Image description

পলাতক আওয়ামী ক্যাডারদের নাশকতার প্রশিক্ষণদানে অভিযুক্ত সেনাবাহিনীর মেজর সাদেকুল হকের স্ত্রী সুমাইয়া জাফরিনের পরিবার বংশপরম্পরায় কট্টরপন্থি আওয়ামী লীগ। সরেজমিনে এই আওয়ামী পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ পাওয়া যায়। এর মধ্যে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকা পালন, সন্ত্রাসী বাহিনী লালন, তাদের দিয়ে সরকারি জলাশয় ভোগদখল, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নামে ‘মিথ্যা মামলা’ দিয়ে ঘরছাড়া করা ইত্যাদি।

তবে অভিযুক্তদের মধ্যে একজন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান একেএম ফজলুল হক বকুল তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। আরেক অভিযুক্ত সদ্য অপসারিত ইউপি চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান মুকুলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

সম্প্রতি রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার কাছে একটি কনভেনশন সেন্টারে পলাতক আওয়ামী ক্যাডারদের জড়ো করে প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে সেনাবাহিনীর মেজর সাদেকুল হক ও তার স্ত্রী সুমাইয়া জাফরিনের বিরুদ্ধে। মেজর সাদেক এখন সেনা আইনে বিচারের মুখোমুখি। আর তার স্ত্রী জাফরিন পুলিশ রিমান্ডে আওয়ামী লীগ ক্যাডারদের গেরিলা প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন।

সুমাইয়া জাফরিন সেনাবাহিনীর ৩৩ পদাতিক ডিভিশনের সাবেক জিওসি ও কুমিল্লা এরিয়া কমান্ডার এবং প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের (পিজিআর) সাবেক প্রধান মেজর জেনারেল জাহাঙ্গীর হারুনের মেয়ে। জাহাঙ্গীর হারুনের জন্মস্থান যশোরের শার্শা উপজেলার ডিহি ইউনিয়নের ভারত সীমান্তবর্তী শিববাস গ্রামে। তার বাবা মৃত খলিলুর রহমান মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত।

সম্প্রতি ডিহি, শিববাস ও সংলগ্ন এলাকায় ঘুরে এ পরিবার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে আমার দেশ। স্থানীয় রাজনীতিসচেতন প্রবীণরা জানান, একাত্তরে খলিলুর রহমান ‘কমিউনিস্ট কর্মিসংঘ’ নামে একটি দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এ দলটির প্রধান দুই নেতা যশোরের ঝিকরগাছার দুই মেধাবী সন্তান পানিসারা গ্রামের ডা. মারুফ হোসেন ও বায়সা গ্রামের দাউদ হোসেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেওয়া দলটির কর্মী খলিলুর রহমান সম্পর্কে এলাকায় পরস্পরবিরোধী বিভিন্ন কথা প্রচলিত আছে। বেশির ভাগ লোকের মতে, খলিলুর ভারতে গিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু যুদ্ধ করেননি। বরং ভারতের ক্যাম্প থেকে তিনি একটি ছোটখাটো গ্রুপ চালাতেন। এই গ্রুপের কাজ ছিল খুন-খারাবি করা। খলিলুর মাঝে-মধ্যে দেশে এসে এসব কাজ তদারক করে দ্রুতই ফিরে যেতেন ভারতীয় আস্তানায়।

এলাকাবাসীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, উত্তাল সেই সময়ে ভারত সীমান্তলাগোয়া শালকোনা গ্রামের আরাতন মোল্লা, সোহরাব ডাক্তার, গোড়পাড়ার বলু, ছমির বিশ্বাস, গোকর্ণ গ্রামের ইজ্জত আলীসহ বেশকিছু ব্যক্তি খুন হন। এসব অপরাধমূলক কাজের জন্য তারা খলিলুরের বাহিনীকে দায়ী করেন।

