
গুমের সঙ্গে জড়িতদের বিচারে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে নতুন একটি আইন করতে যাচ্ছে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এই আইনে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান রাখা হয়েছে।
এমনকি ট্রাইব্যুনালে ১২০ দিনের মধ্যে বিচারকাজ শেষ করার কথা বলা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনের এ খসড়া আজ বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উঠছে। অনুমোদন পেলে এ বিষয়ে অধ্যাদেশ জারি করবেন রাষ্ট্রপতি।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জানা গেছে, প্রস্তাবিত আইনের খসড়া আজ উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এজেন্ডাভুক্ত করা হয়েছে। ‘গুম প্রতিরোধ, প্রতিকার ও সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’ নামের বিধানে বলা হয়, গুম, বলপূর্বক অপহরণ, গোপন আটককেন্দ্র স্থাপন করে বন্দি রাখার মতো অপরাধের বিচারে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি ১ কোটি টাকা জরিমানা করা হবে।
আইনের খসড়ায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত জোরপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিদের সুরক্ষাসংক্রান্ত কনভেনশন, গুম কমিশনের মতামত ও সুপারিশ, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও সংগঠনের মতামত বিবেচনায় নিয়েছে বলে আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের কাছে গুমের বিচার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গুমের বিচার নিশ্চিত করার ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ১০০ গুমের অভিযোগ নিয়ে কাজ করছে। ট্রাইব্যুনালের সীমাবদ্ধতা হলো আদালতটি সব ধরনের গুমের বিচার করতে পারে না। সরকার তাই নতুন এ আইন করতে যাচ্ছে।
গুম অপরাধের সাজা
খসড়া আইনের ৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মচারী বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সদস্য নিজের পরিচয়ের প্রভাব দেখিয়ে নিজে অথবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা সরকারি কোনো কর্তৃপক্ষের অনুমোদন, সমর্থন বা মৌন সম্মতির ক্ষমতাবলে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার, আটক, অপহরণ অথবা অন্য যে কোনোভাবে কোনো ব্যক্তির স্বাধীনতা হরণ করলে এই আইনের বিধান অনুযায়ী তার বা তাদের সাজা হবে।
পাশাপাশি গ্রেপ্তার, আটক, অপহরণ বা স্বাধীনতা হরণের শিকার ব্যক্তির বিষয়টি অস্বীকার করে অথবা ওই ব্যক্তির অবস্থান, অবস্থা বা পরিণতি গোপন রাখা হয় এবং ওই ব্যক্তিকে আইনগত সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত করা হয়, তাহলে সেটাও এই আইনের আওতায় শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
গুমের শাস্তির বিষয়ে আইনের এই ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ গুম-এর অপরাধ সংঘটন করিলে তিনি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বা অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং উক্ত দণ্ডের অতিরিক্ত অনধিক ৫০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।’
এই আইনে সর্বোচ্চ শাস্তির বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘যদি গুমের কারণে ভুক্তভোগীর মৃত্যু ঘটে বা গুম হওয়া ব্যক্তির লাশ পাওয়া যায় অথবা গুমের ঘটনার সাত বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও তাকে জীবিত কিংবা মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা সম্ভব না হয়, তাহলে উক্ত অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তি সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ড বা অন্য কোনো মেয়াদের কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং ওই দণ্ডের অতিরিক্ত অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।
নথি ও তথ্য গোপনের শাস্তির বিধানের বিষয়ে আইনে বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি যদি সজ্ঞানে গুমের সাক্ষ্যপ্রমাণ বিনষ্ট, গোপন, বিকৃত বা পরিবর্তন করেন, তাহলে তিনি অনধিক সাত বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং উক্ত দণ্ডের অতিরিক্ত অনধিক ২০ লাখ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।’
