Image description

চেষ্টা শুরু হয়েছিল আড়াই বছর আগে। বিতর্কে আটকে থাকার পর অবশেষে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের সেই চাওয়া পূরণ হতে যাচ্ছে। প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই এনসিটিবির পরিবর্তে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমে মুদ্রণ ও বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) আইন সংশোধন করে এমন ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে। চলতি মাসের গোড়ায় আইনের খসড়া প্রণয়ন করে সে বিষয়ে মতামত চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে এনসিটিবি প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষাক্রম প্রণয়ন, মুদ্রণ, প্রকাশনা, বিতরণ ও বিপণনের দায়িত্ব পালন করে আসছে। এর মধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে বছরের শুরুতে বিনা মূল্যে বই বিতরণও করা হয়। এনসিটিবির বিরুদ্ধে অভিযোগ—প্রায় বছরই সময়মতো বই সরবরাহে ব্যর্থতা, মান নিয়ে প্রশ্ন এবং কাজের সমন্বয়হীনতা। এসব কারণ দেখিয়ে ২০২২ সাল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ আলাদাভাবে বই ছাপার চেষ্টা চালিয়ে আসছিল। এখন সেই চেষ্টা বাস্তব রূপ পাচ্ছে।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) আইন সংশোধন করে এমন ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে। চলতি মাসের গোড়ায় আইনের খসড়া প্রণয়ন করে সে বিষয়ে মতামত চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

তবে এনসিটিবির কর্মকর্তাদের বক্তব্য ভিন্ন। তাঁদের আশঙ্কা, আলাদাভাবে বই ছাপার উদ্যোগে সংকট ও সমন্বয়হীনতা আরও বাড়তে পারে। তাঁরা মনে করেন, শুধু এনসিটিবির ব্যর্থতার কারণে নয়, মন্ত্রণালয় পর্যায়ের সিদ্ধান্তের কারণেও পাঠ্যবই বিতরণে জটিলতা তৈরি হয়। চলতি শিক্ষাবর্ষেই তার উদাহরণ মিলেছে—শেষ মুহূর্তে শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের সিদ্ধান্তে বই সরবরাহে তিন মাস দেরি হয়। আসন্ন নতুন শিক্ষাবর্ষের শুরুতে বিনা মূল্যে শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনাও হোঁচট খেতে যাচ্ছে সরকারি পর্যায়ের একটি সিদ্ধান্তের কারণে। নভেম্বরের মধ্যে সব বই ছাপিয়ে মাঠপর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে দরপত্রের কাজও প্রায় শেষ করেছিল এনসিটিবি। কিন্তু শেষ সময়ে এসে সরকার মাধ্যমিকের তিন শ্রেণির (ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম) পাঠ্যবইয়ের দরপত্র বাতিল করায় পুরো পরিকল্পনাই অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। এখন আবার দরপত্র দিয়ে এই তিন শ্রেণির পাঠ্যবই ছাপানো হবে। এর ফলে জানুয়ারিতে সব শিক্ষার্থীর হাতে সব বই পৌঁছানো সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

এনসিটিবির কর্মকর্তারা আরও বলেন, মাঝেমধ্যে মুদ্রণকাজে গাফিলতি ও অনিয়মের অভিযোগ সত্য হলেও তা ব্যক্তিকেন্দ্রিক। ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। কিন্তু প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করে একই ধরনের কাজ আলাদাভাবে করার পেছনে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রবণতা কাজ করছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা অবশ্য প্রথম আলোকে বলেন, শুরুর দিকে কিছু অসুবিধা হতে পারে, পরে সব ঠিক হয়ে যাবে।

এনসিটিবির বিরুদ্ধে অভিযোগ—প্রায় বছরই সময়মতো বই সরবরাহে ব্যর্থতা, মান নিয়ে প্রশ্ন এবং কাজের সমন্বয়হীনতা। এসব কারণ দেখিয়ে ২০২২ সাল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ আলাদাভাবে বই ছাপার চেষ্টা চালিয়ে আসছিল। এখন সেই চেষ্টা বাস্তব রূপ পাচ্ছে।

এনসিটিবির ইতিহাস

দেশভাগের পর ১৯৪৭ সালে গঠিত হয় ‘পূর্ববঙ্গ স্কুল টেক্সটবুক কমিটি’। পরে ১৯৫৪ সালে আইন পাস করে স্কুল টেক্সটবুক বোর্ড গঠন করা হয়। ১৯৮৩ সালে স্কুল টেক্সটবুক বোর্ড ও জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন কেন্দ্রকে একীভূত করে বর্তমান এনসিটিবি করা হয়। ২০১৮ সালে নতুন আইন পাস হয়।

২০১০ সাল থেকে বছরের শুরুতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের হাতে বিনা মূল্যে বই বিতরণ করছে সরকার।

