Image description

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর থেকে এখন পর্যন্ত ৮১ জন পুলিশ সদস্য কর্মস্থল থেকে পালিয়ে আছেন।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, গণ-অভ্যুত্থানের পর সারা দেশে ১৩৭ জন পুলিশ সদস্য কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্য থেকে এখন পর্যন্ত ৫৬ জন কর্মস্থলে ফিরে এসেছেন।

মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ ও বিপ্লব কুমার সরকার
মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ ও বিপ্লব কুমার সরকারফাইল ছবি: প্রথম আলো

এখনো যাঁরা পালিয়ে আছেন, তাঁদের মধ্যে অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ক্ষমতার অপব্যবহার, মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ নানা অভিযোগ আছে। গ্রেপ্তার এড়াতে তাঁদের একটা অংশ দেশের বাইরে পালিয়ে গেছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, পালিয়ে থাকা পুলিশ সদস্যদের মধ্যে উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদমর্যাদার আছেন ৩ জন। ১০ জন অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত ডিআইজি)। পুলিশ সুপার (এসপি) ১১ জন। ৯ জন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অতিরিক্ত এসপি)। সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) ৫ জন। ২৭ জন পরিদর্শক। উপরিদর্শক (এসআই) ৮ জন। ৩ জন সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই)। আর কনস্টেবল ৫ জন।

কারা পলাতক

পালিয়ে থাকা আলোচিত পুলিশ সদস্যদের মধ্যে আছেন ডিআইজি পদমর্যাদার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, ঢাকা রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম রেঞ্জের সাবেক ডিআইজি নুরে আলম মিনা, পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি প্রলয় কুমার জোয়ারদার, ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, এস এম মেহেদী হাসান, খোন্দকার নুরুন্নবী ও সঞ্জিত কুমার রায়, ডিএমপির গুলশান বিভাগের সাবেক উপকমিশনার রিফাত রহমান শামীম, সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার ইফতেখায়রুল ইসলাম, ডিএমপির ডিবির সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার মিশু বিশ্বাস, ডিএমপির রমনা অঞ্চলের সাবেক সহকারী কমিশনার গোলাম রুহানী, ঢাকা জেলার সাবেক পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান, নারায়ণগঞ্জের সাবেক পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল, ডিএমপির রামপুরা থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মশিউর রহমান, গুলশান থানার সাবেক ওসি বি এম ফরমান আলী, পল্লবী থানার সাবেক ওসি অপূর্ব হাসান, ঢাকা জেলার সাবেক ওসি কাজী মাইনুল ইসলাম।

পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ডিআইজি পদমর্যাদার ৩ জন, ১০ জন অতিরিক্ত ডিআইজি, এসপি ১১ জন, অতিরিক্ত এসপি ৯ জন, এএসপি ৫ জন, পরিদর্শক ২৭ জন, এসআই ৮ জন, এএসআই ৩ জন ও কনস্টেবল ৫ জন।

গত ৭ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে ডিআইজি থেকে পরিদর্শক পদমর্যাদার ৪০ কর্মকর্তার বিষয়ে বলা হয়, নিজ কর্মস্থল থেকে পলায়ন করায় তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন। তাঁদের অনুকূলে দেওয়া পুলিশ পদক প্রত্যাহার করা হলো।

অন্যদিকে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ অনুযায়ী ‘পলায়ন’-এর শাস্তিযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত বেশ কিছু পুলিশ কর্মকর্তাকে ইতিমধ্যে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

৬৩ জন গ্রেপ্তার
৬৩ জন জনের মধ্যে আছেন সাবেক আইজিপি, ডিএমপির সাবেক কমিশনার, জিএমপির সাবেক কমিশনার ও রাজধানীর একাধিক থানার সাবেক ওসি

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, গণ-অভ্যুত্থানের ঘটনায় হওয়া মামলায় এখন পর্যন্ত পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ৬৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে কর্মরতদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তাঁরা কারাগারে আছেন।

গ্রেপ্তার ৬৩ জন জনের মধ্যে আছেন সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, এ কে এম শহীদুল হক, ডিএমপির সাবেক কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া, গাজীপুর মহানগর পুলিশের (জিএমপি) সাবেক কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম, অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত ডিআইজি) মশিউর রহমান, ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের সাবেক উপকমিশনার মো. ইকবাল হোসাইন, ডিএমপির মিরপুর বিভাগের সাবেক উপকমিশনার জসীম উদ্দিন মোল্লা, ঢাকা জেলা পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত সুপার মো. আবদুল্লাহিল কাফী, গুলশান থানার সাবেক ওসি মাজহারুল ইসলাম, যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান।