আইনের এ ধারায় আরো বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি যদি কোনো প্রকারের গোপন বা নিয়ম-বহির্ভূত আটক-কেন্দ্র নির্মাণ, স্থাপন বা ব্যবহার করেন, তিনি অনধিক সাত বছর কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং উক্ত দণ্ডের অতিরিক্ত ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।’
গুম হওয়া ব্যক্তির অবস্থান, অবস্থা ও পরিণতি প্রকাশ না করা পর্যন্ত এটি গুমের মতো অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে ও বিচার হবে। গুমের শিকার ও গুম সম্পর্কে জানার পরেও সেটা প্রকাশ না করলে গুমের সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত হবেন ওই ব্যক্তি।
যুদ্ধ পরিস্থিতি ও নিরাপত্তার অজুহাতেও আটক করা যাবে না
আইনের খসড়ার ৬ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই অধ্যাদেশের অধীন শাস্তিযোগ্য কোনো অপরাধ যুদ্ধাবস্থা, যুদ্ধের হুমকি, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা অথবা যে কোনো জরুরি পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে অথবা সরকারি বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ বা নির্দেশ মোতাবেক করা হয়েছে এমন অজুহাত গ্রহণযোগ্য হবে না। তবে, কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তি সরকারি কর্তৃপক্ষ বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ বা নির্দেশ মোতাবেক কাজ করেছেন মর্মে প্রমাণ করতে সক্ষম হলে আদালত ন্যায়বিচারের স্বার্থে উপযুক্ত মনে করলে সাজা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিষয়টি লঘুকারী উপাদান হিসেবে বিবেচনা করতে পারবে।’
স্বাধীন কমিশনের হাতে থাকছে বিপুল ক্ষমতা
আইনের ৭ নম্বর ধারায় একটি কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে। এ কমিশনের দায়িত্ব, ক্ষমতা ও কার্যাবলির বিষয়ে এতে বলা হয়েছে, গুমসংক্রান্ত তথ্য বা অভিযোগ গ্রহণ করতে পারবে কমিশন। এছাড়া গুমের অনুসন্ধান ও তদন্ত পরিচালনা বা ক্ষেত্রমতো তত্ত্বাবধান করা, বিভিন্ন আইনে আটক সম্পর্কিত রক্ষাকবচগুলোর প্রতিপালন পর্যবেক্ষণ করা এবং প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ গ্রহণও করতে পারবে এ কমিশন। এতে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণাধীন কোনো কারাগার, হাজতখানা ও আটক-কেন্দ্রসহ যে কোনো স্থান ও স্থাপনা সরেজমিন পরিদর্শন করার ক্ষমতা থাকবে এ কমিশনের।
আইনে এ বিষয়ে আরো বলা হয়েছে, ‘গোপন আটক-কেন্দ্র শনাক্ত করার উদ্দেশ্যে যে কোনো স্থাপনা পরিদর্শন করা, গোপন আটক-কেন্দ্র শনাক্ত হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া, গুমসংক্রান্ত অভিযোগের অনুসন্ধান বা তদন্ত পরিচালনার স্বার্থে যে কোনো ব্যক্তিকে কমিশনে তলব ও জিজ্ঞাসাবাদ করা, কোনো ব্যক্তি, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে দলিলাদি বা তথ্য সংগ্রহ করা, গুম প্রতিরোধ ও দমনের উদ্দেশ্যে শিক্ষা, গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ ও পরিচালনা করা, দেশের বিভিন্ন থানা ও কমিশনে দায়ের করা গুমসংক্রান্ত সব অভিযোগের তথ্য রেজিস্টার আকারে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা, গুম হওয়া ব্যক্তি কিংবা তার পরিবারের কাছ থেকে গুমসংক্রান্ত ঘটনার বর্ণনা গ্রহণ ও লিপিবদ্ধ করা, উপযুক্ত আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল এবং মামলা দায়েরসহ প্রয়োজনীয় যে কোনো আইনগত পদক্ষেপ নিতে পারবে এ কমিশন।
কমিশন গুম হওয়া ব্যক্তি ও তার স্বজনদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা এবং কর্তব্যে গাফিলতির ক্ষেত্রে দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা ও উপযুক্ত ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট আদালত বা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাতে পারবে।
তদন্ত দল ও তদন্তকারীর ক্ষমতা