শিববাস গ্রামে মুক্তিবাহিনী বা মুক্তিফৌজের (এফএফ) একমাত্র সদস্য আবু জাফর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ শার্শা উপজেলা কমান্ডের কমান্ডার ছিলেন ২০০০ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত। সম্প্রতি পুনর্গঠিত মুক্তিযোদ্ধা সংসদের উপজেলা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক এই বীর মুক্তিযোদ্ধা আমার দেশকে বলেন, খলিলুর রহমান ভারতের বাগদা ব্লকের মেহেরানি গ্রামে থাকতেন। মাঝে মধ্যে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এলাকায় আসতেন। তিনি কোনো যুদ্ধে অংশ নেননি। ওই সময় সীমান্তবর্তী এলাকাটিতে যত খুন-খারাবি হয়েছে, সেই গুন্ডাবাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন খলিলুর। যদিও অনেক পরে এসে শুনেছি, খলিলুর নাকি মুক্তিযোদ্ধা।

খলিলুরের পরবর্তী প্রজন্ম আওয়ামী লীগার হিসেবে পরিচিতি পেলেও তিনি আসলে গোপন (আন্ডারগ্রাউন্ড) কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে স্বীকার করেছেন ডিহি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও খলিলুরের ভাইপো একেএম ফজলুল হক বকুল। যশোর শহরে অবস্থানরত বকুল বলেন, ‘আমরা ফ্যামিলিগতভাবেই আওয়ামী লীগার। তবে আমার চাচা দাউদের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি করতেন।’ তবে একাত্তরে খলিলুরের খুন-খারাবিতে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগটি ভিত্তিহীন বলে দাবি বকুলের।

ডিহি ইউনিয়ন পরিষদের দুই সাবেক চেয়ারম্যান ফজলুল হক বকুল ও আসাদুজ্জামান মুকুল পরস্পর চাচাতো ভাই। তাদেরই আরেক চাচাতো ভাই হলেন আলোচিত সুমাইয়া জাফরিনের বাবা মেজর জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর হারুন ওরফে বাবুল। বকুল ২০০৩ সালের ইউপি নির্বাচনে ডিহি ইউপির চেয়ারম্যান হন। ওয়ান-ইলেভেনের সময় স্থানীয় সরকার নির্বাচন না হওয়ার সুযোগে তিনি ২০১০ সাল পর্যন্ত টানা চেয়ারম্যানগিরি করেন। আর তার চাচাতো ভাই আসাদুজ্জামান বকুল ২০২১ সালের নির্বাচনে একই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হন। তবে তিনি মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। পলাতক মুকুলকে গত সপ্তাহে অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। বকুলের বাবা আব্দুল জলিলও আওয়ামী লীগের সমর্থনে একসময় একই ইউপির চেয়ারম্যান ছিলেন। শিববাস গ্রামে জেনারেল জাহাঙ্গীরের দৃষ্টিনন্দন বাংলোর পাশেই বকুল ও মুকুলের বাড়ি। ওই পরিবারের এক নারী সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তিনি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোটায় চাকরি পেয়ে হাসিনার আমলে দ্রুত পদোন্নতি পেয়ে তরতর করে ওপরের দিকে উঠে গেছেন বলে এলাকাবাসী জানান।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, আওয়ামী লীগ শার্শা উপজেলা কমিটির যুগ্ম সম্পাদক ফজলুল হক বকুল চেয়ারম্যান থাকাকালে বেশ বড়সড় সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তোলেন। পরে সেই বাহিনী লালন-পালন করেন তার চাচাতো ভাই ইউপি চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান মুকুল। এই বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন, রাজনগরচকের শহিদুল, ডিহির গিয়াসউদ্দিন, জাহাঙ্গীর, দরিদুর্গাপুরের খোকন, সাড়াতলার আলমগীর, মামুন, নৈহাটির মাসুদ, চন্দনপুরের আইয়ুব খান, পণ্ডিতপুরের মমিনুর রহমান বাবু প্রমুখ।

ওই এলাকা দিয়ে প্রবহমান বেতনা নদীতে ক্ষমতার জোরে বেআইনিভাবে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ, ফুলসর বাঁওড় ও জাইলার বিল, পণ্ডিতপুরের একটি বড় জলাশয় দখলে নিয়ে ভোগদখল করেন তারা। স্থানীয় লোকদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি, তখনকার বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের আটক ও তাদের নামে ভুয়া মামলা দিতে পুলিশকে সহায়তা করার মতো কাজে যুক্ত ছিলেন তারা। শেখ হাসিনার পতনের পর তাদের আর এলাকায় দেখা যায়নি।

