Image description
সিআইডির অর্থপাচার মামলায় নূর আলী সিন্ডিকেটের কারো নাম নেই প্রশ্নবিদ্ধ তদন্ত নিয়ে বিস্ময়!

মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানিতে জালিয়াতি, অর্থ আত্মসাৎ ও অর্থপাচারের মূলহোতা নূর আলী ও তার সিন্ডিকেটের সদস্যরা অধরাই রয়ে গেছে। সম্প্রতি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআিইডি) ২৭ জনশক্তি রফতানিকারকসহ ৩৩ জনের বিরুদ্ধে বনানী থানায় অর্থপাচারের অভিযোগে মামলা করেছে। ওই মামলায় নূর আলী সিন্ডিকেটের কাউকে আসামি করা হয়নি।

বায়রার সম্মিলিত সমন্বয় ফ্রন্টের সভাপতি মোহাম্মদ ফারুক, মহাসচিব মোস্তফা মাহমুদ, যুগ্ম মহাসচিব ফকরুল ইসলাম ও সিনিয়র সহসভাপতি রিয়াজ উল ইসলামসহ বায়রা নেতারা দীর্ঘদিন থেকে নূর আলী-নোমান সিন্ডিকেটর বিরুদ্ধে বক্তব্য ও অভিযোগ দিয়ে আসছেন।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ নূর আলী একজন ব্যবসায়ী নন, বরং শ্রমবাজারের ওপরে গড়ে ওঠা এক রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যের অদৃশ্য সম্রাট। বিগত সময়ে আওয়ামী লীগের প্রভাব কাজে লাগিয়ে তিনি প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে তার আধিপত্য বিস্তার করেন এমনভাবে, যা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর এক অন্তঃসারহীনতার চিত্র তুলে ধরে। উপজেলা চেয়ারম্যান, জেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের আওয়ামী লীগ. যুবলীগ নেতারা তার সিন্ডিকেটের অংশে পরিণত হন। তাদের দেয়া হয় নগদ সুবিধা, বিদেশ সফরের সুযোগ ও বিভিন্ন ধরনের নিয়োগ, যার মাধ্যমে তারা হয়ে ওঠে সিন্ডিকেটনির্ভর। এর ফলে একটি সুগঠিত অনুগত বলয় তৈরি হয়, যারা কোনোভাবেই নূর আলীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় না। শুধু রাজনৈতিক প্রভাব নয়, প্রশাসনিক ব্যবস্থাও নূর আলীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। পুলিশ, সিআইডি র‍্যাব, ডিজিএফআই, এনএসআই, কোনো সংস্থাই তার সীমার বাইরে নয়। যে কর্মকর্তা তার সিন্ডিকেটের পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন, তাকে দ্রুত বদলি করা হয় বা ম্যানেজ করা হয়। তদন্ত শুরু হলে তার আগেই তথ্য ফাঁস হয়ে যায়, যা প্রমাণ করে নূর আলীর প্রভাব কতটা গভীরে প্রোথিত। বিভিন্ন সংস্থার সদস্যদের তিনি তথ্যদাতা হিসেবে ব্যবহার করেন এবং অনেক সময় তার প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সেই সংস্থাগুলোকেই ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।