প্রস্তাবিত আইনের ৮ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, এ আইনের অধীনে অপরাধের তদন্ত কমিশনের মাধ্যমে বা কমিশনের তত্ত্বাবধানে হবে। এ জন্য এ আইনের আওতায় একটি স্বাধীন তদন্ত দল থাকবে এবং কমিশন ওই তদন্ত দলে প্রয়োজনীয়সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করতে পারবে। এ আইনের অধীন অপরাধের তদন্তের জন্য কমিশন পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার নিম্নে ননÑএমন কোনো কর্মকর্তাকে কিংবা কমিশনের বিবেচনায় উপযুক্ত অন্য যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে তদন্তের ক্ষমতা দিতে পারবে।
আসামি গ্রেপ্তারের বিষয়ে আইনে বলা হয়েছে, ক্ষমতা পাওয়া তদন্তকারী কর্মকর্তার অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার, সরকার বা সরকারের অধীন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বা সংস্থা বা শৃঙ্খলা বাহিনীর যে কোনো পর্যায়ের কর্তৃপক্ষ থেকে প্রতিবেদন বা তথ্য-প্রমাণ তলবসহ থানার অফিসার ইনচার্জের যাবতীয় ক্ষমতা থাকবে এবং যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে সহযোগিতা করতে বাধ্য থাকবে। অভিযুক্ত ব্যক্তি সরকারি কর্মচারী হলে তাকে গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল বা কমিশনের পূর্বানুমতি নিতে হবে এবং এক্ষেত্রে সরকার বা ওই সরকারি কর্মচারীর নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতির প্রয়োজন হবে না।
গুমের বিচারে প্রতি জেলায় হবে ট্রাইব্যুনাল
আইনের অধীনে গুমের ঘটনার বিচারের জন্য অপরাধ আমলে নেওয়া ও বিচারের জন্য দেশের সব বিভাগ বা জেলায় এক বা একাধিক ট্রাইব্যুনাল থাকবে। এটি গুম প্রতিরোধ, প্রতিকার ও সুরক্ষা ট্রাইব্যুনাল নামে অভিহিত হবে।
এ ট্রাইব্যুনাল এই অধ্যাদেশের অধীন অপরাধের বিচার এবং ২০০৩ সালের বিশেষ আদালত আইনের আওতায় স্থানান্তরিত হওয়া মামলারও বিচার করতে পারবে।
ট্রাইব্যুনালের গঠন প্রক্রিয়ার বিষয়ে আইনে বলা হয়েছে, একজন বিচারকের সমন্বয়ে ট্রাইব্যুনাল গঠিত হবে এবং সরকার বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসের জেলা ও দায়রা জজ পদমর্যাদার বিচারকদের মধ্য থেকে এই ট্রাইব্যুনালের বিচারক নিযুক্ত করবে।
অভিযোগকারীর পক্ষে মামলা পরিচালনাকারী ব্যক্তি পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে গণ্য হবেন। এই কাজে কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে সরকার প্রয়োজনীয়সংখ্যক পাবলিক প্রসিকিউটর নিয়োগ করবে। এছাড়া অভিযোগকারী বা ভুক্তভোগী ব্যক্তিগত উদ্যোগেও ট্রাইব্যুনালে আইনজীবী নিয়োগ করতে পারবেন।
বিচার হবে ১২০ দিনে, মিথ্যা অভিযোগেও শাস্তি থাকছে
এ আইনের অধীন অপরাধের বিচার অভিযোগ গঠনের ১২০ দিনের মধ্যে শেষ করতে হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি না হলে সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের বিচারককে পরবর্তী তিন কার্যদিবসের মধ্যে লিখিত ব্যাখ্যা সুপ্রিম কোর্টের কাছে পাঠাতে হবে, যার একটি অনুলিপি সরকারের কাছে পাঠাতে হবে এবং ওই ব্যাখ্যা বিবেচনায় নিয়ে কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বা প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতে পারবে।
আইনের খসড়ায় আরো বলা হয়েছে, ফৌজদারি কার্যবিধি বা অন্য আইনে যা কিছু থাকুক না কেন, এই অধ্যাদেশের অধীন অপরাধ আমলে নেওয়ার ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক সরকার বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের পূর্ব অনুমোদন নেওয়ার আবশ্যকতা প্রযোজ্য হবে না। এ ট্রাইব্যুনালে চূড়ান্তভাবে দণ্ডিত আসামি ৬০ দিনের মধ্যে হাইকোর্টে আপিল করতে পারবেন।
আইনে যেমন গুমের অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে, তেমনি অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হলেও বাদীর বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির কথা বলা হয়েছে। এ বিষয়ে আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো অপরাধের বিচার সম্পন্ন হওয়ার পর রায় দেওয়ার সময় যদি ট্রাইব্যুনালের কাছে সন্তোষজনকভাবে প্রমাণিত হয় যে, কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ মিথ্যা ও হয়রানিমূলক, তাহলে ওই ট্রাইব্যুনাল মামলা বা অভিযোগ দায়েরকারী ব্যক্তিকে কারণ দর্শানোর সুযোগ দিয়ে সংশ্লিষ্ট অভিযুক্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের বরাবর যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আদেশ দিতে পারবে এবং প্রয়োজন মনে করলে ক্ষতিপূরণের আদেশ দেওয়ার পাশাপাশি ওই মামলা বা অভিযোগ দায়েরকারী ব্যক্তিকে অনধিক দুবছর সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দিতে পারবে।
