Image description

শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনামলে গুম থেকে ফেরা দুই শতাধিক ব্যক্তি লিখিত অভিযোগ করেছেন যে, জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায়ে পুলিশের সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেটরাও যৌথভাবে ভূমিকা রেখেছেন। তাদের অধিকাংশ জানান, গুমকালীন তাদের নির্যাতনের পর পুলিশের লিখে দেওয়া বক্তব্য হুবহু স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়েছিল।

গুম থেকে ফেরা ব্যক্তিদের সংগঠন ‘ভয়েস অব এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ার্ড পারসন্স (ভয়েড)’ এই অভিযোগনামা লিখিতভাবে তৈরি করেছে। ভুক্তভোগীদের বেশিরভাগই গুম-সংক্রান্ত কমিশনে পৃথকভাবে তাদের অভিযোগ জমাও দিয়েছেন। অনেকে এ নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলাও করেছেন। গুমের শিকার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তৎকালীন সরকারের বাহিনীগুলো যে মামলা করেছিল, সেসব মামলা থেকে অনেকে খালাস পেয়েছেন, বাকিরা খালাস পেতে আবেদন করেছেন।

অভিযোগ অনুযায়ী, স্বীকারোক্তি আদায় শুধু পুলিশের কাজ ছিল না; অনেক ক্ষেত্রে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটরাও পুলিশের সাজানো বক্তব্যকে বৈধতা দিয়েছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ম্যাজিস্ট্রেটের ভূমিকা গুমকারীদের মতোই ছিল। নারী শিক্ষার্থী, দিনমজুর, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এসব অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন।

ভয়েড-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা গুমফেরত প্রকৌশলী মাসরুর আনোয়ার চৌধুরী আমার দেশকে বলেন, ‘শেখ হাসিনার শাসনামলে স্বীকারোক্তি আদায়ের প্রক্রিয়া কেবল পুলিশের নির্যাতনের ওপর নির্ভরশীল ছিল না; বরং অনেক ক্ষেত্রেই আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটরাও তা বৈধতা দিতে সহায়তা করেছেন। ভুক্তভোগীদের ভাষায়, এ ধরনের আচরণ বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি করেছে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের স্পষ্ট উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ তিনি বলেন, ভয়েডের সদস্য দুই শতাধিক। গুম করে তাদের বিরুদ্ধে মামলার পর বেশিরভাগেরই জবানবন্দি আদায়ের ক্ষেত্রে তৎকালীন কিছু অসৎ পুলিশ কর্মকর্তা ও ম্যাজিস্ট্রেট যৌথভাবে কাজ করেছেন।

স্বীকারোক্তি আদায়ের লোমহর্ষক বর্ণনা

ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারার বিধানমতে, হলি আর্টিজান হামলার আসামি হাদিসুর রহমানের লিখিত বক্তব্যে উঠে এসেছে স্বীকারোক্তি আদায়ের চাঞ্চল্যকর বর্ণনা।

হাদিসুর বলেন, ‘…ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে এসি ইমরান বসে ছিলেন। ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশকে বলে, কী আনছেন দেন। পুলিশ তখন টাইপ করা কাগজ ম্যাজিস্ট্রেটকে দেয়। ম্যাজিস্ট্রেট বলেন স্বাক্ষর কর। আমি বলি, না পড়ে আমি স্বাক্ষর করব না। ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশকে চোখ টিপ দিয়ে বলেন, একে নিয়ে যান। পুলিশ আমাকে ম্যাজিস্ট্রেটের খাসকামরার পাশে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে হাত-পা, চোখ-মুখ বেঁধে নির্যাতন করে, বুট দিয়ে লাথি দিয়ে আমার পায়ের আঙুল থেঁতলে দেয়। একটু পর আবার ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নিয়ে আসে। তখনো পুলিশ অফিসার ম্যাজিস্ট্রেটের কামরায় ছিলেন।’

‘এরপর আমি ম্যাজিস্ট্রেটকে বলি, স্যার, আপনার সঙ্গে আমি কথা বলব। ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশকে বাইরে যেতে বলেন। আমি ম্যাজিস্ট্রেটকে বলি, স্যার দেখুন আমাকে কীভাবে নির্যাতন করেছে, আমার পায়ের আঙুল থেঁতলে দিয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেট তখন বলেন, স্বাক্ষর দে বাবা, না হলে আরো বেশি মারবে। এ কথা শুনে আমি হতবাক হয়ে যাই। বলি, স্বাক্ষর করব না। ম্যাজিস্ট্রেট তখন বলেন, ও স্বাক্ষর করবে না। ওকে নিয়ে যান, আচ্ছামতো বানাবেন; কোনোরকম যেন বেঁচে থাকে। এরপর কোর্ট গারদে জমা দিয়ে যাবেন।’

হোলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলার তদন্তেও অনেক আসামির পুলিশি নির্মমতা এড়িয়ে গিয়েছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায়ে পুলিশের সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেটের যোগসাজশের অভিযোগ উঠে এসেছে সেই মামলায় আমৃত্যু সাজাপ্রাপ্ত কয়েকজন আসামির বর্ণনায়।

আমৃত্যু সাজাপ্রাপ্ত আসামি সবুর খানের পক্ষে তার ভাই হাফিজুল ইসলাম গুম-সংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারিতে জমা দেওয়া চিঠিতে তার ভাইকে গুমের পর নির্যাতন ও ম্যাজিস্ট্রেটের উদাসীনতার অভিযোগ তোলেন।

গুম-সংক্রান্ত কমিশনে সবুর লেখেন, ২০১৭ সালের ১০ মে তাকে নাচোল থেকে আটক করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পুলিশ। এরপর বগুড়া ডিবির বিভিন্ন কর্মকর্তার নেতৃত্বে তাকে কয়েক সপ্তাহ ধরে একাধিক স্থানে আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। এ সময় তার হাত ও চোখ বেঁধে রাখা হতো, ঘুমতে দেওয়া হতো না এবং ক্রমাগত ভয় দেখানো হতো। এরপর তাকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কোনো সত্যিকারের শুনানি বা তদন্ত ছাড়াই পুলিশের তৈরি কাগজে জোরপূর্বক স্বাক্ষর করানো হয়। পুলিশ হুমকি দিত যে, স্বীকারোক্তি না দিলে তার বিপদ হবে। এভাবে পুলিশের নির্যাতন ও ম্যাজিস্ট্রেটের যোগসাজশের মাধ্যমে তাকে জোরপূর্বক ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করা হয়।

ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখার কারণে গুম হয়েছিলেন ইমরান হুসাইন। বর্তমানে শিক্ষকতা পেশায় জড়িত ইমরান বলেন, ‘আমার জবানবন্দি নেওয়ার সময় তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন ইকবাল আহম্মেদ। জবানবন্দি চলাকালীন একাধিকবার তদন্ত কর্মকর্তা প্রাইভেট রুমে প্রবেশ করে ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে কানে কানে কথা বলেন। একবার জিআরও পুলিশের মাধ্যমে চিরকুট পাঠানো হয়। জবানবন্দিতে আমি গুম ও অত্যাচারের কথা উল্লেখ করলেও তা লেখা হয়নি। বরং এমন কিছু লেখা হয়েছে, যা আমি বলিনি। শেষ পর্যন্ত আমাকে জবানবন্দিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়।’

গুমফেরত শিক্ষার্থী খালেদ সাইফুল্লাহ বলেন, ‘মাদারীপুরের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জাকির হোসেনের সামনে আমাকে ডাণ্ডাবেড়ি ও হাতকড়া পরিয়ে উপস্থিত করা হয়। সন্ধ্যা আনুমানিক ৬টায় আমাকে ম্যাজিস্ট্রেটের খাসকামরায় নিয়ে যাওয়া হয়। ম্যাজিস্ট্রেট রূঢ় আচরণ করেন এবং হুমকি দেন যে, জবানবন্দি না দিলে পুলিশ আমাকে মেরে ফেলবে।’

একাডেমিয়ায়ে উলুমুল হাদিসের এই শিক্ষার্থী আরো বলেন, ‘ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাদবীর ইয়াছির আহসান চৌধুরীও খারাপ আচরণ করেছিলেন। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়ার সময় বাইরে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিরাজুম মনিরাসহ অন্যান্য পুলিশ অস্ত্র তাক করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন দেখানোর পরও ম্যাজিস্ট্রেট কোনো ব্যবস্থা নেননি। বরং বলেছিলেন, তোমাকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতেই হবে।’ মাদারীপুরের অধিবাসী খালেদ সাইফুল্লাহ পরবর্তীতে সব মামলায় খালাস পেয়েছেন।

সিলেটের ছাতক মাদরাসার শিক্ষার্থী মো. লুকমান মিয়া ১৬ মাস র‌্যাব-৭-এর কাছে গুম ছিলেন। তিনি বলেন, ‘রাঙামাটিতে একটি মামলায় আদালতে তোলা হলে র‌্যাবের এডিসি ইকবাল ও একজন ম্যাজিস্ট্রেট জোর করে জবানবন্দি নিতে চান। অস্বীকার করলে দুজনই হত্যার হুমকি দেন। র‌্যাবের ইকবাল বলেন, এরে সারা বাংলাদেশে ১৫টা মামলা দিয়ে দেব, দেখব কীভাবে আলোর মুখ দেখে।’

