
ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পদোন্নতিবঞ্চিত ও চাকরিচ্যুত হয়েও প্রভাবশালীদের রোষানলে থেকে রক্ষা পাননি গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার ডিআইজি ড. মো. নাজমুল করিম খান। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তিনজন প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের টার্গেটে পড়ে গত সোমবার তিনি গাজীপুরের পুলিশ কমিশনার পদ থেকে ক্লোজ হন। এর বাইরেও তার ক্লোজ হওয়ার নেপথ্যে রয়েছে বিএনপির রাজনীতি সমর্থন করা। ছাত্রজীবনে তিনি ছাত্রদলের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকলেও কর্মজীবনে পেশাদার, সৎ, যোগ্য ও সাহসি কর্মকর্তা হিসেবে সর্বত্র পরিচিত বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডারের ১৫তম ব্যাচের মেধাবী এই কর্মকর্তা। গত সোমবার ১ সেপ্টেম্বর পুলিশ সদর দফতরের এক আদেশে তাকে পুলিশ সদর দফতরে রিপোর্ট করতে বলা হয়।
পতিত আওয়ামী সরকারের সময় ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সালে তাকে জোরপূর্বক অবসরে পাঠানো হয়। পরে তিনি ২৮ আগস্ট ২০২৪ চাকরিতে পুনর্বহাল হন। ১২ নভেম্বর ২০২৪ সালে জিএমপি কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পান ড. মো. নাজমুল করিম খান। গত ১ মে তিনি বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, যদিও সুনিদিষ্ট কারণ দেখিয়েই গাজীপুরের পুলিশ কমিশনারকে ক্লোজ করেছে পুলিশ সদর দফতর। তবুও এর নেপথ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি কারণ। গাজীপুর মেট্টোপলিটন পুলিশ তৈরি হওয়ার পর থেকেই পুলিশ কমিশনার ও দুজন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ঢাকার বাসায় থেকে অফিস করেন। ড. মো. নাজমুল করিম খান যেভাবে যাতায়াত করেছেন, ঠিক সেভাবেই বিগত সময়ের পুলিশ কমিশনার ও অন্য কর্মকর্তারা যাতায়াত করতেন। কিন্তু এ বিষয়টি নিয়ে এতদিন কেউ কোনো সংবাদ প্রকাশ বা পুলিশ সদর দফতরও কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। পুলিশ সদর দফতর থেকে গাজীপুরের দূরত্ব খুব বেশি নয়। তা হলে ড. মো. নাজমুল করিম খান যোগদানের নয় মাস পর কেন বিষয়টি সামনে এলো তা তদন্ত হওয়া জরুরি। পুলিশ সদর দফতর এতদিন কেন এ বিষয়ে অন্ধকারে ছিল তা সরকারের তদন্ত করা প্রয়োজন। সরকারি বাসা বরাদ্দ না থাকায় একজন পুলিশ কমিশনারের পক্ষে ব্যক্তিগতভাবে বাসা ভাড়া করে নিয়ে পরিবারসহ থাকার ক্ষেত্রে নিরাপত্তা এবং ব্যয় বহন করার বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের বিবেচনা করা অতি জরুরি ছিল।
ওই কর্মকর্তারা আরও বলেন, তিনি গাজীপুরে যোগদানের পর মব বন্ধ করা, নানা ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, যানজট নিরসন, বিশ^ ইজতেমার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং গার্মেন্টস সেক্টরে বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সফল ভূমিকা রেখেছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গিয়ে প্রভাবশালী একাধিক গ্রুপ ড. মো. নাজমুল করিম খানকে ভালোভাবে দেখছিল না। তারা তাকে গাজীপুর থেকে সরাতে নানা কৌশল গ্রহণ করে। যার প্রেক্ষিতে সংবাদ প্রকাশ এবং তার দেয়া বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে ক্লোজ করা হয়েছে। এ ঘটনার প্রেক্ষিতে মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে পুলিশ কর্মকর্তারা মন্তব্য করেন।