যা বলছেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল
গুমের বিচার ও সরকারের উদ্যোগের বিষয়ে তিনটি প্রশ্ন ছিল আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুলের কাছে। জবাবে আমার দেশকে তিনি বলেন, ‘গুমের বিচার নিশ্চিত করার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার বদ্ধপরিকর। সরকার দায়িত্ব নেওয়ার ২১ দিনের মাথায় ২৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক গুম কনভেনশনে স্বাক্ষর করে এর অংশীদার হয়েছে। বিগত আমলে গুমের যত ঘটনা ঘটেছে, সে বিষয়ে তদন্তের জন্য আমরা সরকার গঠনের পরপরই গুম ইনকোয়ারি কমিশন গঠন করেছি। ওই কমিশন ইতোমধ্যে প্রায় দুই হাজার গুমের অভিযোগ নিয়ে কাজ করছে, আগামী ডিসেম্বরে তারা কাজ শেষ করবে। আমরা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধন করে ওই ট্রাইব্যুনালে পরিকল্পিত ও ব্যাপক গুমের ঘটনাগুলোর বিচার করার ব্যবস্থা করেছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘বর্তমানে প্রায় ১০০ গুমের অভিযোগ নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কাজ করছে। তবে এ ট্রাইব্যুনালের সীমাবদ্ধতা হলো আদালতটি আইনত সব ধরনের গুমের বিচার করতে পারে না। এটি কেবল ব্যাপক ও পরিকল্পিত পদ্ধতিতে সংঘটিত গুমের বিচার করতে পারে। মানবাধিকার লঙ্ঘন-সংক্রান্ত যেসব গুম হয়েছে, সেগুলোর বিচারের জন্য আমাদের পৃথক আইন ও ট্রাইব্যুনাল করতে হচ্ছে। আমরা সেই কাজ প্রায় সম্পন্ন করেছি।’
গুম কমিশন এবং ব্লাস্টসহ কয়েকটি সংগঠন ও সংস্থা গুমের বিচারে আইন প্রণয়নসহ কিছু সুপারিশ করেছে। আইন মন্ত্রণালয়ও সেমিনারের মাধ্যমে মতামত নিয়েছে। সরকার নতুন আইনের বিষয়ে কী উদ্যোগ নিয়েছেÑএমন প্রশ্নের জবাবে আসিফ নজরুল বলেন, গুমকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করে তার বিচারের জন্য আমরা আইন মন্ত্রণালয় থেকে এরই মধ্যে ‘গুম প্রতিরোধ, প্রতিকার ও সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়া চূড়ান্ত করেছি। এই খসড়া তৈরির ক্ষেত্রে গুম ইনকোয়ারি কমিশন, ব্লাস্ট, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া হয়েছে এবং গুরুত্বের সঙ্গে তাদের মতামত আইনে প্রতিফলন করা হয়েছে। এ আইনে গুমের অপরাধের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে, গুমের বিচার নিশ্চিত করার জন্য পৃথক তদন্ত দল, পৃথক ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান রাখা হয়েছে, গুমের ভুক্তভোগীদের জন্য ক্ষতিপূরণসহ পৃথক তহবিলের ব্যবস্থা করা হয়েছে, গুম হওয়া ব্যক্তির সম্পত্তি থেকে গুম হওয়া ব্যক্তির নির্ভরশীল সদস্যরা যেন ভরণ-পোষণ পেতে পারেনÑতার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এবং ভুক্তভোগী ও সাক্ষীদের সুরক্ষার বিধান রাখা হয়েছে। আশা করছি, কিছুদিনের মধ্যেই আইনটি কার্যকর করে গুমের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করা হবে।
প্রস্তাবিত আইনে শেখ হাসিনার আমলে আয়নাঘরসহ বিভিন্নভাবে গুমের শিকার ব্যক্তিদের বিচার পাওয়ার অধিকার সংরক্ষণ থাকছে কি নাÑএমন প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা বলেন, যে আন্তর্জাতিক আইন অনুসরণ করে এ আইনটি তৈরি করা হচ্ছে, সেখানে গুমকে ‘চলমান অপরাধ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ‘চলমান অপরাধ’ হওয়ার ফলে প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন না হওয়া পর্যন্ত গুম অভিযুক্ত ব্যক্তির অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। ফলে এ আইন কার্যকর হওয়ার আগে যত গুমের ঘটনা ঘটেছে, সব ঘটনার বিচার এ আইনের অধীনে করা সম্ভব হবে। বিগত আমলে যারা আয়নাঘরসহ নানাভাবে গুমের শিকার হয়েছেন, তাদের সবাই এ আইনের আওতায় বিচার পাবেন।