Image description

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) এবং তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্মুক্ত দরপত্র ছাড়াই কোটেশন, নগদ এবং ডিপিএম (Direct Purchase Method) পদ্ধতিতে বিপুল পরিমাণ পণ্য ও সরাঞ্জামাদি ক্রয় করা হয়েছে। ২০২১-২২ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এই ১০টি প্রতিষ্ঠানে নিয়মবহির্ভূতভাবে পণ্য ও সরঞ্জামাদি ক্রয়ে অনিয়মিতভাবে ৮১ কোটি ৯৫ লাখ ৪৭ হাজার ৯৮৫ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। 

সম্প্রতি ইউজিসিতে অডিট কার্যক্রম পরিচালনা করে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর। অডিট রিপোর্টে নিয়মবহির্ভূতভাবে এ কার্যক্রম পরিচালনার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর।

অডিট রিপোর্টের তথ্য অনুযায়ী, ইউজিসি ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ ৬৮ হাজার টাকা, নেত্রকোণা বিশ্ববিদ্যালয় ২৪ লাখ ১০ হাজার ৩৭০ টাকা, গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ১ কোটি ৪৩ লাখ ২২ হাজার ৮৬৭, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ৮ লাখ ৩৫ হাজার ৯১১, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ২৩ লাখ ৯০ হাজার ২৯০, মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি ৩৮ কোটি ৪৬ লাখ ১২ হাজার ৫৪৪, জগন্নোথ বিশ্ববিদ্যালয় ১ কোটি ২৪ লাখ ৬৬ হাজার ৭৪০, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ১২ লাখ ৫৮ হাজার ৭২৫, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ৪ কোটি ২ লাখ ৬৫ হাজার ৪৯১ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ১ কোটি ৬১ লাখ ১৭ হাজার ৪৭ টাকার পণ্য ও সরঞ্জামাদি ক্রয় করেছে। এসব ক্রয় নিয়মবহির্ভূতভাবে উন্মুক্ত দরপত্র আহবান না করেই ক্রয় করা হয়েছে। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পছন্দের প্রার্থীদের কাজ দিতে ইউজিসি এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পণ্য কিংবা সরঞ্জামাদি ক্রয়ের ক্ষেত্রে উন্মুক্ত দরপত্র আহবান করেন না। এরপর ফলে ঠিকাদাররা পণ্যের দামের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি অর্থ ব্যয় দেখিয়ে টাকা তুলে নেয়। এর ফলে সরকার আর্থিক ক্ষতির মুখে পরে সরকার। অপচয় হয় সাধারণ মানুষের করের অর্থ।

যে সকল বিষয়ে আপত্তি এসেছে, কমিশন সে সকল বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে। আমরা অভিযুক্তদের কাছে বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা বা মতামত নিয়েছি। সেগুলো নিয়ে আগামী সপ্তাহে আলোচনা করা হবে। পরবর্তীতে রিপোর্ট আকারে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরে জমা দেওয়া হবে।’—নাহিদ সুলতানা, পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) অডিট শাখা, ইউজিসি

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে ইউজিসির শীর্ষ এক কর্মকর্তা দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘শুধু উন্মুক্ত দরপত্রে অনিয়ম হয়েছে বিষয়টি এমন নয়; ইউজিসি এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অসংখ্য অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে, ঘটছে। তবে এসব অনিয়মের ক্ষেত্রে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় একই ধরনের অপরাধ বারবার হচ্ছে। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের উচিত এগুলো বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া।’

অডিটের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউজিসি এবং সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বরাদ্দকৃত অর্থকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ভাগ করে টেন্ডার ও দরপত্রের নিয়ম এড়িয়ে সরাসরি কোটেশন ও নগদে ক্রয় করেছে। সরকারি ক্রয়বিধি পিপিআর ২০০৮-এর বিধি ৬৯(৪)(ক) অনুযায়ী সম্ভাব্য বৃহৎ চুক্তি ক্ষুদ্র অংশে ভাগ করা যায় না। একইভাবে, জিএফআর বিধি ১৫৩ অনুসারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন এড়ানোর জন্য ক্রয় আদেশ বিভাজন করা যাবে না।

অর্থ বিভাগের আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ আদেশ ২০১৫-এর নির্দেশনা অনুযায়ী, টেন্ডার বিজ্ঞাপন ছাড়া প্রতি ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ এককালীন ৫ লাখ টাকা এবং বছরে সর্বোচ্চ ৩০ লাখ টাকা ব্যয় করা যায়। সরাসরি ক্রয়ের ক্ষেত্রে এককালীন সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা এবং বছরে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা ব্যয় করা সম্ভব। তবে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এসব সীমা অমান্য করে ৮২ কোটি টাকার ক্রয় কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে।

নিরীক্ষায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রয় সংক্রান্ত নথি, বিল রেজিস্টার ও খাতভিত্তিক ভাউচার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ইউজিসি এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বরাদ্দকৃত অর্থকে ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত করে কোটেশন বা নগদে ক্রয় করেছে। এতে সরকারি বিধি লঙ্ঘন এবং আর্থিক অনিয়মের প্রমাণ স্পষ্ট হয়েছে।

তদারক সংস্থা ইউজিসি এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এই অনিয়ম প্রকাশ্যে আসার পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নজরদারির মধ্যে নিয়ে আসার দাবি উঠেছে। আর্থিক অনিয়ম ও বিধিভঙ্গের ফলে সরকারের তহবিল ক্ষতির মুখে পড়তে পারে, যা ভবিষ্যতের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে প্রভাব ফেলতে পারে।

এসব অনিয়মের বিষয়ে ইউজিসি ও সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হলেও ইউজিসি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, নেত্রকোণা বিশ্ববিদ্যালয়, মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কোনো জবাব দেয়নি। যা অডিট কোডের বিধি ৫৯ এবং ট্রেজারি রুলস এর অধীনে প্রণীত সাবসিডিয়ারি রুলস এর বিধি ৪৩৭ লঙ্ঘন বলে জানিয়েছে অধিদপ্তর।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় তাদের জবাবে জানিয়েছে, তালিকাভুক্ত সরবরাহকারী বা ঠিকাদারের নিকট নির্দিষ্ট মূল্যসীমার মধ্যে সীমিত টেন্ডার পদ্ধতিতে ক্রয় সম্পন্ন হয়েছে। গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় জানিয়েছে, অতীব জরুরি প্রয়োজনে নগদে ক্রয় করা হয়েছে, তবে প্রতিক্ষেত্রে ব্যয় সীমা ২৫ হাজার টাকার মধ্যে রাখা হয়েছে। চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় জানায়, জরুরি প্রয়োজনে OIM পদ্ধতি ব্যবহার না করে DPM পদ্ধতিতে ক্রয় সম্পন্ন করা হয়েছে।

বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় দাবি করেছে, পিপিআর-২০০৮-এর বিধি অনুসারে DPM পদ্ধতিতে দ্রুত সময়ে প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবা ক্রয় করা হয়েছে এবং কোনো বিধিভঙ্গ ঘটেনি। 

শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর এসব জবাবে মন্তব্যে গ্রহণযোগ্য নয় বলে জানিয়েছে। এর কারণ হিসেবে সংস্থাটি জানিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ আদেশের বিধি যথাযথভাবে অনুসরণ করেনি।

এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে

তদারক সংস্থা ইউজিসি এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এই অনিয়ম প্রকাশ্যে আসার পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নজরদারির মধ্যে নিয়ে আসার দাবি উঠেছে। আর্থিক অনিয়ম ও বিধিভঙ্গের ফলে সরকারের তহবিল ক্ষতির মুখে পড়তে পারে, যা ভবিষ্যতের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে প্রভাব ফেলতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সরকারি ক্রয়বিধি উপেক্ষা করে এসব ক্রয় কার্যক্রম পরিচালনা করলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি কমে যায়। এছাড়া, ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনিয়ম প্রতিরোধে শক্তিশালী পর্যবেক্ষণ ও স্বচ্ছ মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।

সার্বিক বিষয়ে জানতে ইউজিসি সচিব ড. ফখরুল ইসলামকে ফোন করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। তবে তিনি অডিট শাখার পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) নাহিদ সুলতানার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। এ বিষয়ে নাহিদ সুলতানা বলেন, ‘যে সকল বিষয়ে আপত্তি এসেছে, কমিশন সে সকল বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে। আমরা অভিযুক্তদের কাছে বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা বা মতামত নিয়েছি। সেগুলো নিয়ে আগামী সপ্তাহে আলোচনা করা হবে। পরবর্তীতে রিপোর্ট আকারে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরে জমা দেওয়া হবে।’