
চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ ও দালালদের দখলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল। এতে রোগী থেকে শুরু করে চিকিৎসক-কর্মচারীরাও প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসাসেবা।
অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানলেও তারা কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এতে অনিয়মে জড়িতরা আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
চাঁদাবাজ চক্রের দৌরাত্ম্য চরমে
১৯৪৬ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল দেশের সবচেয়ে বড় সরকারি হাসপাতাল। তুলনামূলক কম খরচে ভালো সেবার আশায় দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এখানে ভিড় করেন। কিন্তু নানান অনিয়মে হতাশ হতে হয় সেবাপ্রত্যাশীদের।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গড়ে উঠেছে চাঁদাবাজ চক্র। এর সঙ্গে জড়িত কিছু সাবেক ছাত্র ও চিকিৎসক। তাদের সঙ্গে যোগসাজশ রয়েছে বিএনপির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের কয়েকজন সাবেক নেতার। তারা প্রকাশ্যে হাসপাতাল পরিচালকের কক্ষে প্রবেশ করে টেন্ডার তদবির, উপপরিচালককে হোয়াটসঅ্যাপে হুমকি এবং হাসপাতালসংলগ্ন নিজস্ব ডায়াগনস্টিক সেন্টারে জোর করে রোগী পাঠাচ্ছেন।
এসব ঘটনায় ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সংসদের সাবেক সহ-সভাপতি ও ঢামেক ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ডা. জাভেদ আহমেদ, ছাত্রদলের সাবেক স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. মাহমুদুল হাসান খান সুমন, ঢামেক ছাত্রদলের সাবেক জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ডা. বিপ্লব, ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি মারুফ হাসান রনি, তিতুমীর কলেজ শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. মাসুদ ও চকবাজার থানা জাতীয়তাবাদী তরুণ দলের সাধারণ সম্পাদক মেজবাউদ্দীন সিফাতের নাম উঠে এসেছে। তাদের বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে সরকারের দুটি গোয়েন্দা সংস্থা।
প্রতি মাসে চাঁদা দিতে হয় চিকিৎসকদের
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক সহ-সভাপতি (ভিপি) ডা. জাভেদ দলীয় তহবিলের নামে হাসপাতালের বিভিন্ন পর্যায়ের চিকিৎসকদের কাছ থেকে মাসিক হারে চাঁদা আদায় করেন বলে বেশ কয়েকজন চিকিৎসক অভিযোগ করেন। এর মধ্যে মেডিকেল অফিসারদের এক হাজার টাকা এবং আবাসিক চিকিৎসক/আবাসিক সার্জনকে চাঁদা বাবদ মাসিক দেড় হাজার টাকা করে দিতে হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মেডিকেলের দুজন চিকিৎসক জাগো নিউজকে জানান, প্রতি মাসের ৭ তারিখের মধ্যে চাঁদা না দিলে তাদের বিভিন্নভাবে হুমকি-ধামকি এবং লাঞ্ছিত করা হতো। পরে এ ঘটনায় বিএনপি-সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব) ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল শাখার প্যাডে চিঠি দেয়। ওই চিঠিতে এ ধরনের চাঁদা দেওয়া-নেওয়া থেকে বিরত থাকতে কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়। পরে অনেক চিকিৎসক চাঁদা দেওয়া বন্ধ করেন। কিন্তু কিছু চিকিৎসক অপমান-অপদস্ত হওয়ার ভয়ে এখনো নিয়মিত চাঁদা দিচ্ছেন।
তবে চাঁদাবাজির বিষয়টি অস্বীকার করেন ডা. জাভেদ আহমেদ। তিনি বিসিএস পুলিশ ক্যাডার বলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপন সূত্রে নিশ্চিত হয়েছে জাগো নিউজ।
টেন্ডারবাজিতে বেপরোয়া
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডা. জাভেদ ও ডা. সুমন গত ১৫ মার্চ দুপুর ২টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকের কক্ষে ঢুকে তাদের পছন্দের প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে টেন্ডার দিতে তদবির করেন। পরিচালক অন্যায় তদবিরে অসম্মত জানালে তারা মনঃক্ষুণ্ন হয়ে চলে যান।