এখন পর্যন্ত যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
খোন্দকার রফিকুল ইসলাম, পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত আইজিপি-ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস)

পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত আইজিপি-ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) খোন্দকার রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, কারাগারে থাকা পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এখনো বিভাগীয় মামলা করা যায়নি জটিলতার কারণে।

 
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে এমন নানা দেয়াল লিখন জনপ্রিয় হয়েছিল। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর অনেক পুলিশ কর্মকর্তা পলাতক আছেনপ্রথম আলো ফাইল ছবি

মামলা ও আসামি

পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচার গুলি চালানো, হত্যাসহ বিভিন্ন ঘটনায় ফৌজদারি কার্যবিধিতে ১ হাজার ৪৯০ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।

৭ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে ডিআইজি থেকে পরিদর্শক পদমর্যাদার ৪০ কর্মকর্তার বিষয়ে বলা হয়, নিজ কর্মস্থল থেকে পলায়ন করায় তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন। তাঁদের অনুকূলে দেওয়া পুলিশ পদক প্রত্যাহার করা হলো।

গত ৪ আগস্ট ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ‘কর্তৃত্ববাদী সরকার পতন-পরবর্তী এক বছর: প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’ শীর্ষক একটি পর্যবেক্ষণভিত্তিক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে উল্লেখ করা হয়, গুলিবর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় সরকার পতন-পরবর্তী ১১ মাসে সারা দেশে পুলিশের বিরুদ্ধে ৭৬১টি মামলা হয়। এসব মামলার আসামি ১ হাজার ১৬৮ জন। আসামিদের মধ্যে ৭ জন সাবেক আইজিপি। মামলায় ৬১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়


পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (অতিরিক্ত আইজিপি-ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) খোন্দকার রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, যেসব পুলিশ সদস্য হত্যাসহ বিভিন্ন মামলার আসামি, তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে। তখন তাঁরা আইনের আওতায় চলে আসবেন।

সংযুক্ত-ওএসডি-বাধ্যতামূলক অবসর

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, বিতর্কিত ভূমিকার কারণে গত এক বছরে পুলিশের বিভিন্ন পদমর্যাদার ৮৬ জন সদস্যকে বিভিন্ন ইউনিটে সংযুক্ত করা হয়েছে। আর ৮২ জনকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশের বিভিন্ন পদমর্যাদার ৫৫ জন জনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে।

সারা দেশে পুলিশের বিরুদ্ধে যত মামলা হয়েছে, তার অনেকগুলো ঢালাও। যাঁরা কমান্ড (আদেশ) ও পরিকল্পনায় জড়িত ছিলেন, যাঁদের গুলিতে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে, তদন্ত সাপেক্ষে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হলে তা গ্রহণযোগ্য হতো।
অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক, ক্রিমোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো কর্মকর্তাদের মধ্যে আছেন পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) অতিরিক্ত আইজিপি মো. মনিরুল ইসলাম, পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত আইজিপি আতিকুল ইসলাম, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া, পুলিশ স্টাফ কলেজের রেক্টর মল্লিক ফখরুল ইসলাম, পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত আইজিপি সেলিম মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি মীর রেজাউল আলম, পুলিশ টেলিকমের অতিরিক্ত আইজিপি ওয়াই এম বেলালুর রহমান, ডিএমপির কমিশনার হাবিবুর রহমান।


সার্বিক বিষয়ে টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, সারা দেশে পুলিশের বিরুদ্ধে যত মামলা হয়েছে, তার অনেকগুলো ঢালাও। যাঁরা কমান্ড (আদেশ) ও পরিকল্পনায় জড়িত ছিলেন, যাঁদের গুলিতে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে, তদন্ত সাপেক্ষে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হলে তা গ্রহণযোগ্য হতো। ঢালাও মামলার কারণে বাহিনীর মধ্যে অনেকে ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় আছেন। তা ছাড়া এখানে নিরপরাধ কারও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ারও আশঙ্কা থাকছে। এতে বাহিনীর মনোবলে প্রভাব পড়ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সরকারকে কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে।