
২০২০ সালে দক্ষ জনবল তৈরির উদ্দেশ্যে হাতে নেওয়া হয় ৩২৯ উপজেলায় টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রকল্প, যা কারিগরি শিক্ষা খাতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রকল্প। ব্যয় ধরা হয়েছিল ২০ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা। লক্ষ্য ছিল প্রতিবছর তিন লাখ ৬০ হাজার গ্রামীণ শিক্ষার্থীকে ভোকেশনাল শিক্ষার আওতায় আনা, দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা এবং শ্রমবাজারে নতুন সুযোগ সৃষ্টি করা। তবে পাঁচ বছরে বাস্তবায়নের প্রকল্পটির শেষ দেখা যাচ্ছে প্রকল্পের সামনের পথ শুধুই ধু ধু মরুভূমি।
আইএমইডির তথ্য আরো বলছে, প্রতিটি উপজেলায় একটি করে টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রকল্পটি নির্ধারিত সময়সীমা ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা বাড়িয়ে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক আইএমইডির বৈঠকে স্বীকার করেছেন, জমি অধিগ্রহণে ব্যর্থতা, জমির দামের অমিল, পরিবেশগত ছাড়পত্র না পাওয়া, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে প্রশাসনিক বিলম্ব এবং পর্যাপ্ত জনবল ঘাটতির কারণে প্রকল্প কার্যত থেমে আছে।
এ বিষয়ে প্রকল্পটির উপপরিচালক মো. আনোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, স্কুল অ্যান্ড কলেজের জন্য প্রায় ২০০টি জমি কনফার্ম করা হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রকল্পটি শুরুতে করোনার কারণে দেরি হয়। এখন পুরোদমে কাজ চলছে।
আইএমইডি বলেছে, এভাবে চলতে থাকলে প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়িয়েও সুফল পাওয়া যাবে না। তারা দ্রুত সংশোধনী এনে নজরদারি বাড়ানো এবং প্রয়োজনে ব্যর্থ উপজেলাগুলোর তালিকা আলাদাভাবে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
সড়ক অবকাঠামো : ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে হতাশা
১৬ হাজার ৯১৯ কোটি টাকার ঢাকা-সিলেট করিডর প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা আগামী বছরের ডিসেম্বরে। কিন্তু চার বছর পেরিয়ে গেলেও ব্যয় হয়েছে মাত্র তিন হাজার ২৬১ কোটি টাকা, শুধু ১৯ শতাংশ।
বাস্তব কাজের অগ্রগতি আরো কম, মাত্র ১৫ শতাংশ। প্রকল্প পরিচালকরা জানিয়েছেন, জমি অধিগ্রহণ, বিদ্যুৎ-গ্যাস-টেলিফোন লাইন স্থানান্তরে ধীরগতি, নকশার পুনঃ সমন্বয় এবং অনুমোদন প্রক্রিয়ায় জটিলতার কারণে কাজ এগোচ্ছে না।
বিদ্যুৎ, শিল্প ও নদী প্রকল্পও থমকে
১৩টি প্রকল্পের মধ্যে বিদ্যুৎ বিভাগের তিনটি—দুটি ট্রান্সমিশন ও একটি ডিস্ট্রিবিউশন প্রকল্প। শিল্প মন্ত্রণালয়ের দুটি বড় উদ্যোগও তালিকায় রয়েছে, ছাতক সিমেন্ট কোম্পানিকে আধুনিকায়ন ও ঘোড়াশাল-পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা প্রকল্প। এদের কোনোটিতেই কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি নেই।
নদী খনন ও নাব্যতা ফিরিয়ে আনার বড় প্রকল্পগুলো আটকে আছে। পাবনার ইছামতী নদী পুনরুজ্জীবন, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তুলাই ও পুনর্ভবা নদীর নাব্যতা প্রকল্প, মোংলা বন্দরের চ্যানেল খনন-সবখানেই জমি জট, পরিবেশগত অনুমোদন, নকশা পরিবর্তন এবং আইনি জটিলতা প্রকল্পকে থামিয়ে রেখেছে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের দুটি প্রকল্পও সংকটে। এর মধ্যে পশ্চিমাঞ্চলের গ্রামীণ যোগাযোগ উন্নয়ন প্রকল্প এবং চট্টগ্রামের খাল পুনঃখনন-সংস্কার প্রকল্পও ব্যয়হীনতার শিকার।
১৩টি প্রকল্পের জন্য মোট বরাদ্দ ৯২ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। অথচ জুলাই পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে মাত্র ৩০ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা—প্রায় ৩৩ শতাংশ। গড়ে দেড় বছর সময় বাকি, আর খরচ করতে হবে আরো ৬১ হাজার ৬৪৬ কোটি টাকা।
আইএমইডির বৈঠকের নথি বলছে, প্রকল্প পরিচালকরা ১৮ ধরনের মোট ৬০টি সমস্যা চিহ্নিত করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় বাধা জমি অধিগ্রহণ, যা একাই আটটি প্রকল্পকে প্রভাবিত করছে। অর্থাৎ মোট প্রকল্পের ৬২ শতাংশ জমি সমস্যায় আটকে আছে।
একই সমস্যা, পুরনো রোগ
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরি কালের কণ্ঠকে বলেন, এসব সমস্যাকে আমরা দীর্ঘদিন ধরে দেখছি। সমাধানের জন্য একের পর এক সুপারিশ করা হলেও তা বাস্তবায়নে গাফিলতি হয়। ফলে প্রকল্পগুলো শুধু সময় ও ব্যয় বাড়ায়।
তাঁর মতে, সব প্রকল্পে সমান তদারকি সম্ভব নয়। তাই যেসব প্রকল্প সরাসরি জনজীবন ও অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে। যেমন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাত সেগুলোতে বিশেষ নজরদারি জরুরি।
আইএমইডি প্রকল্প পরিচালক ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে সতর্ক করেছে। বিশেষ পরিদর্শন চালানো, দরপত্র নথি সংশোধন, অনুমোদন দ্রুত সম্পন্ন করা, এমনকি প্রয়োজনে প্রকল্প বাতিল করার সুপারিশও করা হয়েছে।
এখন উচ্চপর্যায়ে বৈঠক বসবে, যেখানে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ও অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে সচিব, প্রকল্প পরিচালক ও পরিকল্পনা কমিশনের প্রতিনিধি উপস্থিত থাকবেন। সেখানেই বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত হবে।
প্রকল্পগুলোর বিষয়ে আইএমইডি সচিব মো. কামাল উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, আমরা ধীরগতির ১৩টি প্রকল্প নিয়ে কাজ করছি। কেন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে না তা যাচাই করার চেষ্টা করছি। এ বিষয়ে শিশগিরই একটি উচ্চ পর্যায়ের মিটিং হবে। সেখানেই প্রকল্পগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।