Image description

বার বার কাকুতি করি, আমি ভারতীয়। আমার বাপ-দাদাদের কবর এখানেই। কিন্তু পুলিশ আমাকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করে। জোর করে ঠেলে পাঠায় বাংলাদেশে। অবৈধ অভিবাসী তাড়াতে ভারত সরকারের অভিযানের শিকার পশ্চিমবঙ্গের এক যুবক মেহেবুব শেখের কণ্ঠে এমন করুণ বর্ণনা বেরিয়ে এসেছে। তাকে ভারত থেকে জোর করে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই অবশ্য ফেরানো হয়েছে। এমনি করে পশ্চিমবঙ্গের বহু মুসলিম শ্রমিককে হয়রানি করা হচ্ছে।

রাজ্যসভার এমপি সামিরুল ইসলাম দাবি করেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপে বিএসএফ ও বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের বৈঠকের পর মেহেবুব ফিরতে পেরেছেন। অনলাইন স্ক্রলে তাকে এবং অন্য আরও কিছু বাংলাভাষীকে নিয়ে একটি বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে। পুলিশের আচরণে ক্ষুব্ধ মেহেবুব শেখ। পুলিশ তাকে বলেছে, আমরা জানি মমতা তোমাদের ভুয়া আধার বানায়। ৯ই জুন ৩৮ বছরের এই রাজমিস্ত্রি মুম্বইয়ের মীরা রোডে এক চায়ের দোকানে বসে ছিলেন। তখন পুলিশ তাকে বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে সন্দেহ করে গ্রেপ্তার করে। মুম্বই ও আশপাশে এক দশকেরও বেশি সময় কাজ করেন মেহেবুব। তিনি ভেবেছিলেন, পুলিশের অভিযোগ খণ্ডনের জন্য তার কাছে যথেষ্ট কাগজপত্র আছে। পুলিশকে আধার কার্ড ও ভোটার কার্ড দেখান তিনি। প্রমাণ দেয়ার চেষ্টা করেন যে, তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বাসিন্দা। কিন্তু প্রথমে পুলিশ ও পরে সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী (বিএসএফ) সেসব কাগজপত্রকে গুরুত্বই দেয়নি।

মেহেবুব বলেন, ওরা সেগুলো ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দেয়। তিনি পা দিয়ে দেখালেন কেমন করে এক অফিসার তার কাগজপত্র ফেলে দিয়েছিল। ১৩ই জুন রাতে বন্দুক ঠেকিয়ে তাকে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত পার করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়।  ওদিকে তার পরিবার মরিয়া হয়ে জমির দলিলসহ নানান কাগজপত্র সংগ্রহ করছিল। তাকে নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য মাত্র চারদিন সময় দেয়া হয়। মীরা রোড থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, আমরা আইন মেনে কাজ করেছি। তিনি তার নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পারেননি।

দুই মাসের বেশি পরে ২২শে আগস্ট কলকাতার এক সভায় মেহেবুবের মতো ঘটনাকে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, অবৈধ অভিবাসনের সমস্যা তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত। তিনি জনসভায় বলেন, যারা এখানে শুধু আমাদের মানুষের জীবিকা কেড়ে নিতে এসেছে, যারা ভুয়া কাগজপত্রে আছে তাদের ফিরতেই হবে। আর সেটা করতে হলে তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারকেও যেতে হবে। মোদির কথায় প্রথম স্বীকারোক্তি ছিল যে, তার সরকার আসলে এক ‘বড় অভিযান’ চালাচ্ছে তথাকথিত অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে। কিন্তু স্ক্রল-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, এ অভিযানে পশ্চিমবঙ্গের বহু মুসলিম শ্রমিককেই হয়রানি ও আটক করা হয়েছে। বিজেপিশাসিত বিভিন্ন রাজ্যে পুলিশ হাজার হাজার অভিবাসী শ্রমিককে আটক করেছে। তাদের কাছে নাগরিকত্ব প্রমাণের নানান নথি দাবি করেছে পুলিশ। যদিও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২রা মে’র নির্দেশ অনুসারে, এমন অভিযানে ব্যক্তির নিজ রাজ্যের কর্তৃপক্ষকে ৩০ দিনের মধ্যে যাচাইয়ের সময় দিতে হয়। তবে বাস্তবে নাগরিক ভারতীয়দেরও বিদেশি বলে চিহ্নিত করে দেশছাড়া করা হচ্ছে ন্যায্য শুনানির সুযোগ ছাড়াই।