বায়রার সাবেক নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে. ২০২২ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রফতানিকারকদের সিন্ডিকেটে নূর আলীর ছিল ৩১ জন। এই ৩১ জন বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে। অথচ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। নূর আলী ও তার সিন্ডিকেটভুক্ত সদস্যরা মালয়েশিয়ায় যাওয়া শ্রমিকদের কাছ থেকে ন্যূনতম দেড় লাখ টাকা করে নিয়েছেন। আবার কারো কারো কাছ থেকে দুই লাখ থেকে ছয় লাখ টাকা পর্যন্ত নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। ন্যূনতম দেড় লাখ টাকা হিসাবে মালশেয়িয়ায় কর্মী পাঠিয়ে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে নূর আলীর ইউনিক ইস্টার্ন (প্রা.) লিমিটেড। অথচ সরকারি হিসাবে জনপ্রতি তাদের নেয়ার কথা ছিল ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা। সিআইডি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নূর আলীর নেতৃত্বে ১০ বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সিকে ২০১৬ সালে কর্মী পাঠানোর অনুমতি দেয় মালয়েশিয়া। পরে এসব এজেন্সি নূর আলী সিন্ডিকেট বা চক্র নামে পরিচিত পায়। নূর আলীর বিরুদ্ধে অন্তত ছয় হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৮ সালে বন্ধ করে দেয়া হয় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। এরপর ২০২১ সালে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পর মালয়েশিয়া সরকার প্রথমে ২৫ এজেন্সিকে কর্মী পাঠানোর অনুমতি দেয়। ওই ২৫ সিন্ডিকেটও ছিল নূর আলীর কবজায়। পরে সেই এজেন্সির সংখ্যা একশ’তে দাঁড়ায়। যার মূল নিয়ন্ত্রক ছিলেন নূর আলী। জনশক্তি রফতানি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানান, জনশক্তি রফতানি সিন্ডিকেটের মূলহোতা নূর আলী পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থাকে ঘুষ দেয়। বিশাল অংকের ঘুষ লেনদেনের কারণে সিআইডির মামলায় তার নাম নেই। বিগত সাত বছর ধরে তিনি এককভাবে বায়রা নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। তিনি ঢাকা জেলা আওযামী লীগের সভাপতি এক এমপিকে দুইবার বায়রার সভাপতি করেছেন। এছাড়া যুবলীগ মহানগর দক্ষিণের সভাপতিকে বায়রার সভাপতি বানিয়েছেন। বিশেষ কোনো সুবিধা পেয়ে সিআইডি কর্মকর্তাদের একটি অংশ তার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সিআইডি ও জনশক্তি রফতানি সংশ্লিষ্টরা জানান, ইউনিক ইস্টার্ন (প্রা.) লিমিটেড (আরএল-০০২১)-এর এমডি নূর আলী সিন্ডিকেটে আরও যারা রয়েছেন তারা হলেন- রাব্বী ইন্টারন্যাশনালের (আরএল-০২৫৮) প্রোপ্রাইটর মোহাম্মদ বশীর, দামহাসী করপোরেশনের (আরএল-০৭২৭), আমিন ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলসের (আরএল-৮১) ‍রুহুল আমিন, মৃর্ধা ইন্ট্যারন্যাশনাল করপোরেশনের (আরএল-১১০৮) কাওসার মৃধা, ম্যানিস পাওয়ার করপোরেশন (আরএল-৯৩৭) মো. মাহবুব আলম, অদিতী ইন্টারন্যাশনালের (আরএল-০৯৮৩) বিশ্বজিৎ সাহা, সেলিব্রেটি ইন্টারন্যাশনালের (আরএল-০৫০৩) মো. আব্দুল হাই, প্রভাতী ইন্টারন্যাশনালের (আরএল-০৯৩২) মোহাম্মদ আফসার উদ্দিন, সাদিয়া ইন্টারন্যাশনালের (আরএল-০২৯২) শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান, বিএনএস ওভারসিজ লিমিটেডের (আরএল-১৪৫০) ইঞ্জিনিয়ার ইসহাক আহমেদ শাকিল, অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনালের (আরএল-১৩১৮) আরিফুর রহমান, আল কাশেম ইন্টারন্যাশনালের (আরএল-০৬৮০) ফরিদ আহমেদ, পিআর ওভারসিসের (আরএল-১৯২৮) গোলাম রাকিব, দরবার গ্লোবার ওভারসিসের (আরএল-১২৯৫) মাহবুব মিয়া, সাইট ইন্টারন্যাশনালের (আরএল-০৩৪৫) শাহদাত হোসেন, কাশিপুর ওভারসিসের (আরএল-১৩১৭) মো. রফিকুল হোসাইন, রুবেল বাংলাদেশ লিমিটেডের (আরএল-১৪৫৫) কামরন নাহার হীরামনি, আমান এন্টারপ্রাইজের (আরএল-০৭২৪) মো. রফিকুল ইসলাম পাটোয়ারী, অ্যালিগেন্টস ওভারসিসের (আরএল-০৫৪৪) মিজানুর রহমান, পিএন এন্টারপ্রাইজ কোম্পানি ঢাকা লিমিটেডের (আরএল-০৩৭৬) নূর মোহাম্মদ তালুকদার, দ্য জিএমজি অ্যাসোসিয়েট লিমিটেডের (আরএল-১১৪৩) মনির হোসেন, থানেক্স ইন্টারন্যাশনালের (আরএল-১৭৭৯) আব্দুল্লাহ সাহেদ, সাওন ওভারসিজের (আরএল-০৭৫৯) এ বি এম সামসুল আলম কাজল, ত্রিবেনী ইন্টারন্যাশনালের (আরএল-০০২২) মো. সাইফুল নূর, হৃদয় ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের (আরএল-০২৪০) সৈয়দ গোলাম সরোয়ার, মনসুর আলী ওভারসিস অ্যান্ড ট্রাভেলসের (আরএল-০৯৯১) এবং শাহ ইমরান ভূঁইয়া। বায়রার একাধিক নেতা জানান, বাংলাদেশে জনশক্তি রফতানি খাতে অনিয়ম, জালিয়াতি ও বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী নূর আলী ও তার সিন্ডিকেটভুক্ত সদস্যরা। এরা বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রফতানির নামে চাঁদাবাজি মানবপাচারসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত। নূর আলীর প্রভাবসহ অদৃশ্য কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। নূর আলীর সঙ্গে এই চক্রে ধামহাসি করপোরেশনের নোমান ও রাব্বী ইন্টারন্যাশনালের বশীর অন্যতম দোসর হিসেবে কাজ করছে। এরা মালয়েশিয়ায় ১০ সিন্ডিকেটে ছিল আবার ২৫ ও ১০১ ‍সিন্ডিকেটেও ছিল। শ্রমিকের রক্তচুষে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

