Image description
সীমানা পুনর্নির্ধারণে শুনানি

সীমানা পুনর্নির্ধারণের ওপর তৃতীয় দিনের শুনানিতে অংশ নিয়ে ২০০১ সালের আসন ফেরত চেয়েছেন বেশ কয়েক জেলার বাসিন্দারা। ঢাকার নবাবগঞ্জ ও দোহার, মানিকগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জসহ কয়েকটি এলাকার বাসিন্দারা ২০০৮ সালে কেটে নেওয়া আসন ফেরত দেওয়ার জোরালো দাবি জানিয়েছেন। ২০০১ সালের সীমানা অনুযায়ী নবাবগঞ্জ ও দোহার উপজেলাকে পৃথক আসন করার স্বপক্ষে শুনানিতে অংশগ্রহণকারীরা বাস্তবসম্মত নানা যুক্তি তুলে ধরেন। নির্বাচন কমিশনের পুনর্নির্ধারিত খসড়া সীমানায় তাদের আসন ফেরত না আসায় এলাকার হাজার হাজার ভোটারের পক্ষে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। অপরদিকে ঢাকার সাভার ও আশুলিয়া উপজেলার বাসিন্দারাও পৃথক আসন চেয়ে তাদের যুক্তি উপস্থাপন করেন।

এদিকে একটি আসন বাড়ানোয় নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) ধন্যবাদ জানিয়েছেন গাজীপুর বিএনপির কয়েকজন নেতা। এছাড়া ঢাকা-২, ৩ ও ১৯, নারায়ণগঞ্জ-৩ ও ৫ আসনসহ কয়েকটি আসনের সীমানা পরিবর্তনের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি তুলেছেন সংশ্লিষ্ট আবেদনকারীরা।

মঙ্গলবার ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও নরসিংদী জেলার ২৮টি আসনের ওপর ৩০৯টি আবেদনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে ২৫৯টি খসড়া সীমানার বিরুদ্ধে এবং পক্ষে ৫০টি আবেদন ছিল। ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদের সঞ্চালনায় শুনানিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন ও চার নির্বাচন কমিশনার উপস্থিত ছিলেন। আজ বুধবার পঞ্চগড়, রংপুর, কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, টাঙ্গাইল, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, ফরিদপুর, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলার ১৮টি আসনের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্য দিয়ে চারদিনের শুনানি শেষ হবে। এরপর নির্বাচন কমিশন যেকোনো সময়ে চূড়ান্ত সীমানার তালিকা প্রকাশ করবে।

২০০১ সালের সীমানা ফেরানোর দাবি : ২০০১ সালের আসনে ফেরত যাওয়ার দাবি জানিয়েছেন ঢাকার দোহার ও নবাবগঞ্জবাসী এবং মুন্সীগঞ্জ ও মানিকগঞ্জবাসী। শুনানিতে দোহার ও নবাবগঞ্জ সংসদীয় আসন (ঢাকা-১ ও ২) পুনরুদ্ধার কমিটির আহ্বায়ক মো. হুমায়ূন কবীর নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশে বলেন, বিগত সরকারের স্বৈরাচারী ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার অন্যতম হাতিয়ার ছিল ঢাকার আসন ১৩টি থেকে বাড়িয়ে ২০টি করা। ওই সরকারের সব কর্মকাণ্ড ছিল ঢাকাকেন্দ্রিক। বিগত সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক আন্দোলন সংগ্রামে স্বৈরাচার সরকার শুধু ঢাকাকে নিয়ন্ত্রণ করে পুরো দেশ পরিচালনা করত। তাই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা আবারও কোনো স্বৈরাচারী সরকার চাই কিনা। আগামী দিনে স্বৈরাচার নাকি জনবান্ধব সরকার আসবে তা অনেকাংশেই নির্ভর করছে ইসির ওপর। আপনারা যদি আগামীতে স্বৈরাচার সরকার না চান, তাহলে ২০০৮ সালে কমবেশি ১৫০ আসন কাটাছেঁড়া করা নির্বাচনি সীমানা পুনর্নির্ধারণ করতে হবে। তিনি বলেন, ২০০৮ সালের আগের সব নির্বাচনে দোহার উপজেলা নিয়ে ঢাকা-১ আসন এবং নবাবগঞ্জ উপজেলা নিয়ে ছিল ঢাকা-২ আসন। এই দুই আসনের বেশির ভাগ মানুষ মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী হওয়ার অপরাধে ২০০৮ সালে দুটি আসনকে একটিতে রূপান্তর করা হয়েছে। গত ১৭ বছর আমাদের এলাকায় কোনো উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। আটটি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে দোহার এবং ১৪টি ইউনিয়ন নিয়ে নবাবগঞ্জ আলাদা আলাদা স্বতন্ত্র প্রশাসনিক এলাকা। দুই উপজেলা মিলে আয়তন ৪০০ বর্গকিলোমিটারের উপরে। এতবড় সংসদীয় আসন একজন জনপ্রতিনিধির প্রতিনিধিত্ব করা কঠিন। তিনি দোহার উপজেলাকে ঢাকা-১ ও নবাবগঞ্জ উপজেলাকে ঢাকা-২ আসন নির্ধারণ করার দাবি জানান।

জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস) যুগ্ম-আহ্বায়ক ও দোহারের বাসিন্দা কেএম খালেদুজ্জামান জুয়েল শুনানিতে বলেন, ২০০৮ সালে ফ্যাসিজম কায়দায় নবাবগঞ্জ ও দোহার উপজেলা মিলিয়ে একটি আসন করা হয়। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর এখনো সেই চিত্র দেখছি। গাজীপুরে একটি আসন বাড়ানো হলো। তিনি ইসিকে প্রশ্ন রেখে বলেন, ঢাকা জেলায় কি জনগণ বাড়েনি? তিনি ২০০১ সালের সীমানা অনুযায়ী, নবাবগঞ্জ ও দোহার উপজেলাকে পৃথক আসন করার দাবি জানান। জাতীয় নাগরিক পার্টির-এনসিপি ঢাকা জেলার প্রধান সমন্বয়ক মো. রাসেল, জাসাস’র সাবেক সহ-সভাপতি সালাহউদ্দিন মোল্লাসহ আরও কয়েকজন তাদের বক্তব্যে একই দাবি জানান।

শুনানিতে মানিকগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জের আসন পুনর্বহালের দাবি জানিয়েছেন দুটি জেলার প্রতিনিধিরা। মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপির আহবায়ক আফরোজা খানম রিতা বলেন, আমি এখানে এসেছি মানিকগঞ্জের সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে। ২০০১ সালের ন্যায় মানিকগঞ্জে চারটি আসনের দাবি মানিকগঞ্জের সব স্তরের মানুষের। মানিকগঞ্জের প্রতিনিধি ব্যারিস্টার খাইরুল আলম চৌধুরী বলেন, ২০০১ সাল পর্যন্ত মানিকগঞ্জ জেলায় চারটি সংসদীয় আসন ছিল। ২০০৮ সালে মানিকগঞ্জে একটি আসন কমিয়ে তিনটি করা হয়। এতে করে সংসদে মানিকগঞ্জের জনগণের প্রতিনিধিত্ব কমেছে। চারটি আসন থাকায় মানিকগঞ্জে যে বরাদ্দ ছিল তা কমে গেছে। আমরা ২০০১ সালের আসনে ফেরত যাওয়ার পক্ষে যৌক্তিকতা তুলে ধরেছি।

অপরদিকে মুন্সীগঞ্জের নাগরিক অধিকার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক রনি মল্লিক বলেন, মুন্সীগঞ্জে এখন তিনটি আসন রয়েছে। এ আসন সংখ্যা বাড়িয়ে ২০০১ এর মতো চারটি আসন করার জন্য আমরা দাবি জানিয়েছি। সেইসঙ্গে প্রবাসীদের ভোটাধিকারের বিষয়গুলো তুলে ধরেছি।

