স্টেথোস্কোপ এখনো ঠিকমতো কাঁধে ঝোলেনি, হাতে এসেছে মাত্র চিকিৎসক হওয়ার প্রথম পরিচয়—‘ইন্টার্ন’। তবুও যে উদ্যোগে তিনি এগিয়ে গেছেন, তা অভিজ্ঞ বহু চিকিৎসকও কখনো করে দেখাতে পারেননি।
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ইন্টার্নশিপ করছেন তরুণ চিকিৎসক শীর্ষ শ্রেয়ান। তার একান্ত চেষ্টায় আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ডিরেক্ট রিলিফ থেকে পাওয়া গেছে প্রায় ১৭ কোটি টাকার জীবনরক্ষাকারী ওষুধ—অ্যাল্টেপ্লেস। এখন থেকে স্ট্রোক ও হৃদ্রোগীরা বিনামূল্যে এই অতি দামি ওষুধ পাবেন রামেক হাসপাতালে।
স্ট্রোক কিংবা হৃদ্রোগে আক্রান্ত কোনো রোগীর জন্য এই ইনজেকশন হতে পারে জীবন ও মৃত্যুর ফারাক। কিন্তু একটি ভায়ালের দাম প্রায় ৫০ হাজার টাকা—যা বেশির ভাগ রোগীরই সাধ্যের বাইরে। রোগীর ওজন ৬০ কেজির বেশি হলে প্রয়োজন হয় দুই ভায়াল। দরিদ্র রোগীরা তাই শুধু অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকেন।
এবার সেই হতাশার দেয়াল ভেঙে দিলেন শীর্ষ। তিনি নিশ্চিত করলেন, এই ওষুধ যেন কোনো মানুষ শুধু টাকার অভাবে হারিয়ে না ফেলেন জীবনের সুযোগ।
শীর্ষ যখন পঞ্চম বর্ষের ছাত্র, তখনই ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক অর্গানাইজেশনের একটি গবেষণা দলের সঙ্গে যুক্ত হন। তিনিই একমাত্র বাংলাদেশি ইন্টার্ন যিনি এই বিশ্ববিখ্যাত গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। পরিশ্রমী তরুণ গবেষক হিসেবে তার নাম নজরে পড়ে আন্তর্জাতিক এই সংস্থার। তাদেরই একজন সরাসরি শীর্ষকে মেইল করে জানতে চান—রামেক কি এই ওষুধ গ্রহণ ও রোগীদের দিতে সক্ষম?
শীর্ষ দ্বিধা করেননি। ছুটে যান তার মেন্টর ও মেডিসিনের অধ্যাপক ডা. আজিজুল হক আযাদের কাছে। অনলাইনেই সেই দাতা সংস্থার সঙ্গে ডা. আযাদের চলতে থাকে আলোচনা। শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক চুক্তি হয়, নানা জটিলতা পেরিয়ে পৌঁছে যায় ২ হাজার ৫০০ ভায়াল অ্যাল্টেপ্লেস।
২৫ আগস্ট রামেক হাসপাতালে পৌঁছানো এই ওষুধ গত বুধবার (২৭ আগস্ট) থেকে বিনামূল্যে রোগীদের দেওয়া শুরু হয়েছে। প্রথম দিনই ব্যবহৃত হয়েছে প্রায় ৭০টি ভায়াল।
বৃহস্পতিবার (২৮ আগস্ট) রামেক হাসপাতালে কথা হয় শীর্ষের সঙ্গে। শীর্ষ যেন তার হৃদয় থেকে কথাগুলো বলছিলেন। তিনি যে এই অসাধারণ সাফল্যের নায়ক তারপরও নিজে কোনো গর্ব করেননি। বরং অনুরোধের স্বরে বলছিলেন, ‘ওষুধ আছে, সুযোগও আছে। কিন্তু রোগীরা যদি দেরি করে আসেন, তাহলে আর কাজে লাগবে না। কেউ যদি দেখেন শরীরের এক পাশ অবশ হয়ে গেছে, মুখ বেঁকে গেছে, কথা জড়িয়ে যাচ্ছে, তাহলে দেরি না করে দ্রুত হাসপাতালে আসুন। সময়ই এখানে সবচেয়ে বড় জীবনরক্ষাকারী।’
‘ইন্টার্ন চিকিৎসক’—কাগজে ছোট্ট এক পরিচয়। কিন্তু সেই ছোট্ট পরিচয়ের ভেতর থেকেই শীর্ষ দেখিয়ে দিলেন, মানবতার জন্য কাজ করতে চাইলে বড় পরিচয় নয়, বড় হৃদয়ই যথেষ্ট।
তার এমন অবদানের জন্য খুশি রামেকের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফ এম শামীম আহম্মদ, তার মেন্টর ডা. আজিজুল হক আযাদসহ সংশ্লিষ্ট সবাই।
শীর্ষ শ্রেয়ানের মেন্টর অধ্যাপক আজিজুল হক আযাদ বলেন, ‘শীর্ষ যখন আমাকে বিষয়টা জানাল, তখন থেকে আমিও বিষয়টা নিয়ে খুব উৎসাহী ছিলাম। এই ওষুধ অনেক দামি বলে অনেকেই কিনতে পারেন না। তার পরও এই ওষুধ একেবারেই অরিজিনাল। অনেক ভালো। এটা কেবল ওষুধ আনা নয়; এটা অসহায় রোগীদের বেঁচে থাকার সুযোগ এনে দেওয়া। শীর্ষকে নিয়ে আমরা গর্বিত।’
হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফ এম শামীম আহাম্মদ বলেন, ‘এ কৃতিত্ব শীর্ষের। তার জন্যই আজ এত রোগী বিনামূল্যে ওষুধ পাচ্ছেন।’
তিনি বলেন, ‘১৭ কোটি টাকার অমূল্য ওষুধ এনে তিনি শুধু রোগীদের নয়, গোটা দেশের তরুণ চিকিৎসকদের জন্য এক অনুপ্রেরণার নাম শীর্ষ শ্রেয়ান।’