
বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনে নলকূপ পানির প্রধান উৎস। কিন্তু এর সঙ্গেই লুকিয়ে আছে স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি আর্সেনিক। দেশের কোটি মানুষ এখনও এ বিষাক্ত উপাদানের ঝুঁকিতে রয়েছে। আমাদের দেশে সাধারণত আর্সেনিক পরীক্ষার জন্য কেমিক্যাল কিট কিংবা ল্যাব টেস্টের উপর নির্ভর করতে হয়, যা সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। কিন্তু এবার একদল গবেষক উদ্ভাবন করেছেন এমন একটি মোবাইল অ্যাপ, যা কয়েক সেকেন্ডেই জানিয়ে দেবে কোনো নলকূপে আর্সেনিক ঝুঁকি আছে কি না।
অ্যাপটির নাম ‘আই আর্সেনিক’। অ্যাপটি ইউনিভার্সিটি অব পোর্টসমাউথ-এর তত্ত্বাবধানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কার্টিন ইউনিভার্সিটি এবং ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের যৌথ উদ্যোগে তৈরি হয়েছে। এটি মাঠপর্যায়ে কোনো খরচ বা ঝুঁকি ছাড়াই কিট পরীক্ষার চেয়েও ভালো ফল দিচ্ছে। যুগান্তকারী এ অ্যাপের উদ্ভাবনী দলের প্রধান গবেষক ও প্রকল্প পরিচালক হিসেবে রয়েছেন যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অফ পোর্টসমাউথ সিনিয়র লেকচারার এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) সাবেক সহকারী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হক।
এ ছাড়া গবেষক দলের মধ্যে রয়েছেন ইউনিভার্সিটি অফ পোর্টসমাউথ’র কেন সোয়ার্টজ, অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন ইউনিভার্সিটির ড. আশরাফ দেওয়ান, ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডন’র অধ্যাপক অ্যাড্রিয়ান বাটলার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী মাতিন আহমেদ। প্রকল্পে সহযোগিতা করেছে বাংলাদেশ সরকারের গণপূর্ত স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর।
জানা গেছে, একটি নলকূপে আর্সেনিক আছে কি না তা ৯০ শতাংশ-এর বেশি নির্ভরযোগ্যতায় অনুমান করা যায় তিনটি তথ্য ব্যবহার করে। তা হলো- নলকূপের চৌকাঠে পড়া দাগ (একটি ভূ-রসায়নিক নির্দেশক), নলকূপের গভীরতা এবং রাস্তার ঠিকানা (যা মিলে একটি ৩-মাত্রিক অবস্থান নির্ধারণে সাহায্য করে)।
এমনকি ব্যবহারকারীর গ্রামের নাম, অবস্থান এবং প্ল্যাটফর্মে থাকা দাগের রং ব্যবহার করে একটি টিউবওয়েল নিরাপদ কি না তা অনুমান করে এবং প্ল্যাটফর্মে থাকা দাগের রং ক্লাউড-ভিত্তিক একটি এআই মডেলের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা হয়। পূর্বের পরীক্ষার ডেটার সঙ্গে মিলিয়ে, এটি ব্যবহারকারীকে রঙের মাধ্যমে স্পষ্টভাবে ঝুঁকির মাত্রা জানিয়ে দেয়।
বর্তমানে এটি পর্যবেক্ষণভিত্তিক তথ্য এবং একটি পাবলিক ডেটাসেটের নমুনা ব্যবহার করে একটি কম্পিউটার মডেল তৈরি করে, যা নলকূপের আর্সেনিক মাত্রা অনুমান করতে পারে। গবেষক দলের সূত্র মতে, মাঠ পর্যায়ের যাচাইয়ে দেখা গেছে, ১০০টি কূপের মধ্যে ৮৪টির ক্ষেত্রে অ্যাপটি সঠিকভাবে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ নলকূপকে আলাদা করতে সক্ষম হয়। এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষ কোনো ব্যয়বহুল রাসায়নিক কিট বা বিশেষ প্রশিক্ষণ ছাড়াই আর্সেনিক ঝুঁকি যাচাই করতে পারবে।
এ বিষয়ে উদ্ভাবনী দলের প্রধান গবেষক ও প্রকল্প পরিচালক ড. মোহাম্মদ হক বলেন, ‘আর্সেনিক একটি নীরব স্বাস্থ্যঝুঁকি, যা এখনও কোটি মানুষের জীবনকে বিরূপভাবে প্রভাবিত করছে। এ অ্যাপ সহজ তথ্য ব্যবহার করে গ্রামীণ পরিবারগুলোকে ঝুঁকি জানতে এবং নিরাপদ পানির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০১৯ সালে ইউনিভার্সিটি অব পোর্টসমাউথ থেকে গবেষণা তহবিল পাওয়ার পর কাজ শুরু করি। মাঠ পর্যায়ের ভ্যালিডেশন সম্পন্ন হয় ২০২৪ সালে এবং অ্যাপটি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয় ২০২৫ সালের জুলাইয়ে। বর্তমানে এটি সক্রিয় রয়েছে এবং নিয়মিত উন্নয়ন করা হচ্ছে।’