রাজধানীর মাতুয়াইলের রফিকুল ইসলাম স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান বলেন, গুম অবস্থায় ভেবেছিলাম ম্যাজিস্ট্রেট নিরপেক্ষ থাকবেন। কিন্তু আদালতে তোলা হলে ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, সাইন করো। আমি পড়তে চাইলে উত্তর আসে, ‘তোমার জায়গা-জমি লিখে নিচ্ছি না’। অস্বীকার করলে পুলিশ লাথি মারে এবং বাবা-মাকে তুলে আনার হুমকি দেয়। পরে ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, ‘আজ না দিলে কাল অস্ত্র মামলায় চাইব, তারপর হত্যা মামলায় চাইব। দেখি কটা না দিতে পারিস। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে স্বীকারোক্তি দিই।’

গুমফেরত কয়েকজন বলেন, তাদের নিজ হাতে লিখতে দেওয়া হয়নি, জানানো হয়নি যে স্বীকারোক্তি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার হতে পারে। কেউ কেউ জানান, পুলিশ জোর করে লিখিয়ে নিয়েছে, আবার কারো কারো গায়ে চড়-থাপ্পড় দিয়েছেন ম্যাজিস্ট্রেটরাই।

গুমফেরত এক ব্যক্তি বলেন, ‘আমি ১৬৪ দিইনি, এজন্যই ম্যাজিস্ট্রেট প্রাণনাশের ভয় দেখিয়েছিলেন।’

তোমরা নাকি শুধু হিন্দু মারোÑম্যাজিস্ট্রেটের প্রশ্ন

জেএমবি-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে পুলিশের সাজানো মামলায় প্রায় সাড়ে ছয় বছর বিনাবিচারে নরসিংদী কারাগারে বন্দি ছিলেন মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রী ইসরাত জাহান মৌ ও খাদিজা পারভীন মেঘনা। ২০১৮ সালে গুমের পর নরসিংদীর নিলুফার ভিলায় নিয়ে গিয়ে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) একটি জঙ্গি নাটক মঞ্চস্থ করে। তাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা ছয়টি মামলার মধ্যে হত্যা মামলা থেকে ইতোমধ্যে খালাস পেয়েছেন তারা।

জামিনে মুক্ত মেঘনা জানান, রাতে হঠাৎ একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রথমে ইশরাত জাহান মৌ, পরে তাকে এক নারী জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করা হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক। ম্যাজিস্ট্রেট প্রশ্ন করেন, ‘কীভাবে জঙ্গি হয়ে উঠলেন?’ জবাবে মেঘনা বলেন, ‘আমরা জঙ্গি নই, সবই সাজানো নাটক।’ কিন্তু তাদের কোনো বক্তব্য শোনা হয়নি।

তিনি আরো বলেন, ভীতিকর পরিবেশে রাইফেল হাতে পুলিশ ছিল। আব্দুর রাজ্জাক ওই জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে নানাভাবে প্রভাবিত করছিলেন। এমন সময় ম্যাজিস্ট্রেট ফোনে বলেন, ‘ওরা বলছে ওরা জঙ্গি নয়, আর বাসা থেকেও কিছু পাওয়া যায়নি।’ এরপর আবার তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘তোমরা নাকি শুধু হিন্দু মারো?’ মেঘনা জবাব দেন, ‘আমরা তো ছাত্রী, হিন্দু মারব কেন?’ কিন্তু তাতেও সন্দেহ কাটেনি।

মেঘনা অভিযোগ করেন, তারা স্বাক্ষর না করলে একজন নারী পুলিশ ডেকে আনা হয়। তিনি জোর করে প্রতিটি পাতায় স্বাক্ষর করিয়ে নেন। পরে জানতে পারেন, এই স্বাক্ষরকে স্বীকারোক্তি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।

অন্য আসামি ইশরাত জাহান মৌ বলেন, ‘একজন নারী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আমাকে নেওয়া হয়। আমি হাতকড়ার দাগ ও নির্যাতনের চিহ্ন দেখাই। কিন্তু তিনি কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি, বরং পুলিশের লিখে দেওয়া খসড়ায় স্বাক্ষর দিতে বাধ্য করেন।’

একই মামলার আরেক আসামি রাকিবুল হাসান ওয়ালিদ জানান, ‘আমাদের সবার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নরসিংদীর তৎকালীন অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শামীমা আক্তার নিয়েছিলেন।’

বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ও হকার সবার একই অভিযোগ

২০১৭ সালের ১৫ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে জাতীয় শোক দিবস পালনের প্রস্তুতির সময় ঢাকার পান্থপথের ওলিও ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে পুলিশ ও সোয়াটের যৌথ অভিযানে খুলনার বিএল কলেজের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম নিহত হন। তার পরিবার জানায়, তিনি চাকরির খোঁজে ঢাকায় এসেছিলেন।

এ ঘটনায় পরে ১৩ জনকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে আসামি করা হয়। ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন, পুলিশের নির্যাতনের পাশাপাশি কিছু ম্যাজিস্ট্রেটও স্বীকারোক্তি আদায়ে সহযোগিতা করেছেন। মামলার আসামি তানভীর ইয়াসিন করিম আদালতে জানান, নির্যাতনের পরও ম্যাজিস্ট্রেট তাকে আরো রিমান্ডের হুমকি দিয়ে জবানবন্দি দিতে বাধ্য করেছিলেন। একই মামলার আসামি কাসেম বলেন, নির্যাতনের স্পষ্ট চিহ্ন থাকা সত্ত্বেও ম্যাজিস্ট্রেট সাদবীর ইয়াছির আহসান চৌধুরী কোনো তদন্ত না করে পুলিশের খসড়া কাগজে স্বাক্ষর দিতে চাপ দেন। অর্থাৎ, সন্ত্রাসবিরোধী আইনের বিধান এখানে মানা হয়নি।

স্বীকারোক্তি আদায় নিয়ে যা হয়েছে, সে সম্পর্কে সাবেক জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের বর্ণনা

ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪(১) ধারা অনুযায়ী মেট্রোপলিটন বা প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা সরকার কর্তৃক অনুমোদিত দ্বিতীয় শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট আসামির জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করতে পারেন। আইনে স্পষ্টভাবে বলা আছে, আসামি জবানবন্দি দিতে বাধ্য নন; চাইলে তা প্রত্যাহার করতে পারবেন। ম্যাজিস্ট্রেটকে নিশ্চিত হতে হবে যে, জবানবন্দি স্বেচ্ছায় দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া ৩৬৪ ধারায় বলা হয়েছে, আসামির বক্তব্য তার নিজস্ব ভাষায় রেকর্ড করতে হবে, পড়ে শোনাতে হবে এবং স্বাক্ষরের আগে নিশ্চিত হতে হবে যে, আসামি তা বুঝেছেন।

সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯-এর ২৩ ধারায় আসামিদের স্বীকারোক্তি আদায়ের ক্ষেত্রে বিশেষ বিধান রাখা হয়েছে। ২৩ ধারায় আছে, ‘অভিযুক্ত ব্যক্তির স্বীকারোক্তি রেকর্ড সম্পর্কিত বিশেষ বিধান : যে কোনো মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট অথবা এতদুদ্দেশ্যে বিশেষভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত যে কোনো ম্যাজিস্ট্রেট অভিযুক্ত ব্যক্তি কর্তৃক প্রদত্ত স্বীকারোক্তিমূলক কোনো বক্তব্য রেকর্ডকালে, যদি উক্ত ব্যক্তি ঘটনা সম্পর্কে লিখিতভাবে বিবৃতি প্রদান করিতে সক্ষম ও আগ্রহী হন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তিকে তাহার স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্য স্বহস্তে লিপিবদ্ধ করিবার অনুমতি প্রদান করিবেন।’

কিন্তু একাধিক আলোচিত মামলার বর্ণনা প্রমাণ করে যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে এসব বিধান মানা হয়নি। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের কোনো মামলাতেই জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটরা আসামিদের স্বহস্তে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি লিখতে দেননি। বরং তারা নিজেরাই পুলিশের কথামতো তথাকথিত স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি লিখেছেন।

সাবেক জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও বর্তমানে উচ্চ আদালতে আইন পেশায় যুক্ত অ্যাডভোকেট শেখ ওমর আমার দেশকে বলেন, ‘আসামিদের জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায়ের ক্ষেত্রে কোনো কোনো জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক পুলিশকে সহযোগিতা করার বিষয়টি অসম্ভব নয়। শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশের সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা হয়েছিল। বিচার বিভাগেও একটি বড় সংখ্যার বিচারক তখন স্বৈরাচারের পদলেহনে ব্যস্ত ছিলেন। এমনকি সন্ত্রাসবিরোধী আইনে আসামিদের স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য যে বিশেষ বিধান রাখা হয়েছিল, সেটিও তারা মানেননি।’