তারা আরো জানান, শুধু জনশক্তি রফতানি নয় সিন্ডিকেটের হোতা নূর আলী সিটি করপোরেশনের জায়গা দখল করে শেরাটন হোটেল, গুলশানে ওয়েস্টিন হোটেল, আশুগঞ্জ ও মেঘনা ঘাটে পাওয়ার প্ল্যান্ট, বিভিন্ন স্থানে রিসোর্ট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন। তিন দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন। অথচ তার বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।

বায়রার নেতারা আরও বলেন, সম্প্রতি সিআইডি মানবপাচার ও চাঁদাবাজির মামলায় আদালতে ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছে। সেখানে সিআইডি পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছে মালয়েশিয়ায় মানবপাচার ও চাঁদাবাজির প্রমাণ পাওয়া যায়নি। কিন্তু এর পরও ৩৩ জনের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগ এনে বনানী থানায় মামলা করা হয়েছে। একই সংস্থার দুই রকম তদন্তে সংশ্লিষ্টরা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তাদের কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন নূর আলী চক্র বিপুল টাকা ঘুষ দিয়ে তাদের প্রতিপক্ষ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা করিয়েছে। তবে সিআইডি বলছে বিষয়টি নিয়ে তদন্ত অব্যাহত আছে।

এ প্রসঙ্গে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জসিম উদ্দিন খান বলেন, মালয়েশিয়ায় অর্থপাচার সিন্ডিকেটে একটি মামলা হয়েছে। আরও তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে আরও একাধিক মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের সহকারী পুলিশ সুপার আল-মামুন বলেন, নূর আলীসহ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে যারা মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠিয়ে নির্ধারিত ফির বাইরে অর্থ আদায়ের সংশ্লিষ্ট ১০০ এজেন্সির বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। দেশে-বিদেশে তাদের অবৈধ সম্পদের খোঁজ নেয়া হবে। বিএফআইইউর সহায়তা নেয়া হচ্ছে। মামলার পর ইন্টারপোলের মাধ্যমে পলাতকদের গ্রেফতারে সহায়তা নেয়া হবে।