এরপর ২৬ মার্চ হাসপাতালের উপপরিচালক মো. আশরাফুল ইসলামকে হোয়াটসঅ্যাপে ডা. জাভেদ তাদের পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে টেন্ডার দিতে সহায়তা করার তদবির করেন। এতে উপপরিচালক অসম্মত জানালে তাকে হুমকি দেন ডা. জাভেদ।
নিয়ম অনুযায়ী ই-গভর্নমেন্ট প্রকিউরমেন্টে (ই-জিপি) প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের দর দিয়ে টেন্ডার জমা দেবে। কিন্তু নিয়মবহির্ভূতভাবে ডা. জাভেদসহ অন্যরা অপেক্ষাকৃত দূরে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোকে টেন্ডার দিতে বারবার ঢাকা মেডিকেল প্রশাসনকে চাপ দেন।
ডায়াগনস্টিক সিন্ডিকেট
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সংলগ্ন চাঁনখারপুল এলাকায় গড়ে ওঠে ‘প্রাইম টিজি’ নামের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার। ডা. জাভেদ, ডা. সুমন, ডা. মনিরসহ কয়েকজন এই ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গে জড়িত। অভিযোগ রয়েছে, তাদের এজেন্টরা হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে অন্য ক্লিনিকের এজেন্টদের মারধর, চিকিৎসক-নার্সদের হুমকি, এমনকি জোরপূর্বক রোগীদের প্রাইম টিজিতে পরীক্ষা করাতে বাধ্য করেন।
এদিকে প্রাইম টিজি ছাড়া আরও বেশকিছু ডায়াগনস্টিক সেন্টারের এজেন্টরা সক্রিয় রয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রিভাইভ, ঢাকা ডায়াগনস্টিক ও হেলথ এইড। এসব প্রতিষ্ঠানের এজেন্টদের খপ্পরে পড়ে রোগীরা বাড়তি ফি দিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা করাতে বাধ্য হন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীদের অন্যত্র ভাগিয়ে নেওয়ার কাজ করেন জুবায়ের, দুর্জয়, নিরব, সুমন, মাহবুব, শামীম, মাসুদ রানা ও মানিক মিয়া (ওপরে বাঁ থেকে)। ছবি: সংগৃহীত
সক্রিয় দালালচক্র
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গাইনি বিভাগ (২১২ নম্বর ওয়ার্ড) এবং জরুরি বিভাগের নিউরোসার্জারি ও সার্জারি আউটডোর বর্তমানে দালালদের মূল আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছে।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে অন্তত ১৯ জন সক্রিয় দালালের নাম উঠে এসেছে। তারা হলেন জুবায়ের, দুর্জয়, নিরব, সুমন (হোসেনি দালান), মাহবুব, শামীম, মাসুদ রানা, মানিক মিয়া, দিদার, শাহীন, রনি, জোবেল জমাদ্দার, মারুফ, পলক, পারভেজ, হুমায়ুন কবির নয়ন, মোস্তাকিম, সুপন ও সুমন (হাজারীবাগ)। এদের কেউ প্রাইম টিজি, কেউ রিভাইভ, কেউবা হেলথ এইড বা ঢাকা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের এজেন্ট হিসেবে দালালির কাজ করেন।
রোগীদের ভুল বোঝানো, বাড়তি ফি আদায়, অন্য ডায়াগনস্টিক সেন্টারের এজেন্টদের ওপর হামলা, হাসপাতালের কর্মচারীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, এমনকি রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে আধিপত্য বিস্তারের অভিযোগ রয়েছে দালালচক্রের এসব সদস্যের বিরুদ্ধে।
ডা. জাভেদ আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘কোথাও কোনো চাঁদাবাজি বা টেন্ডারবাজিতে আমি জড়িত নই। প্রাইম টিজি বা কোনো ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকানায়ও নেই। আপনি অনুসন্ধান করতে পারেন। এসব মিথ্যা তথ্য, ড্যাবের কমিটিকে সামনে রেখে বিরোধীপক্ষ এসব অপতথ্য ছড়াচ্ছে।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীদের অন্যত্র ভাগিয়ে নেওয়ার কাজ করেন দিদার, শাহীন, রনি, জোবেল জমাদ্দার, মারুফ, পলক, পারভেজ ও সুমন (ওপরে বাঁ থেকে)। ছবি: সংগৃহীত
