অডিট অধিদপ্তরের ডিজি সোহেল আহমদ এবং প্রধান অর্থ ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবুল কালাম ২১ দিনের জন্য জার্মানির বার্লিনের বাংলাদেশ দূতাবাস অডিট করতে গিয়েছিলেন। বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোয় অডিটররা যান তাদের অনিয়ম ধরার জন্য। কিন্তু অনিয়ম না ধরে সোহেল আহমদ ও আবুল কালাম নিজেরাই নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছেন।বার্লিনে পৌঁছে তারা দুদিন ছিলেন। তারপর দূতাবাসের সরকারি গাড়ি নিয়ে ইউরোপ দর্শনে বেড়িয়ে পড়েন। সরকারি গাড়ির তেল পুড়িয়ে তারা যান সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, চেক রিপাবলিক, গ্রিস, আলবেনিয়া ও মেসিডোনিয়ায়। জার্মানির প্রদেশে প্রদেশেও ঘুরে বেড়িয়েছেন। এ সময় ৪ হাজার ৮৬ কিমি পথ পাড়ি দেন।
শুধু জ্বালানি পুড়িয়ে দূতাবাসের স্টাফ নিয়ে দেশে দেশেই ঘুরে বেড়াননি। তারা মিশনের কর্মকর্তাদের কাছে উপহার চেয়েছেন। লাঞ্চ বা ডিনার করাতে বাধ্য করেছেন। ফিরে আসার টিকিটও আদায় করেছেন। নিয়ম হলো অডিট রিপোর্টে আপত্তি উল্লেখ করে তাতে মিশনপ্রধানের স্বাক্ষর নিয়ে আসার। কিন্তু তারা আপত্তি উল্লেখ না করেই একটি তালিকা ও ফরোয়ার্ডিং চিঠি বানিয়ে দূতাবাসপ্রধানকে দিয়ে ‘সিন অ্যান্ড ডিসকাসড’ লিখিয়ে এনেছেন। ঢাকায় এসে আপত্তি জনানোর কথা বলে এসেছেন।
এসব অনিয়মের অভিযোগ কোথায় জানাবেন মিশন কর্মকর্তারা? তারা চিঠি লেখেন মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) নুরুল ইসলামের কাছে। প্রতিকার না পেয়ে তারা লেখেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমদ ও অর্থ সচিব খায়রুজ্জামান মজুমদারের কাছে। তারপরও সাড়া না পেয়ে তারা শরণাপন্ন হন তাদের পুরনো অভিবাবক মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়ার। মোশাররফ হোসেন জার্মানিতে রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তিনি মেয়াদ শেষ করেছেন। মোশাররফ হোসেন পুরনো সহকর্মীদের পাশে দাঁড়ান। তিনি অর্থ সচিবকে ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টি লিখে জানান। এবার অর্থ সচিব সাড়া দিলেন। তার নির্দেশে অর্থ মন্ত্রণালয় গত ৯ জানুয়ারি সাংবিধানিক পদ মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রককে অডিট দলের কার্যকলাপ, অনিয়ম ও অডিটের নামে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ তদন্ত করে জানাতে অনুরোধ করে।
জার্মানিতে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘যদিও এখন আমি রাষ্ট্রদূত নই। কিন্তু যে সীমাহীন নির্লজ্জ আচরণ অডিট টিম করেছে তার তদন্ত ও বিচার হওয়া উচিত। দুজন সিনিয়র অফিসার কীভাবে এ ধরনের আনঅফিশিয়াল আচরণ করতে পারেন তা সত্যি ভাবনার বিষয়। দূতাবাসের কর্মকর্তাদের বিপদগ্রস্ত করা ছাড়াও এই দুই অফিসার সরকারের গাড়ি ব্যবহার, উপহার গ্রহণ, ঘুষ দাবি করে অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস ক্যাডারের সম্মান নষ্ট করেছেন। তাদের আচরণ অস্বস্তিকর বলেই আমি এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছি। অর্থ বিভাগ অডিট ডিপার্টমেন্টের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বডি। তাই অর্থ বিভাগকে বিষয়টি জানানো হয়েছে।’এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চেয়ে বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল মো. নূরুল ইসলাম বরাবরও একটি নোট পাঠিয়েছেন সাবেক এই রাষ্ট্রদূত।
