঐকমত্য কমিশনের) কোনো প্রয়োজন ছিল না।
‘সংবিধান আদেশ’ ও গণভোট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিশেষজ্ঞরা আমাদের এই মতামত দিয়েছেন। আমরা সরকারের কাছে এই সুপারিশ করব। তবে একাধিক বিকল্প সুপারিশ থাকবে। যাতে সরকারের সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হয়। আশা করি রাজনৈতিক দলগুলোও একটা অবস্থানে এসে পৌঁছাতে পারবে।
ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনা শেষে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে আমরা ১০৬ ধারা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত চাই না। আমরা গণপরিষদ নির্বাচন চাই। তা এ সরকারের মাধ্যমেই করতে হবে। বিষয়টি নিয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনার পর আমাদের মতামত জানাব।’
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে আবারও বিভাজনের দিকে উসকে দেওয়া হয়েছে। সরকার নিজেরা সিদ্ধান্ত না নিয়ে আবারও দলগুলোর দিকে বল ঠেলে দিয়েছে। দায় নিতে চাচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘গণভোট ও সাংবিধানিক আদেশের প্রস্তাব দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।’ তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘যদি জনগণ এটি না মানে তাহলে কী হবে?’