Image description
নির্বাচনী ফল : বিস্ময় না বাস্তবতা?
সাম্প্রতিক ডাকসু ও জাকসু নির্বাচন নিয়ে শিক্ষাঙ্গন ও রাজনৈতিক পরিসরে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। সাদা চোখে নির্বাচন স্বাভাবিকভাবে সম্পন্ন হলেও এর ফলাফল ছিল বিস্ময়কর। ইসলামী ছাত্রশিবির–সমর্থিত জোট দুই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেছে। বিপরীতে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল—যারা ক্যাম্পাস রাজনীতিতে বহুদিন ধরে বড় স্বপ্ন দেখছিল—তারা একেবারেই ব্যর্থ হয়েছে।
প্রশ্ন উঠছে—কেন এমন হলো?
শিবিরের সাংগঠনিক শক্তি।শিবিরের বিজয়কে শুধু কাকতালীয় বলা যাবে না। এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের সংগঠিত চর্চা ও পরিকল্পিত কার্যক্রম।
শিবির–সমর্থিত ছাত্রজোটের বিজয়ের পেছনের মূল কারণসমূহের বিশ্লেষণ
১. সাংগঠনিক দক্ষতা ও ঐক্যবদ্ধতা
– যেকোনো রাজনৈতিক লড়াইয়ে টিকে থাকার সবচেয়ে বড় মূলধন হলো সংগঠন। শিবির সমর্থিত ছাত্রজোট দীর্ঘদিন ধরে শৃঙ্খলাবদ্ধ সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। ফলে তাদের সিদ্ধান্ত দ্রুত মাঠপর্যায়ে পৌঁছেছে এবং সবাই একই সুরে কাজ করেছে।
২. রাজনৈতিক সচেতনতা ও সাধারণ ছাত্রদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক
– তারা শুধুমাত্র রাজনৈতিক কর্মী তৈরি করেনি; বরং সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মেলামেশা করে আস্থা অর্জন করেছে। ছাত্রদের দৈনন্দিন সমস্যা, ক্যাম্পাস ইস্যু, এমনকি ক্যারিয়ার সংক্রান্ত পরামর্শেও পাশে দাঁড়িয়েছে। এতে ভোটের দিন সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতি আস্থা রেখেছে।
৩. জুলাই বিপ্লব–পরবর্তী বাস্তবতা অনুধাবনে দক্ষতা
– ক্যাম্পাস রাজনীতিতে জুলাই বিপ্লব একটি বড় মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। শিবিরপন্থীরা সেই পরিবর্তিত বাস্তবতা দ্রুত বিশ্লেষণ করে নিজেদের কৌশল নির্ধারণ করেছে। এতে তারা সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়ে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে গেছে।
৪. জুলাই বিপ্লবের স্টেকহোল্ডার হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা
– তারা নিজেদেরকে কেবল দর্শক হিসেবে নয়, বরং সেই আন্দোলনের অংশীদার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। এতে করে তারা আন্দোলনের প্রাকৃতিক উত্তরসূরি হিসেবে শিক্ষার্থীদের চোখে বৈধতা পেয়েছে।
৫. জামাতের পূর্ণ রাজনৈতিক সমর্থন, আর্থিক সহযোগিতা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়তা
– যেকোনো ছাত্রসংগঠনের টিকে থাকার জন্য একটি মাতৃদলের শক্তিশালী সমর্থন অপরিহার্য। জামাত এই ক্ষেত্রে আর্থিক, কৌশলগত এবং জনবলগত তিন দিকেই অব্যাহত সহায়তা প্রদান করেছে।
৬. সোশ্যাল মিডিয়ায় সুসংগঠিত ও প্রশিক্ষিত কর্মী বাহিনী
– বর্তমান প্রজন্ম সোশ্যাল মিডিয়ামুখী। শিবিরপন্থীরা এটি বোঝে এবং একটি শক্তিশালী অনলাইন স্কোয়াড গড়ে তোলে। এরা শুধু রাজনৈতিক প্রচারণাই নয়, বরং বুদ্ধিবৃত্তিক উপস্থাপনার মাধ্যমে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে।
৭. পরিচয় আড়াল রেখে বিভিন্ন আর্থিক, শিক্ষা ও পেশাজীবী সংগঠনে প্রভাব বিস্তার
– সরাসরি পরিচয় প্রকাশ না করে তারা ভিন্ন ভিন্ন খাতের ভেতরে কর্মী স্থাপন করেছে। এতে দীর্ঘমেয়াদে তারা সমাজের প্রায় প্রতিটি স্তরে নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে।
৮. যোগ্যতার ভিত্তিতে স্কুল–কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয় ও কর্মক্ষেত্রে সুযোগ সৃষ্টি
– সংগঠন তাদের কর্মীদের জন্য ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছে। শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে সুযোগ দিয়ে তারা শুধু রাজনৈতিক নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবেও নিজেদের ভিত্তি শক্ত করেছে।
৯. রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত কর্মী পরিবারের পাশে দাঁড়ানো
– যে কোনো রাজনৈতিক সংগ্রামে কর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। শিবিরপন্থীরা এই পরিবারগুলোর পাশে আর্থিক ও সামাজিকভাবে দাঁড়িয়ে সংগঠনের প্রতি এক ধরনের অটল আনুগত্য তৈরি করেছে।
১০. শিক্ষা, ক্যারিয়ার ও রাজনৈতিক সচেতনতায় পারস্পরিক সহযোগিতা
– তাদের সংগঠনের ভেতরে কর্মীরা একে অপরকে পড়াশোনা, চাকরি ও গবেষণায় সহযোগিতা করে। এর ফলে প্রতিযোগিতা থাকলেও তা বন্ধুত্বপূর্ণ রূপ পেয়েছে।
১১. ব্যক্তি বা গ্রুপিং নয়, সাংগঠনিক আদেশের প্রতি আনুগত্য
– নেতৃত্ব পরিবর্তন বা সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের মধ্যে বিভক্তি নেই বললেই চলে। তারা ব্যক্তিনির্ভর রাজনীতি নয়, সংগঠননির্ভর রাজনীতি করে।
১২. যোগ্যতার ভিত্তিতে ধারাবাহিক নেতৃত্ব তৈরি।
– ত্যাগী ও মেধাবী কর্মীদেরই নেতৃত্বে আনা হয়। এতে সাধারণ কর্মীরা আশাবাদী হয় যে তারাও একদিন যোগ্যতার ভিত্তিতে নেতৃত্বে আসতে পারবে।
১৩. নিয়মিত নেতৃত্ব হস্তান্তর ও মেয়াদকাল ভিত্তিক পরিবর্তন
– নেতৃত্বকে দীর্ঘদিন আঁকড়ে না ধরে নির্দিষ্ট সময় শেষে নতুন নেতৃত্ব তৈরি করার সংস্কৃতি তারা চর্চা করে। এর ফলে প্রতিনিয়ত নতুন প্রজন্ম নেতৃত্বে আসার সুযোগ পায়।
এই ধারাবাহিক প্রক্রিয়াই শিবিরকে এক অদৃশ্য শক্তিতে রূপান্তর করেছে, যা নির্বাচনে ফলাফল দিয়েছে।
---জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ব্যর্থতার কারণসমূহ : একটি বিশ্লেষণ
১. নেতৃত্ব সাধারণ কর্মীর নাগালের বাইরে (Unreachable Leadership)
– আমাদের নেতৃত্ব সাধারণ কর্মীদের কাছে পৌঁছায় না। তারা কর্মীদের কথা শোনে না, তাদের সমস্যার অংশীদার হয় না। বরং বেশিরভাগ সময় কেটে যায় ক্ষমতা প্রদর্শন আর নিজেদের অবস্থান আঁকড়ে ধরার প্রতিযোগিতায়। ফলে মাঠপর্যায়ের কর্মীরা নিজেকে অবহেলিত মনে করে।
২. মমতাহীন রাজনীতি
– সংগঠনের ভেতরে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, স্নেহ ও সহমর্মিতার সংস্কৃতি নেই। শিবির যেখানে ক্ষতিগ্রস্ত কর্মীর পরিবারের পাশে দাঁড়ায়, আমরা সেখানে প্রায়শই নিজেদের মানুষদের ভুলে যাই। এর ফলে কর্মীদের ভেতরে আনুগত্য দুর্বল হয়ে পড়ে।
৩. দলীয় বিভক্তি ও গ্রুপিং
– আমাদের সংগঠন ব্যক্তি–কেন্দ্রিক ও গ্রুপ–কেন্দ্রিক রাজনীতির শিকার। কে কোন সিনিয়রের ঘনিষ্ঠ, কে কোন গ্রুপে—এসব দিয়ে মূল্যায়ন করা হয়, যোগ্যতা দিয়ে নয়। এতে মেধাবী ও ত্যাগী কর্মীরা নিরুৎসাহিত হয়।
৪. যোগ্যতার ভিত্তিতে নেতৃত্ব নির্বাচন না করা
