
নিত্যপণ্যের বাজার আবার ঊর্ধ্বমুখী। সবগুলো পণ্যের দামই বেড়ে গেছে। গত জুন থেকে শুধু চালের দাম বাড়লেও জুলাই-আগস্টে বেড়ে গেছে অন্যান্য পণ্যের দামও। কোনো কোনো পণ্যের দাম গত বছরের তুলনায় ২০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
রাষ্ট্রীয় বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ-টিসিবির নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের খুচরা বাজারদরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশের মানুষের সবচেয়ে বেশি ভোগ্যপণ্য মাঝারি জাতের পাইজাম, আটাশ চাল গত বছরের তুলনায় বেড়েছে ১৭ দশমিক ৩৯ শতাংশ। গত বছর এ সময়ে মাঝারি চাল ৫৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও বর্তমানে তা ৬০ থেকে ৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সরু জাতের মিনিকেট, নাজিরশাইল ১১ দশমিক ১১ শতাংশ এবং মোটাজাতের স্বর্ণা, চায়না ইরি চালের দাম ৭ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়েছে। একইভাবে আটার দাম ১৪ দশমিক ২৯ শতাংশ, বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১৪ দশমিক ৯৬ শতাংশ, পাম অয়েলের (লুজ) ১৯ দশমিক ৬২ শতাংশ, মসুর ডালের দাম (ছোট দানা) ১৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ, ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ এবং ইলিশ মাছের দাম কেজিতে ২৯ দশমিক ১৭ শতাংশ বেড়েছে। বাস্তবে এসব পণ্যের দাম টিসিবির তথ্যের চেয়েও আরো বেশি বেড়েছে।
গত এক বছরে মাছের দাম ২০ শতাংশের ওপর বেড়েছে। বিআইডিএসের তথ্য অনুযায়ী, খাদ্যে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার পেছনে চালের পরই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে মাছের দাম। মূল্যস্ফীতিতে মাছের প্রভাব ৩৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
কারওয়ান বাজারের মাছ ব্যবসায়ী আব্দুল কাদেরের মতে, গত তিন মাসের ব্যবধানে রুই মাছের দাম কেজিতে বেড়েছে ১০০-১৫০ টাকা পর্যন্ত। বর্তমানে দুই কেজির ওপরে রুই মাছের দাম ৪৫০ থেকে ৪৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। তিন মাস আগেও একই ধরনের মাছের দাম ছিল ৩৫০-৩৮০ টাকা। এক কেজি ওজনের রুই মাছ তিন মাস আগে বিক্রি হয়েছে ২০০-২২০ টাকা। এখন সেটা ২৮০-৩০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। এক বছরের ব্যবধানে সব সাইজের রুই মাছে দাম বেড়েছে ১০০-২০০ টাকা পর্যন্ত। এছাড়াও সব ধরনের মাছের দাম বেড়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ইলিশ মাছের দাম। গত বছরের চেয়ে এবার ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত কেজিপ্রতি ইলিশের দাম বেড়েছে।
গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে চলতি বছরের জুন মাসের প্রথমার্ধ পর্যন্ত ১০ মাস নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে ছিল। এমনকি গত রোজায়ও দ্রব্যমূল্যের বাড়তি দাম দেখা যায়নি। রমজানে দাম না বাড়ায় মানুষ স্বস্তিতে রোজা পালন করতে পেরেছে। এজন্য অন্তর্বর্তী সরকার পেয়েছে প্রশংসা। কিন্তু গত দুই মাসে দাম বেড়ে যাওয়ায় ওএমএস, সাশ্রয়ীমূল্যে নিত্যপণ্য বিক্রিসহ সরকারের নানামুখী উদ্যোগেও এর রাশ টেনে ধরতে পারছে না।
