Image description

কাগজে-কলমে দেশে বর্তমানে সাক্ষরতার হার ৭৮ শতাংশ। কিন্তু বাস্তবতার সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। খোদ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দারের ভাষ্য, ‘দেশে প্রকৃত সাক্ষরতার হার ৫০ শতাংশেরও নিচে। নিরক্ষর জাতি দিয়ে আমরা উন্নতি করতে পারবো না।’

অথচ এরই মধ্যে আবার বদলে গেছে সাক্ষরতার সংজ্ঞা। নতুন সংজ্ঞায় একজন মানুষ কেবল সই করতে পারলেই সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন বলে বিবেচিত হবে না। সাক্ষরতা অর্জনের জন্য এখন দরকার যোগ-বিয়োগসহ সাধারণ ও প্রযুক্তিগত কিছু জ্ঞান।

বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উৎকর্ষতার যুগে সাক্ষরতার হার নিয়ে এমন ‘দুরবস্থা’র মধ্যেই আজ সোমবার (৮ সেপ্টেম্বর) পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা (ইউনেসকো) নির্ধারিত এ বছর সাক্ষরতা দিবসের প্রতিপাদ্য—‘প্রযুক্তির যুগে সাক্ষরতার প্রসার’।

বছরে ২ শতাংশ সাক্ষরতার হার বাড়িয়ে দেখানো হতো!
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশে সাক্ষরতার হার তরতর করে বাড়তে থাকে। প্রতিবছর দিবসটি ঘিরে যে পরিসংখ্যান প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হতো, তা ‘সঠিক ছিল না’ বলে মনে করেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী।

 

তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন কারণ ছাড়াই বছরে দুই শতাংশ করে সাক্ষরতার হার বাড়াতেন। পরিসংখ্যান ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। এর সঙ্গে বাস্তবতার একেবারেই মিল নেই।’

jagonews24

বাংলাদেশে সাক্ষরতা হার অর্জন যেভাবে
বাংলাদেশের সাক্ষরতা অর্জন করা হয় দুই পদ্ধতিতে। একটি হচ্ছে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা, যারা প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত যারা পড়ালেখা করে তারা সাক্ষরতা জ্ঞান অর্জন করে।

 

অন্যদিকে রয়েছে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম। যারা প্রতিদিন স্কুলে যেতে পারছে না, তাদের জন্য বয়স্ক সাক্ষরতা কার্যক্রম ও শিশুদের জন্য দ্বিতীয় ধাপের শিক্ষা কার্যক্রম। দেশে দীর্ঘদিন ধরে বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম ও শিশুদের জন্য এ ধরনের সুযোগ কম থাকায় এখনো অনেক মানুষ নিরক্ষর রয়ে গেছে।

প্রকল্প নেওয়া হলেও কাজে আসে না
দেশে নিরক্ষরতা দূর করতে বিভিন্ন সময়ের সরকার নানা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু উল্লেখযোগ্য কোনো প্রকল্প নেওয়া হয়নি। এর আগে বেসিক লিটারেসি প্রোগ্রাম (বিএলপি) চালু ছিল স্বল্প পরিসরে।

কিন্তু এ ধরনের প্রোগ্রাম চালু করার পর লিটারেসি স্কিল ধরে রাখতে কমিউনিটি লার্নিং সেন্টার গড়ে তুলতে হয়। এ বিষয়ে ৫ হাজার লার্নিং কমিউনিটি সেন্টার গড়ে তোলার কথা ছিল। তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

আগে সাক্ষরতার নির্ণায়ক ছিল লেখা ও পড়ার দক্ষতা। কিন্তু সমসাময়িক সময়ে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বুঝতে পারার ক্ষমতা। যে কারণে সরকারের সাক্ষরজ্ঞান পরিসংখ্যানের সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। নতুন সংজ্ঞা ধরে জরিপ করলে সাক্ষরতার এ হার ৫০ শতাংশেরও নিচে নেমে যেতে পারে।—রাশেদা কে চৌধূরী

সাক্ষরতা নিয়ে কাজ করা সরকারি প্রতিষ্ঠান উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী—দেশের ৬৪ জেলার ২৪৮টি উপজেলার ১৫-৪৫ বছর বয়সী সাড়ে ৪৪ লাখ জনগোষ্ঠীকে মৌলিক সাক্ষরতার আওতায় আনা হয়েছে। আর ১৪-১৮ বছর বয়সী যারা বিদ্যালয়ে যায়নি—এমন কিশোর-কিশোরীদের জন্য একটি পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। তবে এ পরিসংখ্যানের সঙ্গে বাস্তবতার মিল তেমন পাওয়া যায় না।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের প্রধান নির্বাহী রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘যতটুকু আমাদের রয়েছে, সেটি হলো আনুষ্ঠানিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার ফল। এছাড়াও সরকার থেকে বিদেশি দাতা সংস্থার অর্থায়নে বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়া হলেও সেটি আর নিয়মিতকরণ হয় না। ফলে বয়স্ক মানুষ সাক্ষরতা জ্ঞান অর্জন করলেও সময়ের সঙ্গে ভুলে যায়।’

তিনি বলেন, ‘আগে সাক্ষরতার নির্ণায়ক ছিল লেখা ও পড়ার দক্ষতা। কিন্তু সমসাময়িক সময়ে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বুঝতে পারার ক্ষমতা। যে কারণে সরকারের সাক্ষরজ্ঞান পরিসংখ্যানের সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। নতুন সংজ্ঞা ধরে জরিপ করলে সাক্ষরতার এ হার ৫০ শতাংশেরও নিচে নেমে যেতে পারে।’

সাক্ষরতার অভাবে পদে পদে ঠকছে মানুষ
শুধু অক্ষরজ্ঞান না থাকায় অনেক পেশাজীবী আজও ঘুষ ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন। সম্প্রতি ঢাকার বিআরটিএ অফিসে ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষার জন্য গিয়েছিলেন আজিজুর রহমান। তার বাড়ি ভোলার লালমোহন।

তিনি জাগো নিউজকে জানান, অনেক বছর ট্রাক চালান। সব পার্টসের ফাংশন বোঝেন৷ কিন্তু লেখাপড়া জানেন না। এ কারণে ড্রাইভিংয়ের লিখিত পরীক্ষায় পাস করতে পারেন না। এবার ১৪ হাজার টাকার বিনিময়ে দালাল ধরেছেন।

jagonews24

শুধু আজিজুর রহমান একা নন, প্রতিবছর অক্ষরজ্ঞানশূন্য মানুষ শ্রমিক হিসেবে দেশের বাইরে পাড়ি জমাচ্ছেন। এসব শ্রমিককে হাতে-কলমে প্রশিক্ষিত করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও অক্ষর চিনতে না পারায় হয়রানিসহ বেতন কম পাচ্ছেন।

এশিয়া সাউথ প্যাসিফিক অ্যাসোসিয়েশন ফর বেসিক অ্যান্ড এডাল্ট এডুকেশনের অ্যাডভোকেসি ডিরেক্টর কে এম এনামুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের দৃশ্যমান প্রকল্পগুলো যতটা গুরুত্ব পায়, মানবসম্পদ উন্নয়নের বিষয়টা ততটা গুরুত্ব পায় না। কারণ, এ ধরনের প্রকল্পের ফল পেতে দীর্ঘ সময় লাগে। আমাদের বাজেটের ১৫-২০ শতাংশ শিক্ষায় ব্যয় করার প্রস্তাব রয়েছে। কিন্তু এটি ১২ শতাংশের মধ্যেই রয়েছে। আর জিডিপির ক্ষেত্রে ২ শতাংশের কাছে রয়েছে, যা ৪-৬ শতাংশ দরকার।’

তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষায় বিনিয়োগের এ ঘাটতি পূরণ করতে পারলেই সাক্ষরতার হার বাড়ানো সম্ভব। সরকার যদি মনে করে আমরা ঘুরে দাঁড়াতে চাই সেটি সম্ভব। তার জন্য দরকার সদিচ্ছা ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার।

সাক্ষরতার বার্ষিক হারে সবচেয়ে বেশি এগিয়েছে আফগানিস্তান। এক বছরে তাদের এ হার ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ বেড়েছে। এরপরেই রয়েছে ভারত। তাদের সাক্ষরতা বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশের ওপরে। এছাড়া নেপালের ৩ শতাংশ, পাকিস্তানের ১ শতাংশ বেড়েছে

সাক্ষরতায় দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয় বাংলাদেশ
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সাক্ষরতার দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ। এ দিক দিয়ে প্রথম মালদ্বীপ। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী—মালদ্বীপের সাক্ষরতার হার ৯৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ। শ্রীলংকায় সাক্ষরতার হার ৯২ দশমিক ৩৮ শতাংশ এবং ভারতে ৭৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ। আর পাকিস্তানে এ হার মাত্র ৫৮ শতাংশ।

jagonews24

সাক্ষরতার বার্ষিক হারে সবচেয়ে বেশি এগিয়েছে আফগানিস্তান। এক বছরে তাদের এ হার ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ বেড়েছে। এরপরেই রয়েছে ভারত। তাদের সাক্ষরতা বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশের ওপরে। এছাড়া নেপালের ৩ শতাংশ, পাকিস্তানের ১ শতাংশ বেড়েছে।

এশিয়া সাউথ প্যাসিফিক অ্যাসোসিয়েশন ফর বেসিক অ্যান্ড এডাল্ট এডুকেশনের অ্যাডভোকেসি ডিরেক্টর কে এম এনামুল হক বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সাক্ষরতার হার এখন ৮৬ দশমিক ৬ শতাংশ। সে হিসেবে এখনো আমরা পিছিয়ে আছি। সাক্ষরতা বৃদ্ধির সঙ্গে যদি এক্ষেত্রে কারিগরি বিষয়টি যুক্ত করা হয়, তবে দেশ ব্যাপকভাবে উপকৃত হবে।’

‘কারণ দেশের অধিকাংশ শ্রমিক যারা মধ্যপ্রাচ্যে যান, তাদের বড় একটি অংশ নিরক্ষর বা যাদের কোনো কারিগরি জ্ঞান নেই। এর ফলে সেদেশে তাদের বেতন ভারতের শ্রমিকের চেয়ে অনেক কম’—যোগ করেন এনামুল হক।