টেন্ডারবাজিতে জড়িত থাকার বিষয়ে ছাত্রদলের সাবেক নেতা ডা. মাহমুদুল হাসান খান সুমন, ডা. বিপ্লব, মারুফ হাসান রনি ও মো. মাসুদ এবং তরুণ দলের নেতা মেজবাউদ্দীন সিফাতের বক্তব্য জানতে তাদের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও তারা কথা বলেননি।
প্রশাসনের নির্বিকার ভূমিকা
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ও উপপরিচালককে একাধিকবার হুমকি দেওয়ার ঘটনা ঘটলেও এখনো কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও চিকিৎসকরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়ে গোয়েন্দা সংস্থা প্রতিবেদন দিলেও নেওয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা।
ঢাকা মেডিকেলের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা টেন্ডারবাজি ও দালালচক্রের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত চাপের মুখে থাকি। বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানালেও তারা হাসপাতাল এলাকায় প্রবেশ করতে অনীহা দেখায়।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, “সংশ্লিষ্টরা আমার কাছেও একাধিকবার এসেছিলেন। বলেছেন— ‘আমরা বিগত সময়ে বঞ্চিত ছিলাম, কোনো টেন্ডার পাইনি, সে ব্যাপারে এসেছি।’ আমি তখনই পরিষ্কার করে বলেছি—এখানে সরাসরি টেন্ডার দেওয়ার বিষয় নেই। আমরা ই-জিপি থেকে টেন্ডার করি। ই-জিপি থেকে পেলে আপনারাও পাবেন। এরপর থেকে তারা আমার কাছে আর আসেননি। তবে আমার স্টাফদের ধমক-টমক দেন—এটা আমি জানি। এছাড়া বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগী পাঠাতে তারা চিকিৎসকদের বাধ্য করেন। তবে চিকিৎসকদের কাছ থেকে টাকা নেন—এটা আগে জানা ছিল না। এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কেউ আমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ করেনি।’
চিকিৎসকদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়ার ঘটনায় ডা. জাভেদের বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালক আসাদুজ্জামান বলেন, ‘ওনাকে (ডা. জাভেদ) যখন প্রশ্ন করা হয়েছিল যে তিনি এখানকার ডাক্তার কি না, তখন তিনি স্পষ্টই বলেছেন—তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী নন। এখানে কোনো পেশায় তার নাম নিবন্ধিত নেই।’
ডা. জাভেদের বিষয়ে ড্যাব সভাপতি ডা. হারুন আল রশিদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি তাকে চিনি। আমাদের ড্যাবের সদস্য। চাঁদাবাজি বা টেন্ডার নিয়ন্ত্রণে তিনি জড়িত নন। এরকম অভিযোগ আমি প্রথম শুনলাম। তবে তিনি পুলিশ ক্যাডারে যোগদান করলে আমাদের এখানে থাকার সুযোগ নেই।’
ড্যাবের মহাসচিব ডা. জহিরুল ইসলাম শাকিল জাগো নিউজকে বলেন, ‘এমন অভিযোগ আমার জানা নেই। কেউ অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেবো।’
সমস্যা থেকে উত্তরণে করণীয়
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা মেডিকেলে রোগীরা ন্যায্য চিকিৎসা ও সঠিক পরীক্ষার বদলে দালালদের হাতে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। চিকিৎসক-নার্সরাও স্বাভাবিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। টেন্ডারবাজির কারণে সরকারি অর্থ অপচয় ও নিম্নমানের চিকিৎসা সামগ্রী সরবরাহের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
গোয়েন্দা সংস্থা তাদের সুপারিশে তুলে ধরেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অভিযান চালাতে হবে। সক্রিয় দালালচক্রের তালিকা প্রকাশ করে তাদের গ্রেফতার ও বিচারের আওতায় আনতে হবে। রাজনৈতিক দলীয় পরিচয়ে যারা এ ধরনের অনিয়মে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দালাল-চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। হাসপাতালে চলমান বিভিন্ন অনিয়মের লাগাম এখনই টানতে না পারলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে।