Image description
 

মাগুরার শিশু আছিয়া ধর্ষণ ও হত্যা মামলার ডেথ  রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের নথি) চলতি বছরের ২১ মে হাইকোর্টে এসেছে। মাগুরার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল প্রধান আসামি হিটু শেখকে মৃত্যুদণ্ড দেন। বাকি তিন আসামিকে খালাস দেওয়া হয়। নথিটি ইতোমধ্যেই হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখায় পাঠানো হয়েছে। শিশু আছিয়া গত মার্চে বেড়াতে গিয়ে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। দীর্ঘ চিকিৎসার পর ১৩ মার্চ তার মৃত্যু হয়। আদালতের রায় অনুযায়ী মামলাটি এখন উচ্চ আদালতের অনুমোদনের অপেক্ষায়।
দেশের আদালতগুলোতে ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামির রায় অনুমোদনের জন্য উচ্চ আদালতে পাঠানো) মামলার নিষ্পত্তির হার আশানুরূপ নয়। বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, আপিল নিষ্পত্তিতে বিলম্ব এবং রাষ্ট্রপক্ষের প্রস্তুতির ঘাটতির কারণে এ ধরনের মামলার নিষ্পত্তি ধীরগতির হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে শত শত ডেথ রেফারেন্স মামলার জট রয়েছে।

 

এতে শুধু আসামির অধিকার ক্ষুণœ হচ্ছে না বরং ন্যায়বিচারও বিলম্বিত হচ্ছে। আইনজ্ঞদের মতে, ডেথ রেফারেন্স মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া উচিত, কারণ এসব মামলায় একজন ব্যক্তির জীবন ও মৃত্যুর প্রশ্ন জড়িত থাকে। অথচ বাস্তবে  এসব মামলা নিষ্পত্তিতে কয়েক বছর লেগে যাচ্ছে।
মামলার জট ও দীর্ঘসূত্রতা ॥ বাংলাদেশে মৃত্যুদ- কার্যকরের আগে হাইকোর্টের অনুমোদন বাধ্যতামূলক। কিন্তু এ ধরনের মামলার নিষ্পত্তির হার আশানুরূপ নয়। দীর্ঘসূত্রতা, আপিল নিষ্পত্তিতে বিলম্ব, পেপারবুক তৈরিতে দেরি এবং রাষ্ট্রপক্ষের প্রস্তুতির ঘাটতির কারণে মামলাগুলো বছরের পর বছর ঝুলে থাকে। এতে ন্যায়বিচার বিলম্বিত হওয়ার পাশাপাশি আসামিদের অধিকারও ক্ষুণœ  হয়। গত ২১ বছরে ডেথ রেফারেন্স মামলা দ্বিগুণ হয়েছে।

বর্তমানে হাইকোর্টে ১,১৭৯টি মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। এর মধ্যে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত  মাত্র ১৩টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। স্বাধীনতার পর থেকে গত ৫৫ বছরে কোনো নারী আসামির ফাঁসি কার্যকর হয়নি। তবে শতাধিক নারী মৃত্যুদ- প্রাপ্ত বন্দি এখনো কনডেম সেলে রয়েছেন। সব মিলিয়ে প্রায় আড়াই হাজার বন্দি মৃত্যুর প্রহর গুনছে।
পরিসংখ্যান বলছে ॥ ২০০৪ সালে মোট ডেথ রেফারেন্স মামলা ছিল ৪৩৯টি। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয় ১০১টি। আর বিচারাধীন থাকে ৩৩৮টি। পরের বছর ২০০৫ সালে মামলা বেড়ে দাঁড়ায় ৫১৩। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয় ৪৯টি, বিচারাধীন থাকে ৪৬৪টি। ২০০৬ সালে ৫৭৬টি মামলার মধ্যে নিষ্পত্তি হয় মাত্র ৬৫টি, বিচারাধীন থাকে ৫১১টি। ২০০৭ সালে মামলা বেড়ে দাঁড়ায় ৬১৩টি। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয় ১৪৮টি, বিচারাধীন থাকে ৪৬৫টি। ২০০৮ সালে ৬০২টি মামলা থেকে নিষ্পত্তি হয় ১২৮টি। বিচারাধীন থাকে ৪৭৪টি।

 

২০০৯ সালে ৫৫৭টি মামলা থেকে নিষ্পত্তি হয় ৪৮টি; বিচারাধীন থাকে ৫০৯টি। ২০১০ সালে ৫৮৫টি মামলা থেকে নিষ্পত্তি হয় মাত্র ৪৩টি, বিচারাধীন থাকে ৫৪২টি। ২০১১ সালে মামলার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬০৯টি। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয় ৭৪টি, বিচারাধীন থাকে ৫৩৫টি। ২০১২ সালে মামলার সংখ্যা ছিল ৫৯৫টি। নিষ্পত্তি হয় ১৪৫টি, বিচারাধীন থাকে ৪৫০টি। ২০১৩ সালে মামলার সংখ্যা ছিল ৫১৩টি। নিষ্পত্তি হয় ১১১টি, বিচারাধীন থাকে ৪০৬টি। ২০১৪ সালে মামলার সংখ্যা ছিল ৪৯৮টি। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয় ১৩৫টি, বিচারাধীন থাকে ৩৬৩টি। ২০১৫ সালে মামলার সংখ্যা ছিল ৪৭৭টি।

 

নিষ্পত্তি হয় মাত্র ৫৮টি, বিচারাধীন থাকে ৪১৯টি। ২০১৬ সালে মামলার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৮০টি। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয় মাত্র ৪৫টি। বিচারাধীন থাকে ৫৩৫টি। ২০১৭ সালে মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ৭০৬টি, নিষ্পত্তি হয় ৬৬টি। ২০১৮ সালে মামলা হয় ৭৯৪টি আর নিষ্পত্তি হয় ৮৩টি। অন্যদিকে ২০১৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মামলা হয় ৮১৭টি আর নিষ্পত্তি হয় ৬৭টি। ২০২০ সালে করোনা ভাইরাস দেখা দেওয়ার পর আদালত বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকে। ২০২১ সালে মামলা ছিল ৯৬২টি আর নিষ্পত্তি হয়েছে ৮৮টি।

২০২২ সালে মামলা ছিল ১০৬৮ নিষ্পত্তি হয়েছে ১৫৮টি। ২০২৩ সালে ডেথ রেফারেন্স মামলা ছিল ১১২৪টি । এ সময়ে নিষ্পত্তি হয়েছে ১০৩টি মামলা। ২০২৪ সালে মামলা ছিল ১২১২টি আর নিষ্পত্তি হয়েছে ৫৮টি। সর্বশেষ ২০২৫ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত মামলা ছিল ১১৭৯টি। আর এই সময়ে নিষ্পত্তি হয়েছে ১৩টি  মামলা। অর্থাৎ মামলার সংখ্যা যত বাড়ছে, নিষ্পত্তি হচ্ছে তার এক-তৃতীয়াংশেরও কম।
বিচারক সংকট ও বেঞ্চের ঘাটতি ॥ হাইকোর্টে একসময় ডেথ রেফারেন্স শুনানি হতো একটি বেঞ্চে। বর্তমান প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ বেঞ্চ বাড়িয়েছেন।  তবুও মামলার তুলনায় বিচারক সংখ্যা কম। অনেক বিচারক মৃত্যুদণ্ড মামলার শুনানি করতে আগ্রহী নন। আইনজ্ঞরা মনে করেন, শুধু বেঞ্চ বাড়ানো নয় বরং বিচারপতি নিয়োগ বাড়ানো জরুরি।  সিনিয়র আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি সজাগ আছেন। তবে বিচারক সংকট কাটাতে নিয়োগ বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই।’

মনজিল মোরসেদ মনে করেন, ‘বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত করতে সরকারি প্রেসে নয়, নিজস্ব প্রেসে পেপারবুক তৈরি করলে সময় বাঁচানো সম্ভব।’ অন্যদিকে আইনজীবী স্বপন রায় বলেন, ‘আমেরিকায় মৃত্যুদ- মামলার নিষ্পত্তিতে ১০-১৫ বছর লেগে যায়। সে তুলনায় আমরা ভালো করছি। তবে মামলা বাড়ার কারণে সময়ও বাড়ছে।’
কারাগারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ॥ হাইকোর্টে দাখিল করা এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন কারাগারে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত বন্দির সংখ্যা ২ হাজার ১৬২ জন। তাদের জন্য সেল রয়েছে ২ হাজার ৬৫৭টি। এর মধ্যে নারী বন্দি ৬৩ জন।  হাইকোর্টে কারা অধিদপ্তরের দাখিল করা এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের হাইকোর্ট বেঞ্চে এ প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। গত বছরের ১ নভেম্বর পর্যন্ত তৈরি করা প্রতিবেদনে মৃত্যুদ-প্রাপ্তদের  জন্য সেলের সংখ্যা মোট ২ হাজার ৬৫৭টি। এর মধ্যে পুরুষের জন্য ২ হাজার ৫১২টি আর নারীদের জন্য ১৪৫টি সেল রয়েছে।