তবে বকুল চেয়ারম্যান দাবি করেন, উল্লিখিত ব্যক্তিরা যুবলীগ-ছাত্রলীগ করতেন। বেতনা নদীতে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করা অবশ্যই অন্যায়। তবে অন্য জলাশয়গুলো তারা সরকারের নিয়মানুযায়ী ইজারা নিয়ে মাছ চাষ করতেন। আর তাদের সন্ত্রাসী তৎপরতার বিষয়ে বকুলের ভাষ্য, ‘তারা সব সাবেক এমপি আফিলের (শেখ আফিল উদ্দিন) লোক। আমি আফিলবিরোধী রাজনীতি করি।’

তবে ডিহি ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জব্বার সরদার বলেন, ‘বকুল-মুকুলের সন্ত্রাসী বাহিনী আর পুলিশের অত্যাচারে ১৫ বছর বাড়িছাড়া ছিলাম। আমার নামে ভুয়া মামলা দিয়েছে সাতটা। ছয়বার জেল খেটেছি।’

ইউনিয়ন বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি মো. কামাল হোসেন ২০০৩ সালের নির্বাচনে বকুল চেয়ারম্যানের পরিষদে সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। কামাল বলছেন, আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে তিনি রাতে বাড়িতে ঘুমাতে পারেননি। নাশকতা মামলায় জেল খেটেছেন চারবার। বাড়ির পাশে পাকশিয়া বাজারে বসতে পারেননি ফ্যাসিবাদী শাসনের শেষ তিন বছর।

ডিহি ইউনিয়ন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ট্যাংরালি গ্রামের মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন জানান, চেয়ারম্যান হওয়ার পর মুকুল দীর্ঘদিন বিরোধীদলের কারও কাগজপত্রে সই পর্যন্ত করতেন না। তিনি ২০২১ সালের নির্বাচনে মুকুলের চেয়ারম্যান হওয়ার প্রক্রিয়াটাও জালিয়াতিপূর্ণ ছিল বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, মুকুল আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, এক ভোট পেলেও তিনিই চেয়ারম্যান হবেন। প্রত্যেক কেন্দ্রে আগে থেকেই ১০০ করে ব্যালট সিল মেরে রাখা হয়েছিল। তাতেও মুকুলের জয় নিশ্চিত হচ্ছিল না। পরে জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ভোট কেটে রাত ১০টার দিকে ফলাফল ঘোষণা করা হয়। অথচ মেম্বার প্রার্থীদের ফলাফল জানানো হয় সন্ধ্যায়।

এলাকাবাসীর ভাষ্য, এসবই করা হয়েছে সুমাইয়া জাফরিনের বাবা মেজর জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর হারুনের প্রভাবে। শার্শা উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হাসান জহিরও একই অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে জাহাঙ্গীর হারুন আগামী নির্বাচনে যশোর-১ (শার্শা) আসনে দলটির সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে এলাকায় প্রচার চালানো হয়।

জামায়াতে ইসলামী ডিহি ইউনিয়ন শাখার আমির টিপু সুলতান খান বলেন, চেয়ারম্যান বকুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ কম, মুকুলের বিরুদ্ধে বেশি। ২০২১ সালের নির্বাচনে জালিয়াতির মাধ্যমে মুকুলকে চেয়ারম্যান বানানোসহ বিএনপি নেতা ও স্থানীয় লোকদের তোলা অভিযোগগুলো সঠিক বলে তিনি মত দেন। ৬৩ বছর বয়সি এই জামায়াত নেতা বলেন, তিনি শুনেছেন খলিলুর রহমানের নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় আছে। তবে খলিলুর কোথায় যুদ্ধ করেছেন তা তার অজানা।

অপসারিত চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান মুকুল ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর নিরুদ্দেশ। তার নাম্বারে ফোন করা হলে রিসিভ করে অপর প্রান্ত থেকে বলা হয়, ‘আমি মুকুল না’। তার ব্যবহৃত অন্য একটি নম্বরে কল করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।