– ত্যাগী বা মাঠপর্যায়ে সক্রিয় কর্মীরা প্রায়শই নেতৃত্বে সুযোগ পায় না। নেতৃত্ব বাছাই হয় সুপারিশ, সম্পর্ক বা প্রভাব–বলয়ের ভিত্তিতে। এতে নেতৃত্বে ধারাবাহিকতা ও দক্ষতা তৈরি হয় না।
৫. সংগঠনের মধ্যে শিক্ষা ও ক্যারিয়ারভিত্তিক সহযোগিতার ঘাটতি
– শিবির যেখানে একে অপরকে পড়াশোনা, গবেষণা ও ক্যারিয়ারে সাহায্য করে, আমরা সেখানে প্রায়শই রাজনৈতিক কর্মীকে কেবল মিছিল–মিটিংয়ে ব্যবহার করি। এতে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক গড়ে ওঠে না।
৬. সাংগঠনিক শৃঙ্খলার অভাব
– আমাদের কর্মীরা প্রায়শই সাংগঠনিক আদেশের চেয়ে ব্যক্তিগত আনুগত্যে বেশি জড়িত থাকে। ফলে নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত মাঠপর্যায়ে পৌঁছাতে সময় লাগে এবং বাস্তবায়ন হয় অর্ধেক–অপূর্ণভাবে।
৭. নিয়মিত নেতৃত্ব হস্তান্তরের সংস্কৃতি নেই
– একই ব্যক্তি বা গ্রুপ অনেক দিন ধরে নেতৃত্ব আঁকড়ে থাকে। এতে নতুন কর্মীরা নেতৃত্বে ওঠার সুযোগ পায় না, ফলে নেতৃত্ব বিকাশের ধারাবাহিকতা ভেঙে যায়।
৮. সোশ্যাল মিডিয়ায় দুর্বলতা
– নতুন প্রজন্মের ছাত্ররাজনীতিতে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম বড় শক্তি। কিন্তু আমরা এখানে যথেষ্ট সক্রিয় নই, তাছাড়া অনেক সময় অগোছালো ও প্রতিরক্ষামূলক ভঙ্গিতে নিজেদের প্রকাশ করি।
৯. রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত কর্মীদের পাশে না দাঁড়ানো
– গ্রেফতার, বহিষ্কার, হামলা বা মামলা–মোকদ্দমার শিকার কর্মীদের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা দুর্বল। এতে কর্মীরা হতাশ হয় এবং পরিবারগুলো দূরে সরে যায়।
১০. দূরদর্শী পরিকল্পনার অভাব
– আমরা প্রায়শই তাত্ক্ষণিক ইস্যুতে প্রতিক্রিয়া জানাই, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি কৌশল তৈরি করি না। ফলে হঠাৎ নির্বাচনের মতো বড় লড়াইয়ে আমাদের প্রস্তুতি অসম্পূর্ণ থাকে।
ফলে তারা ক্যাম্পাসে দাঁড়াতে পারেনি, বরং অতীত শক্তির স্মৃতিতে আচ্ছন্ন থেকেছে।
সূক্ষ্ম প্রশ্ন : এত ভোট কি সত্যিই শিবিরের জন্য?
এত বিশ্লেষণের পরও আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস একটাই—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা বাস্তবে এত বিপুল পরিমাণ ভোট শিবিরকে দিয়েছে—এটা পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য মনে হয় না।
বরং ধারণা করা যায়, সূক্ষ্ম কারচুপির মাধ্যমে তারা ফলাফল নিজেদের পক্ষে টেনে নিয়েছে। সবচেয়ে দক্ষতার সাথে সেই কারচুপিকে তারা মিডিয়ার আড়ালে ঢেকে ফেলেছে। আর এখানেই অন্যান্য ছাত্রসংগঠন, বিশেষত ছাত্রদল, ব্যর্থ হয়েছে।
উপসংহার : শিক্ষা কী?
শিবিরের সাংগঠনিক শক্তি অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু তাদের বিজয়ের মাত্রা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের জন্য শিক্ষা হলো—
১. সংগঠনকে পুনর্গঠন করতে হবে।
২. নেতৃত্বকে সাধারণ কর্মীর নাগালের মধ্যে আনতে হবে।
৩. সোশ্যাল মিডিয়ায় শক্তিশালী উপস্থিতি গড়তে হবে।
৪. প্রতিদ্বন্দ্বীর সূক্ষ্ম কারচুপিকে প্রতিহত করার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।
অন্যথায় আগামী দিনেও ছাত্রদল কেবল ব্যর্থতার প্রতীক হিসেবেই বিবেচিত হবে।

 

খন্দকার মশিউর রহমান সজীব