এসব সেলে মৃত্যুদ-াদেশপ্রাপ্ত  পুরুষ বন্দি ২ হাজার ৯৯ এবং নারী বন্দি রয়েছে ৬৩ জন। ঢাকা বিভাগের কারাগারগুলোতে সর্বোচ্চ সেল রয়েছে। ১ হাজার ৭৮৪টি সেলের মধ্যে এ বিভাগে মোট বন্দি রয়েছে ১ হাজার ২৯৫ জন। আর সর্বনিম্ন সেল রয়েছে ময়মনসিংহ বিভাগের কারাগারগুলোতে। ওই বিভাগে ৫৪টি সেলের মধ্যে মোট বন্দি রয়েছে মাত্র পাঁচজন। সেখানে কোনো নারী বন্দি নেই। কারাগারের মধ্যে সর্বোচ্চ সেল রয়েছে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে। সেখানে ১ হাজার সেলের মধ্যে রয়েছে ৯৫১ জন বন্দি। তবে ২০টিরও বেশি জেলা কারাগারে কোনো মৃত্যুদ-প্রাপ্ত বন্দি নেই। স্বাধীনতার  পর থেকে এখনো কোনো নারী আসামির ফাঁসি কার্যকর হয়নি। তবে দণ্ডপ্রাপ্ত নারীরা মৃত্যুর প্রহর গুনছে কনডেম সেলে।
বিদেশি অভিজ্ঞতা ও আদালতের পর্যবেক্ষণ ॥ ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বহুল আলোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় হাইকোর্ট যাবজ্জীবন ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সব আসামিকে খালাস দেন। আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, অবৈধ চার্জশিটের ভিত্তিতে বিচারিক আদালত রায় দিয়েছিল, যা আইনসম্মত নয়। ভারতের জলপাইগুড়ি হাইকোর্টের একটি পর্যবেক্ষণ বিশেষভাবে আলোচনায় আসে। সেখানে বলা হয়, ‘বিচারব্যবস্থা রক্তপিপাসু হতে পারে না। মৃত্যুদ- চূড়ান্তের পরে নতুন প্রমাণ এলেও আর সংশোধনের সুযোগ থাকে না।’
বৈশ্বিক চিত্র ॥ বর্তমানে বিশ্বের ৫৫টি দেশে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৭৬ সাল থেকে ১,৪০০ এর বেশি আসামির ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। আমেরিকার ৩২টি অঙ্গরাজ্যে এখনো মৃত্যুদণ্ড চালু। বাংলাদেশ, ভারত, ইরান, জাপানসহ বেশ কয়েকটি দেশে ফাঁসির মাধ্যমে সাজা কার্যকর হয়। সৌদি আরবে শিরñেদ, ইরান-পাকিস্তানে  পাথর নিক্ষেপ, ইন্দোনেশিয়া-চীনে গুলি, যুক্তরাষ্ট্রে লেথাল ইনজেকশন ও বৈদ্যুতিক চেয়ার ব্যবহার করা হয়। কয়েকটি দেশ মৃত্যুদ- নিষিদ্ধ করলেও পরে আবার চালু করেছে- যেমন মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও সৌদি আরব।
বিশেষজ্ঞ মত ॥ আইনবিদদের মতে, মৃত্যুদণ্ড সংক্রান্ত মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি অত্যন্ত জরুরি। কারণ এখানে একজন ব্যক্তির জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন জড়িত। দীর্ঘসূত্রতা আসামিদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে এবং বিচারপ্রার্থী পরিবারকে হতাশায় ফেলে। তাদের মতে, ডেথ রেফারেন্স বেঞ্চ বাড়াতে হবে। নতুন বিচারপতি নিয়োগ দিতে হবে। নিজস্ব প্রেসে দ্রুত পেপারবুক তৈরি করতে হবে। শুনানিতে অযথা মুলতবি না দিয়ে ধারাবাহিকভাবে পরিচালনা করতে হবে।
উপসংহার ॥ ডেথ রেফারেন্স মামলার জট কেবল আদালতেরই সমস্যা নয়, এটি মানবাধিকারেরও বিষয়। বিচার প্রক্রিয়ায় বিলম্ব দোষীদের শাস্তি বিলম্বিত করে এবং নির্দোষদের অযথা কারাগারে আটকে রাখে। আইনজীবীরা মনে করেন, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে মৃত্যুদ- মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করা ছাড়া বিকল্প নেই।