আসন বাড়ানোয় ইসিকে ধন্যবাদ গাজীপুর বিএনপির : গাজীপুরে একটি আসন বাড়ানোয় নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন গাজীপুর বিএনপি নেতারা। গাজীপুরের প্রতিনিধিরা দাবি-আপত্তির শুনানিতে এসে ছোটখাটো অভিযোগ থাকলেও তা উপেক্ষা করে ইসির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন। শুনানিতে বিএনপি নেতা একেএম ফজলুল হক মিলন বলেন, আমাদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা ছিল গাজীপুরে আসন বাড়ানোর। সিইসি ও অন্য যে নির্বাচন কমিশনার বর্তমানে রয়েছেন, তারা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতায় এক নম্বরে রয়েছেন। বেশি প্রশংসা করব না। আপনারা গাজীপুরবাসীর প্রতি যে বদান্যতা দেখিয়েছেন তাতে আমরা কৃতজ্ঞ। সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ইসিকে যেকোনো ধরনের সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি। কৃতজ্ঞতার জবাবে শুনানি শেষে মঞ্চ থেকে ইসি সচিব বলেন, ‘আপনারা এসেছেন, এতেই আমরা ধন্য।’

অন্য আসনের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি : ইসিতে শুনানি থেকে বেরিয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা যুবদলের সাবেক সভাপতি মাকসুদুল খন্দকার খোরশেদ সাংবাদিকদের বলেন, এখানে আমি প্রতিবাদ জানাতে এসেছিলাম। আমাদের নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন থেকে পাঁচটি ইউনিয়নকে কেটে সোনারগাঁ (নারায়ণগঞ্জ-৩) আসনের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ফলে নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের মানুষ রাজনৈতিক, সামাজিক ও ভৌগোলিকভাবে বঞ্চনার শিকার হয়েছে। সেই বঞ্চনার কথা কমিশনকে আমি জানিয়েছি। এখন যদি একটি বিরাট অংশ বিভক্ত হয়ে সোনারগাঁয়ের সঙ্গে চলে যায়; আমরা এতদিনে যে নেতাকর্মী তৈরি করেছি তাদের মধ্যে অনেকে প্রার্থী আছে। আমরা সবাই বঞ্চিত হব। খোরশেদ দাবি করেন, সবচেয়ে বড় কথা, নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়ন কেটে নেওয়া হচ্ছে। ফলে যে প্রশাসনিক অখণ্ডতার কথা বলা হয়েছে তা পুরোপুরি লঙ্ঘন করা হচ্ছে।

অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান বলেন, প্রস্তাবিত পাঁচ আসনের মধ্যে তিনটি থানার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সিদ্ধিরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ সদর এখন বন্দরের একাংশ। তিনটি থানা নিয়ে আমাদের নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আমরা এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছি। আমরা চাই সোনারগাঁয়ের সাথে থাকতে। ২০০৮ সালে সোনারগাঁ, সিদ্ধিরগঞ্জ মিলে আসন ছিল নারায়ণগঞ্জ-৩। তেমনি করতে হবে।

ঢাকা-২, ৩ ও ১৯ আসন নিয়ে শুনানিতে খসড়া সীমানার পক্ষে-বিপক্ষে বক্তব্য রাখেন বেশ কয়েকজন। মেজর (অব.) মিজানুর রহমান বলেন, ঢাকা-২, ৩ ও ১৯ আসনের সীমানা নির্ধারণে ইসি নিজের নীতিমালাই লংঘন করেছে। সাভার উপজেলায় ৯ লাখ ৬৫ হাজার, আশুলিয়া উপজেলায় ১৩ লাখ এবং কেরানীগঞ্জ উপজেলায় ১০ লাখ জনসংখ্যা রয়েছে। নির্বাচন কমিশন এই তিন উপজেলার অখণ্ডতা লঙ্ঘন করেছে। তিনি কেরানীগঞ্জ, সাভার ও আশুলিয়া উপজেলাকে পৃথক তিনটি আসন করার দাবি জানান।

রাওয়া ক্লাবের সভাপতি মোহাম্মদ আব্দুল হক বলেন, কেরানীগঞ্জে ব্যক্তিস্বার্থে আসন বিন্যাস করা হয়েছিল। সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ও সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের স্বার্থে কেরানীগঞ্জকে দুটি আসন করা হয়েছে। এতে প্রশাসনিক অখণ্ডতা রক্ষা করা হয়নি। তিনি প্রশাসনিক অখণ্ডতা রক্ষার দাবি জানান। শুনানিতে অন্য আসনগুলোর পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন আবেদনকারীরা।