এনসিটিবিকে শক্তিশালী না করে একে ভেঙে ফেললে শিক্ষার সামগ্রিক ক্ষেত্রেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য।
তারিক মনজুর, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কী আছে প্রস্তাবিত আইনে

‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড আইন, ২০১৮’ খসড়ার প্রস্তাবিত সংশোধনীতে বলা হয়েছে, এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) এবং প্রাথমিক শিক্ষাক্রম শাখার কর্মকর্তারা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ—ময়মনসিংহে অবস্থিত) থেকে প্রেষণে নিয়োগ পাবেন। আর প্রাক্‌-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তকের মুদ্রণ, প্রকাশনা ও বিতরণ করবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। বর্তমানে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা এনসিটিবির বিভিন্ন পদে প্রেষণে কাজ করেন।

বর্তমান আইনে শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ হন শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউট বা শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজের শিক্ষকেরা। প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউট, শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ কিংবা জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমির কর্মকর্তারা শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করবেন। এ ছাড়া এনসিটিবিতে বর্তমান সচিবের পদের জায়গায় পরিচালক পদ রাখার প্রস্তাবও এসেছে সংশোধনীতে।

নতুন আইন অনুমোদন পেলে ২০২৭ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপার দায়িত্ব নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরিবর্তিত হতে পারে। তখন এনসিটিবি কেবল মাধ্যমিকের বিনা মূল্যের বই ছাপা ও বিতরণের কাজটি করবে। এ ছাড়া শিক্ষাক্রম প্রণয়নের কাজটিও করবে সংস্থাটি।

নতুন আইন অনুমোদন পেলে ২০২৭ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই ছাপার দায়িত্ব নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরিবর্তিত হতে পারে। তখন এনসিটিবি কেবল মাধ্যমিকের বিনা মূল্যের বই ছাপা ও বিতরণের কাজটি করবে। এ ছাড়া শিক্ষাক্রম প্রণয়নের কাজটিও করবে সংস্থাটি।

অবশ্য আগামী শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই এনসিটিবির মাধ্যমেই ছাপা হচ্ছে। আগামী বছর বিনা মূল্যে বিতরণের জন্য প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই প্রয়োজন হবে প্রায় ৮ কোটি ৪৯ লাখ ২৫ হাজার এবং মাধ্যমিক স্তরের প্রায় ২১ কোটি ৪০ লাখ।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব রেহানা পারভীনের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে চেষ্টা করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেছেন, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় চাইছে তাদের অধিদপ্তরের মাধ্যমে বই ছাপতে। যেহেতু এই ছাপা নিয়ে মাঝেমধ্যেই অভিযোগ ওঠে, তাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকেরা চাইছেন ‘ঝামেলার দায়িত্ব’ না রাখতে।

অবশ্য আগামী শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই এনসিটিবির মাধ্যমেই ছাপা হচ্ছে। আগামী বছর বিনা মূল্যে বিতরণের জন্য প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই প্রয়োজন হবে প্রায় ৮ কোটি ৪৯ লাখ ২৫ হাজার এবং মাধ্যমিক স্তরের প্রায় ২১ কোটি ৪০ লাখ।

সম্পূর্ণ ‘বাজে’ উদ্যোগ

এই উদ্যোগকে সম্পূর্ণভাবে ‘বাজে’ বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তারিক মনজুর। এনসিটিবির পাঠ্যবই প্রণয়ন-সংক্রান্ত বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত এই শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, এনসিটিবিকে শক্তিশালী না করে একে ভেঙে ফেললে শিক্ষার সামগ্রিক ক্ষেত্রেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য। এনসিটিবির একটি পূর্ণ সাংগঠনিক কাঠামো রয়েছে, যে কাঠামোর অধীনে পাঠ্যপুস্তক লেখা, ছাপানো ও বিতরণের কাজ করা হয়। এর বাইরেও শিক্ষাক্রম প্রণয়ন, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, বইয়ের মান যাচাই—এসব কাজও করা হয়। মানতে দ্বিধা নেই, সব ক্ষেত্রেই সংকট আছে। তিনি মনে করেন, প্রতিষ্ঠানের (এনসিটিবি) সক্ষমতা বাড়িয়ে এসব সংকট দূর করা জটিল কোনো বিষয় নয়।

অধ্যাপক তারিক মনজুর আরও বলেন, দেখে মনে হচ্ছে না বর্তমান উদ্যোগ সংকট কাটানোর জন্য নেওয়া হচ্ছে; বরং এই সিদ্ধান্তের পেছনে প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্বই প্রধান হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। তা ছাড়া দুঃখজনক ব্যাপার, একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও উচ্চমহল থেকে সব সময় এনসিটিবিকে প্রভাবিত করা হয়েছে।