জার্মানির বাংলাদেশ মিশনের কার্যবিবরণী অনুযায়ী, অডিটররা গত ৩০ অক্টোবর বার্লিনে পৌঁছান। এরপর ৩১ অক্টোবর ও ১ নভেম্বর অফিস করেন। ২ ও ৩ নভেম্বর দূতাবাসের সরকারি গাড়ি নিয়ে বার্লিন ও পোস্টড্যাম শহর ঘুরে বেড়ান। ৪ নভেম্বর দূতাবাসে অফিস করেন। ৫ নভেম্বর ন্যুর্মেবার্গ ও মিউনিখ ঘুরে বেড়ান। ৬ নভেম্বর সুইজারল্যান্ডের জুরিখ যান। ৭ ও ৮ নভেম্বর অস্ট্রিয়ায় বিভিন্ন স্থানে যান। প্রাগ ও চেক রিপাবলিক ভ্রমণ করেন ৯ নভেম্বর। পরদিন জার্মানিতে ফিরে যান। এ সময় ৩ হাজার ৮৬ কিমি পথ পাড়ি দেন। ১১ নভেম্বর তারা অফিসে কাজ করেন। ইউরোপ গিয়েছেন, কিন্তু ঐতিহাসিক এথেন্স না ঘুরলে কী হয়! ১২ নভেম্বর যান গ্রিসের এথেন্স। ১৫ থেকে ১৭ নভেম্বর আলবেনিয়া ও মেসিডোনিয়া অবস্থান করেন। ১৮ নভেম্বর হামবুর্গ শহরে ঘুড়ে বেড়ান। ১৯ নভেম্বর জার্মানির বন ও আশপাশের শহরে ঘুরে বেড়ান। সব মিলিয়ে তারা ৪ হাজার ৮৬ কিলোমিটার রাস্তা ঘোরেন। ২০ নভেম্বর অফিস করে ২১ নভেম্বর বার্লিন থেকে শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোর ফ্লাইট ধরেন তারা।
দূতাবাসের কর্মকর্তারা সিএজির কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। সেখানে তারা বলেছেন, ডিজি সোহেল আহমদ বেপরোয়া প্রকৃতির। তিনি দূতাবাসের অফিসারদের ভয় দেখান যে, তার ভাই আর্মি অফিসার, আরেক ভাই পুলিশের বড় কর্তা। তিনি যে হাতঘড়ি পরেছেন তার দাম ৩ লাখ টাকা। সানগ্লাসের দাম দেড় লাখ টাকা।সিএজির কাছে অভিযোগ করে আরও বলা হয়, এ দুই অডিট কর্মকর্তা দূতাবাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের খুশি করতে বলেন। খুশি করলে তাদের বিরুদ্ধে আপত্তি তুলে নেবেন জানিয়ে সোহেল আহমদ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বলেন, অন্যান্য মিশনে অডিট করতে গেলে তাদের আইফোন উপহার দেওয়া হয়। ভ্রমণের জন্য হাতখরচ দেয়। তিনিও তাদের বার্লিনে তাদের হোটেল ভাড়া পরিশোধ করতে বলেন। রাষ্ট্রদূতের ফান্ড থেকে ৩ হাজার ইউরো দিতে বলেন। তারা মিশনের এক কর্মচারীর মাধ্যমে বার্লিন-কলম্বো রুটের টিকিট কাটেন। শেষ পর্যন্ত ওই কর্মচারীর ৭০০ ইউরো না দিয়ে তারা বার্লিন ছাড়েন। বার্লিন ছাড়ার সময় ফ্লাইটের টাকা দূতাবাসের অ্যাকাউন্টস থেকে সংগ্রহ করার পরামর্শ দিয়ে আসেন।
দূতাবাসের একজন কর্মকতা জানান, পাঁচ দিন অফিস করে তারা তাড়াহুড়ো করে ৫০টি অনিয়মের তালিকা করেছেন। এগুলোর সবই হয়রানিমূলক। আর হয়রানিমূলক না হলেও এগুলো নিষ্পত্তির জন্য সরকারের বিধিবিধান আছে। সেই পথে না গিয়ে তারা জোরজবরদস্তি করেছেন। তারা ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোনো অডিট রিপোর্ট মিশনে জমা দেননি। পেছনের তারিখ দিয়ে তারা মিশনপ্রধানের কাছ থেকে ‘সিন অ্যান্ড ডিসকাসড’ লিখিয়ে এনেছেন। এটিও আপত্তিকর। বার্লিন ও বিভিন্ন শহরে তাদের হোটেল ভাড়া ছাড়াও ঢাকা-কলম্বো-ঢাকা টিকিটের ৭০০ ইউরো কর্মকর্তারা কীভাবে শোধ করবেন তার পথ খুঁজছেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে সোহেল আহমদ এবং আবুল কালামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সম্ভব হয়নি। সিএজি মো. নুরুল হকের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়। শেষ পর্যন্ত মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের ডেপুটি সিএজি (সিনিয়র) মো. শরিফুল ইসলাম দেশ রূপান্তরের এই প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘অর্থ বিভাগ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। আমরা এ সপ্তাহের মধ্যেই তদন্ত কমিটি গঠন করে দেব। কমিটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও অর্থ বিভাগরে সঙ্গে সমন্বয় করে প্রতিবেদন জমা দেবে।’জনপ্রশাসনের একজন কর্মকর্তা জানান, বিদেশের মিশনগুলোয় গিয়ে অডিটরদের এ ধরনের আচরণ নতুন কিছু না। কিন্তু বিষয়টি সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। দেশের ভেতরেও অডিটররা আপত্তি উত্থাপনের চেয়ে দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করেন।