বাজার ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার বিষয়ে অনুসন্ধানে ব্যবসায়ী, আমদানিকারক, খুচরা বিক্রেতা ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে বাজার কারসাজির এক ভয়ংকর চিত্র। বাজার বিশ্লেষণ করে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যে প্রতিবেদন দিয়েছে তাতেও বলা হয়, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জন্য দায়ী মূলত মধ্যস্বত্বভোগীর কারসাজি। প্রতিবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অতিসম্প্রতি জমা দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, অতিরিক্ত মুনাফার লোভে এবং সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে মধ্যস্বত্বভোগীরা আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তাদের তৈরি ‘কূটকৌশলের’ কারণেই বাজার প্রতিনিয়ত ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। এতে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষ বিপাকে পড়ছেন। মূল্যবৃদ্ধির জন্য সাধারণভাবে সড়ক-মহাসড়কে চাঁদাবাজিকে দায়ী করা হলেও ওই প্রতিবেদনে স্পষ্ট বলা হয়েছে, আসল কলকাঠি নাড়ছে মধ্যস্বত্বভোগীরাই। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে দ্রব্যমূল্য কখনোই স্থিতিশীল হবে না।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, খাদ্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতির তদন্তে তারা দেশের ১০টি গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদনকারী জেলা ও বন্দর থেকে ঢাকার বাজার পর্যন্ত অনুসন্ধান চালায়। সবজির জন্য বগুড়ার মহাস্থানগড়, কুমিল্লার নিমসার, নরসিংদীর জংলীবাজার ও যশোরের সাতমাইল; চালের জন্য দিনাজপুর, শেরপুর ও নওগাঁ; দেশি পেঁয়াজের জন্য পাবনা এবং আমদানিকৃত পণ্যের জন্য চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ও যশোরের বেনাপোল থেকে পণ্যবাহী ট্রাকে যাত্রীবেশে ঢাকার বিভিন্ন বাজার পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করে।
অনুসন্ধানে কৃষকের উৎপাদনমূল্য, স্থানীয় বাজারদর, পরিবহন খরচ, ঢাকা আড়তের পাইকারি দাম, প্যাকেজিং, শ্রম, কমিশন এবং চাঁদাবাজিসংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। সড়ক-মহাসড়কে প্রত্যক্ষভাবে চাঁদাবাজির প্রমাণ না মিললেও ট্রাক ভাড়া নিতে স্ট্যান্ডে নানা ধরনের দালালির তথ্য পাওয়া গেছে।
এতে বলা হয়, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে সাধারণ মানুষ ভীষণ ক্ষুব্ধ। বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়ায় সরকারকেও তারা প্রশ্নবিদ্ধ করছে। সরকার রাজনৈতিক নয়, তাই কে অসন্তুষ্ট হলো বা কে সন্তুষ্ট, তা না দেখে মধ্যস্বত্বভোগীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, অধিকাংশ ট্রাক অনুমোদিত ওজনের চেয়ে দ্বিগুণ মাল বহন করে। সিটি করপোরেশনের চাঁদা, পার্কিং ফি বা মালিক-শ্রমিক সমিতির চাঁদা খুচরা পর্যায়ে পণ্যের দামে বড় প্রভাব ফেলে না। দাম বাড়ানোর মূল কারণ হলো মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য। তাদের হাতেই খুচরা বাজারে দাম দ্বিগুণÑএমনকি অনেক ক্ষেত্রে তিনগুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়। উৎপাদনকারী ও ভোক্তা—উভয়কেই বঞ্চিত করে এ চক্র বছরের পর বছর মুনাফা লুটে আসছে, অথচ কোনো সরকারই তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য চাল, ডাল ও তেলসহ বিভিন্ন পণ্যের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ সরবরাহ করে থাকেনÑএমন কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গেও কথা হয়। প্রতিষ্ঠানের ও নিজের পরিচয় গোপন রাখার শর্তে একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গ্রুপের কর্ণধার আমার দেশকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই ব্যবসায়ীদের মধ্যে একধরনের ভীতির সৃষ্টি হয়েছিল, এতে বাজারে সিন্ডিকেট কিংবা কারসাজি ব্যবসা বেশ কয়েক মাস বন্ধ ছিল। এতে জিনিসপত্রের দামও কিছুটা কমে এসেছিল। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণার পর সরকারকে এখন আর সেভাবে ভয় পাচ্ছে না। ফলে অতীতে যারা সিন্ডিকেট ব্যবসায় জড়িত ছিলেন, তারা ফের সক্রিয় হয়ে উঠছে। এ সিন্ডিকেট চক্রের হোতাদের অধিকাংশই পতিত স্বৈরাচারের সমর্থক।