তারা আরও বলেন, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই কমিশনার এবং অতিরিক্ত কমিশনাররা ঢাকার বাসায় রাত্রিযাপন করতেন। দেশের সকল মেট্রো কমিশনারের নিজস্ব বাসভবন আছে। জিএমপি কমিশনার এর থাকার জন্য তার কর্মক্ষেত্রে কোনো আবাসন সুবিধা নাই। একজন পুলিশ কমিশনারের পক্ষে কোনো একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকা কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত নয়। তার নিজের নিরাপত্তা এবং একই সাথে ভবনের অন্য বাসিন্দাদের দৈনন্দিন চলাচলের অসুবিধা বিবেচনায় পুলিশ কমিশনার এর জন্য কোনো বাসা ভাড়া নেয়া হয়নি কখনোই। বাস্তব এ সমস্যা বিবেচনায় পুলিশ কমিশনারদের ঢাকায় থাকার বিষয়টি পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স সচেতনভাবেই এড়িয়ে গিয়েছে।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, জিএমপি কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর ড. মো. নাজমুল করিম খান গত বিশ^ ইজতেমা সফলভাবে সম্পন্ন করেন এবং কোনো ঘটনা ছাড়াই আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করেন। ৬ মাসে দুই হাজার ছিনতাইকারী গ্রেপ্তার, হোটেলে অবৈধ ব্যবসা বন্ধ, জুয়া বন্ধ, পোশাক খাতে অস্থিরতা সফলভাবে মোকাবিলা করা, অবৈধ মাদক ব্যবসাও বন্ধের চেষ্টা এবং জোট ব্যবসা নিয়ে বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন তিনি। সম্প্রতি বহুল আলোচিত সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন হত্যা মামলায় তার নেতৃত্বে মাত্র তিন দিনের মধ্যে নয়জন হত্যাকারীকে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে শনাক্ত ও গ্রেফতার করে পুলিশ। অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হওয়ায় সাংবাদিক সমাজসহ সাধারণ মানুষের মধ্যেও স্বস্তি ও আস্থার সঞ্চার হয়।
শুধু সাংবাদিক হত্যা নয়, অন্যান্য অপরাধ দমনেও নজির স্থাপন করেছেন তিনি। সম্প্রতি গাছা থানার অভিযানে দুর্ধর্ষ ডাকাতচক্রের ছয় সদস্যকে গ্রেফতার করে নগদ অর্থ, দেশীয় অস্ত্র ও মোটরসাইকেল উদ্ধার করে পুলিশ। একই সঙ্গে আলোচিত হানিট্র্যাপ কেলেঙ্কারিতে আহত বাদশা মিয়ার মামলার আসামিদেরও দ্রুত গ্রেফতার করে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে জিএমপি। অন্যদিকে ট্রাভেল ব্যাগে আট টুকরা লাশের রহস্য উদঘাটন করে। এসব ঘটনায় কমিশনারের কঠোর অবস্থান জনমনে স্বস্তি এনে দেয়।
সূত্র জানায়, ড. নাজমুল করিম খান বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডারের ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তা। জাপান থেকে কৃষিতে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। পুলিশের সিআইডির ফরেনসিক বিভাগে বিশেষ পুলিশ সুপার (এসপি) থাকাকালীন ২০২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন সরকার তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায়। তবে আদালতের লড়াই ও অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তে তিনি চাকরি ফিরে পান। পরে ডিআইজি পদে পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ স্টাফ কলেজে যোগদান করেন। সেখান থেকে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পান তিনি।
সোমবার আইজিপি বাহারুল আলম স্বাক্ষরিত আদেশে নাজমুল করিমকে দায়িত্ব হস্তান্তর করে মঙ্গলবার ঢাকায় পুলিশ সদর দফতরে রিপোর্ট করতে বলা হয়। আদেশে বলা হয়, গাজীপুরের পরবর্তী জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার কাছে দায়িত্ব অর্পণ করে ২ সেপ্টেম্বর (মঙ্গলবার) তাকে (নাজমুল করিম) পুলিশ সদর দফতর ঢাকায় রিপোর্ট করতে নির্দেশ দেয়া হলো।