মেহেবুবের জন্ম বালিয়া হাসেননগর গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে। ছোটবেলায় তার ভাই মজিবুর শেখের সঙ্গে গরু চরিয়ে দিন কাটিয়েছেন। মজিবুর বলেছেন, বিনিময়ে পরিবারগুলো শুধু খাবার দিতো। পরে মেহেবুব মুম্বইয়ে নির্মাণকাজে গিয়ে রাজমিস্ত্রি হন। এক দশকেরও বেশি দক্ষতার সঙ্গে কাজ করার পর জুন মাসে তাকে আটক করা হয়। পরিচয়পত্র অনুযায়ী তার জন্ম-তারিখ ১লা জুলাই ১৯৮৭-এর আগে। আইন অনুসারে, তিনি ভারতীয় নাগরিক। তবে জন্মসনদ ছিল না। বারবার জন্মসনদ চাইছিল পুলিশ। জবাবে তিনি বলেন, আমার বাবা-মা মূর্খ ছিলেন। আমার তিন ছেলের জন্ম আমি অবশ্যই নথিভুক্ত করেছি। এদিকে, স্ক্রলের রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিজেপিশাসিত রাজ্যে অবৈধ অভিবাসী চিহ্নিত করার মানদণ্ড প্রায়ই খামখেয়ালির। উদাহরণস্বরূপ, মালদার আমির শেখ জন্মসনদ দেখিয়েও রাজস্থানের পুলিশের হাত থেকে রেহাই পাননি। তাকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া হয়।

মুর্শিদাবাদে ভাইয়ের এই ঘটনার পর মজিবুর পরিবারিক নথির খোঁজ শুরু করেন। তারা খুঁজে পান প্রপিতামহ সুলতান শেখের জমির দলিল ও ১৯৫০-এর দশকের ভোটার তালিকা। তাতে দাদা জামসেদ শেখের নাম ছিল। বিপ্রাকালি গ্রামে তাদের পূর্বপুরুষদের পুরনো বাড়ি ও কবরস্থান এখনো আছে। মেহেবুবের কাকা নূর হোসেন শেখ বলেন, আমার বাবা আমাকে বলেছিলেন, তার মৃত্যুর পর তাকে তার বাবার পায়ের কাছে কবর দিতে। গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান সাব্বির আহমেদ ওই কাগজপত্রের ভিত্তিতে দ্রুত মেহেবুবের ‘ফ্যামিলি ট্রি’ তৈরি করেন এবং তাকে ফেরানোর জন্য বিএসএফ ক্যাম্পে যান। বিএসএফ তবুও তা  মেনে নেয়নি। শেষ পর্যন্ত মেহেবুবকে সীমান্তে ঠেলে দেয়া হয়। মেহেবুব বলেন, আমি বারবার বলছি- আমি ভারতীয়। জবাবে ওরা রাইফেলের বাঁট দিয়ে ঘাড়ে মেরেছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই অবশ্য তাকে ফেরানো হয়। রাজ্যসভার এমপি সামিরুল ইসলাম দাবি করেন, মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে বিএসএফ ও বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের বৈঠকের পর মেহেবুব ফিরতে পেরেছেন। তবে তিনি আর মুম্বই ফিরতে চাইছেন না। পরিবারও তাকে পশ্চিমবঙ্গেই কাজ খুঁজতে বলছে। এখন দিনে ৭০০ রুপি পান। অন্যদিকে মুম্বইয়ে দিনে ১০০০ রুপি পেতেন। তাছাড়া পরিচিত শ্রমিকদের কাজে নেয়ার জন্য যে কমিশন পেতেন তাও হারিয়েছেন।

তবুও, তিনি সবচেয়ে বেশি মিস করছেন কাজের গর্ব। তার হোয়াটসঅ্যাপ ডিসপ্লে পিকচারে এখনো রয়েছে সেই শেষ সুউচ্চ ভবনটি, যেখানে তিনি কাজ করছিলেন। গ্রামে তার ফেরায় স্বস্তি আসলেও আবারো জেগে উঠেছে নাগরিকত্ব পরীক্ষার ভয়। ২০১৯-এ আসামে এনআরসি আপডেটের পর ১৯ লাখ মানুষ বাদ যান। অনেকে আশঙ্কা করছেন, সারা দেশে এনআরসি চালু হতে পারে। মেহেবুবের স্ত্রী সুরোনা বিবি অবশ্য অন্য ভয় পাচ্ছেন। স্বামী আবার মুম্বই যেতে চাইলে তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়। সুরোনা বিবি বলেন, আমি বলি কলকাতায় কাজ করো, কম পারিশ্রমিক পেলেও। ও বলে, আমি তো কোনো অপরাধ করিনি। কেন এই শাস্তি?