ওই ব্যবসায়ী নেতার মতে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ঘোষণার পর ব্যবসায়ীদের মধ্যে এমন একটা ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে, এ সরকারের সময় প্রায় শেষ হয়ে আসছে। ফলে তারা নির্বাচন নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকবে, অন্যদিকে খেয়াল করার মতো পরিস্থিতি নেই।
বাজারে কারসাজির অভিযোগের সত্যতা মিলেছে আমদানিকারকদের বক্তব্যেও। এ বিষয়ে বেনাপোল আমদানি-রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি মহসিন মিলন আমার দেশকে বলেন, ভারত থেকে প্রতি কেজি মরিচ আমদানির পর সব খরচ মিলিয়ে বেনাপোল বন্দরে দাম দাঁড়ায় সর্বোচ্চ ৮০ টাকার মতো। আমরা দুয়েক টাকা লাভেই তা বিক্রি করছি। কিন্তু মধ্যস্বত্বভোগীদের অনেকে কারসাজি করে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করে অতিরিক্ত মুনাফা লুটেছে। তিনি বলেন, এজন্য সরকারকে বাজারে মনিটরিং জোরদার করতে হবে।
রাজধানীর সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার বাবুবাজারের ইসলাম রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী আমজাদ হোসেন আমার দেশকে বলেন, দেশের চালের বাজার এখন আর দিনাজপুর, নওগাঁ ও কুষ্টিয়ার চাতাল ব্যবসায়ীদের হাতে নেই। চালের বাজার করপোরেট হাউসগুলোর নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। এ কোম্পানিগুলো চালের ভরা মৌসুমেও চালের দাম বাড়িয়েছে। এটা খুবই রহস্যজনক। তিনি আরো বলেন, করপোরেট হাউসগুলোর রহস্যময় ভূমিকা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে, সরকার যতই উদ্যোগ গ্রহণ করুক না কেন বাজার স্থিতিশীল হবে না।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন আমার দেশকে বলেন, মধ্যস্বত্বভোগীদের জন্যই সবকিছুর দাম বেড়েছে। আগে পরিবহনে চাঁদাবাজি হতো, তা এখনো চলছে। আড়তদার বা ব্যাপারীরা কোনো উৎপাদন বা আমদানিতে জড়িত না থেকেও দাদন খাচ্ছে। এখন তারা কমিশন এজেন্টে পরিণত হয়েছে। কত টাকা দিয়ে কিনেছে তার কোনো পাকা রসিদ থাকে না, প্রতি কেজিতে শুধু কমিশন নেয়। করপোরেট গ্রুপগুলোও দাদন দিয়ে কমিশনের মাধ্যমে চাষাবাদ করাচ্ছে। ইলিশ মাছের বাজারেও দাদন দিয়ে কমিশনে দাম বাড়ানো হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, দেশের অর্থনীতির বড় পতন ঠেকিয়েছে এ অন্তর্বর্তী সরকার, মূল্যস্ফীতিও কমেছে। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে যা ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ ছিল, তা এখন সাড়ে ৮ শতাংশ। এখন ডলারের দরপতনও থেমেছে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বাড়ছে। আমদানি আগের তুলনায় সহজ হয়েছে। বিশ্ববাজারে নিত্যপণ্যের দামও অনেকটাই কমে গেছে।
ট্যারিফ কমিশনের গত ১৮ আগস্টের প্রতিবেদনে দেখা যায়, থাইল্যান্ডে এখন ৫ শতাংশ ভাঙা চালের মেট্রিক টনপ্রতি দর ৩৮১ মার্কিন ডলার (এফওবি মূল্য, অর্থাৎ জাহাজভাড়া ছাড়া), যা এক বছর আগে ছিল ৬১৬ ডলার। এক বছরে দাম কমেছে ৩৮ শতাংশ।
এমন পরিস্থিতিতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো মূল্যস্ফীতিও অনেকটা কমিয়ে এনেছে। কিন্তু বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি এখনো চড়া। ২০২২ সালে দেউলিয়া হওয়া শ্রীলঙ্কায় এখন মূল্যস্ফীতি, অর্থাৎ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে না, বরং কমছে। মূল্য সংকোচনের হার শূন্য দশমিক ০৩ শতাংশ। চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়া পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতি ২০২৩ সালে ৩৫ শতাংশ ছাড়িয়েছিল। সেটা এখন নেমেছে ৪ শতাংশের কাছাকাছি। ভারতে মূল্যস্ফীতি এখন একেবারেই কম (১ দশমিক ৫৫ শতাংশ)। নেপালে (২ দশমিক ৭২)। বিপরীতে বাংলাদেশে এখনো মূল্যস্ফীতি চড়া, যা গত জুলাই মাসে ছিল সাড়ে ৮ শতাংশের বেশি।