কয়েক দিন আগে চট্টগ্রাম আদালতের বারান্দা থেকে প্রায় দুই হাজার মামলার নথি চুরি হওয়ার ঘটনা ঘটে। চোর ধরতে পুলিশের ঘুম হারাম হয়ে যায়। অবশেষে ধরা পড়ে সেই ‘চোর’। উদ্ধার হয় ৯ বস্তা নথি। কিন্তু চুরির এ ঘটনার রেশ না কাটতেই এবার নতুন আদালত ভবনের ছাদে ‘নথির স্তূপ’ পড়ে থাকা নিয়ে উঠল প্রশ্ন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, নতুন আদালত ভবনের চার তলার ছাদে (পশ্চিম দিকে) গত কয়েকদিন দিন ধরে দেখা যাচ্ছে পুরনো নথিপত্রের স্তূপ। মামলার নথিপত্র যতই পুরনো হোক সেসব সংরক্ষণের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট আদালতের কর্মচারীদের। এভাবে খোলা আকাশের নিচে পড়ে থাকায় ঝড়-বৃষ্টিতে নথিগুলো নস্ট হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
খোলা আকাশের নিচে স্তূপ করে রাখা মামলা-সংক্রান্ত নথিপত্র দেখে মনে হতে পারে এগুলো পরিত্যক্ত বা অকেজো। বুধবার দুপুরে সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, নথি ফেলে রাখা ওই ছাদে লোকজনেরও আনাগোনা আছে। কেউ কোনো নথি তুলে নিয়ে গেলে বা কেজি দরে বিক্রি করে দিলে তো মহাবিপদ! অথচ এভাবেই অবহেলা আর নিরাপত্তাহীন অবস্থায় পড়ে আছে নথিগুলো।
তবে এসব নথি কি আসলে পরিত্যক্ত? আদালত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, না পরিত্যক্ত নয়। অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার জন্য এগুলো এখানে রাখা হয়েছে বলে দাবি তাদের। তাই বলে খোলা আকাশের নিচে?
সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, চট্টগ্রাম আদালতে বিভিন্ন মামলার ফাইলপত্র গায়েবের ঘটনাও ইতিমধ্যে ঘটার নজির আছে। জানা গেছে, নথি ফেলে রাখা ছাদের নিচে চতুর্থ তলায় সপ্তম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত এবং এর নিচে তৃতীয় তলায় প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত রয়েছে।
চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট নাজিম উদ্দিন বলেন, যেকোনো আদালতের প্রতিটি মামলার ফাইলই গুরুত্বপূর্ণ। হোক সিভিল কিংবা ক্রিমিনাল। এসব ফাইলে থাকে গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায়। যেমন জামিন বিষয়ে কোনো আদেশের ফাইল হারিয়ে গেলে বা নষ্ট হলে আসামিকে দীর্ঘদিনের জন্য থাকতে হয় কারাগারে।’
নাম প্রকাশ না করে জেলা আইনজীবী সমিতির এক নেতা বলেন, ‘আদালতে ফাইল হারিয়ে যাওয়ার ঘটনায় ভোগেন বেশি সরকারি-বেসরকারি সব আইনজীবী ও তাদের মক্কেলরা। এমনকি বিচারকরাও মামলার কাগজপত্র গায়েব হওয়া নিয়ে অনেকবার বিরক্তি প্রকাশ করেছেন এজলাসে।’
আরেক আইনজীবী বলেন, ‘ছাদে নথি ফেলে রাখা এক ধরনের বিশৃঙ্খলা। যেখানে ফাইল রাখার জায়গা সেখানে ফাইল রাখা হয় না। মিসিং হওয়ার কারণে অনেক সময় আদালতে সময়মতো মামলার ফাইল আসে না। আবার অনেক সময় মামলার ফাইল কিছু কিছু কর্মচারী সরিয়ে রাখেন।’
চট্টগ্রাম সিএমএম আদালতের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘মামলার নথিপত্র থাকে সেরেস্তায়। পুরনো নথি ধ্বংস বা বিক্রি করতে হলে যথাযথ আইনী প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। কিছু দিন আগেই তো আদালতের বারান্দা থেকে প্রায় দুই মামলার নথি (কেস ডকেট) ‘গায়েব’ হয়। মামলার নথিপত্র সেরেস্তা বা পিপির দপ্তরে না রেখে বারান্দা কিংবা ছাদে কেন প্রশ্ন– আদালতের এই কর্মকর্তার।
জানা গেছে, খোলা আকাশের নিচে অযত্নে ফেলে রাখা নথিপত্রের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ এবং চাঞ্চল্যকর মামলার কাগজপত্রও থাকতে পারে। কারণ মামলার মূল সূত্র নানা তথ্য, নথি। বিচারপ্রার্থী কিংবা আসামিরদের কাছে যার মূল্য অসীম। অথচ চট্টগ্রাম আদালতের প্রশাসনিক শাখার কর্মকর্তারা এসব বিষয় এড়িয়ে যাচ্ছেন। জেলা ও দায়রা জজ আদালতের প্রশাসনিক শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আত্মহত্যার ঘটনায় থানায় অপমৃত্যুর মামলা রেকর্ড হয়। কিন্তু ভিকটিম কি আত্মহত্যা করেছিলেন? না কি খুন হয়েছিলেন, ফাইল মিসিং হলে সেই দন্দ্ব থেকেই যায়।’
ছাদে নথি পড়ে থাকার বিষয়ে জানতে বুধবার (১৫ জানুয়ারি) দুপুরে একাধিকবার কল করলেও মোবাইল ফোন রিসিভ করেননি জেলা ও দায়রা জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত নাজির মো. গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী। পরে হোয়াটসঅ্যাপে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও সাড়া দেননি তিনি। একই বিষয়ে একাধিকবার কল করা হলেও মোবাইল ফোন রিসিভ করেননি নগর পুলিশের প্রসিকিউশন শাখার উপ-কমিশনার হুমায়ুন কবীর এবং অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মফিজ উদ্দীন।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম আদালতের ১ হাজার ৯১১টি মামলার নথি (কেস ডকেট বা সিডি) গায়েব হওয়ার ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ৫ জানুয়ারি নগরের কোতোয়ালি থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মফিজুল হক ভূঁইয়া। আদালত থেকে ‘গায়েব’ হওয়া মামলার সেসব নথি গত ৯ জানুয়ারি নগরের কোতোয়ালি থানার পাথরঘাটা সতীশ বাবু লেইনের ভাঙ্গারির দোকান থেকে ‘গায়েব’ হওয়া ৯ বস্তা নথি উদ্ধার করে পুলিশ।
এ ঘটনায় মো. রাসেল (২৩) নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়। এসব নথি চুরি করে ভাঙ্গারির দোকানে ১৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হয়েছে বলে জানান কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল করিম।