Image description
 

শেখ হাসিনার টানা ১৫ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার অবৈধভাবে পাচার হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছে যুক্তরাজ্যের খ্যাতনামা গণমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমস (এফটি)। বুধবার (১০ সেপ্টেম্বর) প্রকাশিত এফটির প্রামাণ্যচিত্র ‘Bangladesh’s Missing Billions, Stolen in Plain Sight’-এ এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

প্রামাণ্যচিত্রে বলা হয়, বিদেশে পাচার হওয়া টাকার অন্যতম প্রধান গন্তব্য ছিল লন্ডন। সেখানে এই পাচারকৃত অর্থের বড় অংশ বিনিয়োগ হয়েছে সম্পত্তি কেনাবেচার মাধ্যমে। এ কাজে ব্যবহার করা হয়েছে ওভার-ইনভয়েসিং ও আন্ডার-ইনভয়েসিং, হুন্ডি প্রক্রিয়া এবং বিদেশে সম্পদ কেনার নানা চ্যানেল।

শুরুতেই তুলে ধরা হয় শেখ হাসিনার নাটকীয় পতনের প্রেক্ষাপট। দেখানো হয় জুলাই মাসে হওয়া ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান এবং তার পেছনের ক্ষোভের কারণ। সেখানে অংশ নেন ছাত্রনেতা রাফিয়া রেহনুমা হৃদি ও রেজওয়ান আহমেদ রিফাদ। পাশাপাশি বিশ্লেষণ তুলে ধরেন ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের দক্ষিণ এশিয়া ব্যুরো প্রধান জন রিড, পণ্যবাজার প্রতিবেদক সুসানাহ সাভেজ, স্পটলাইট অন করাপশনের উপপরিচালক হেলেন টেইলর এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্ট রিপোর্টার রাফে উদ্দিন।

 

প্রামাণ্যচিত্রে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার পরিবারের বিরুদ্ধে বিদেশে সম্পদ কেনা ও অর্থ পাচারের অভিযোগ উল্লেখ করা হয়েছে। লন্ডনে তাদের বিভিন্ন অফশোর অ্যাকাউন্টের কথাও উঠে এসেছে। এমনকি যুক্তরাজ্যের সংসদ সদস্য ও শেখ হাসিনার ভাইঝি টিউলিপ সিদ্দিককেও ঘিরে প্রশ্ন উঠেছে। তিনি অবশ্য সব অভিযোগ অস্বীকার করে দাবি করেছেন, এসব ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’।

 
 

এ ছাড়া প্রাক্তন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী এবং এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলমের নামও এসেছে অর্থ বিদেশে সরিয়ে নেওয়ার অভিযোগে।

 

ফিনান্সিয়াল টাইমসের দক্ষিণ এশিয়া ব্যুরো প্রধান জন রিড জানান, হাসিনা আমলে বাংলাদেশে বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালকরা অনেক সময় অস্ত্রের মুখে পড়ে জোর করে পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। তাদের শেয়ারও হস্তান্তর করতে হয়েছে প্রভাবশালী মহলের কাছে। এ ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই-এর ভূমিকার কথাও উল্লেখ করা হয়।

লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক মুশতাক খান বলেন, হাসিনা আমলে দুর্নীতি ছিল প্রকাশ্য বিষয়। তিনি জানান, অনেকেই কারাগারে আটক ছিলেন, যেটি পরিচিত ছিল ‘আয়নাঘর’ নামে—যেখানে বন্দিদের বাহিরের দুনিয়া থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন রাখা হতো।

এফটির প্রতিবেদক সুসানাহ সাভেজ বলেন, ‘আমরা হয়তো ভাবতে চাই দুর্নীতি কেবল দূরের কোনো দেশের সমস্যা। কিন্তু আসলে এটি বৈশ্বিক সংকট, আর যুক্তরাজ্যও সেই সমস্যার কেন্দ্রে রয়েছে।’

তিনি সতর্ক করেন, টাকা চুরি হয়েছে তা জানা এক বিষয়, কিন্তু ফেরত আনা সম্পূর্ণ ভিন্ন ও জটিল প্রক্রিয়া। কারণ এখানে অনেক সময় সমঝোতা করতে হয়—যেটি জনমতের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে কি না, সেটিও বড় প্রশ্ন।

পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্পদ পুনরুদ্ধার টাস্কফোর্সের উপদেষ্টা ইফতি ইসলাম বলেন, ‘এটি ইতিহাসের অন্যতম জটিল প্রক্রিয়া।’

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকেও প্রামাণ্যচিত্রে দেখা যায়। তিনি বলেন, ‘সবটা হয়তো ফেরত পাওয়া যাবে না। তবে যা সম্ভব, সেটিই ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। কংক্রিট প্রমাণ খুঁজে বের করতে হবে, পথ অনুসরণ করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট সরকারের সহায়তা নিতে হবে।’

তিনি উল্লেখ করেন, ‘২৩৪ বিলিয়ন ডলার লুটপাট সম্ভবত বিশ্বের ইতিহাসে একক কোনো দেশের সবচেয়ে বড় অর্থ পাচারের ঘটনা।’

প্রামাণ্যচিত্রে বলা হয়, বাংলাদেশে বিপ্লব হয়তো বড় এক মোড় ঘুরিয়েছে। তবে আশঙ্কা রয়েছে, আবারও কোনো গোষ্ঠী অতিরিক্ত ক্ষমতার দখল নিতে পারে।

শেষ অংশে ছাত্রনেত্রী রাফিয়া রেহনুমা হৃদির কণ্ঠে শোনা যায় গভীর উদ্বেগ। তাকে বলতে শোনা যায়— ‘আমাদের সবচেয়ে বড় ভয় হলো, আমরা হয়তো আমাদের শহীদদের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারব না।’