
“আমরা এখানে এসেছি আট বছর। শান্তির ঘুম হয়নি এক রাতেও। এই আট বছরে হাজার বছরের সমান দুঃখ সহ্য করার মত থেকেছি। আমরা মিয়ানমার চলে যেতে চাই। একটু শান্তিতে থাকতে চাই।”
২০১৭ সালের বর্ষার কোনো এক দিনে নিজের বাড়িঘর ছেড়ে পরবাসী হয়েছিলেন রোহিঙ্গা নারী ফাতেমা। ৩০ ছুঁই ছুঁই এই নারীর আক্ষেপ, “আট বছরের বর্ষা যেন কাটে না আর!”
১২ বছর বয়সে বাবা-মায়ের সঙ্গে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন মুবিনুর। এখন কুড়ি বছরের এই তরুণের আকুতি, “আমরা মিয়ানমার থেকে এসেছি খুব ছোটবেলায়। পড়ালেখার সুযোগ পাইনি। শিক্ষিত হতে পারিনি। মা-বাবা প্রতি রাতে কাঁদে, আমরা আমাদের দেশ ফিরে পেতে চাই।”
আর সলিমা খাতুন বলেন, “বাংলাদেশ আমাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই দিয়েছে। মিয়ানমারে যেসব নির্যাতন সহ্য করেছি সেগুলোর বিচার চাই। আমাদের মা-বোনদের যেভাবে মারধর করেছে, তাদের প্রতিটা রক্তের বিচার চাই।”
এমন আক্ষেপ-আকুতি নিয়ে সোমবার সকালে কক্সবাজারের উখিয়ার আশ্রয়শিবিরের ৪ নম্বর ক্যাম্পের বালুর মাঠে এসেছিলেন সলিমা, মুবিন ও ফাতেমারা। গেল সাত বছরের ধারাবাহিকতায় ২৫ অগাস্ট ‘রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবস’ পালন করেন তারা।
নিরাপত্তা ও সম্মানের সঙ্গে নাগরিক অধিকার নিয়ে স্বদেশে ফেরার দাবিতে এই সমাবেশ যখন আশ্রয়শিবিরে চলছিল, তখন উখিয়ার সাগর তীরবর্তী একটি তারকামানের হোটেলে এসেছিলেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। সেটিও ছিল রোহিঙ্গাদের ‘বাড়ি ফেরানো’র অর্থাৎ ‘নিরাপদ প্রত্যাবাসনের’ আন্তর্জাতিক সম্মেলন।
আশ্রয়শিবিরের সমাবেশে ফাতেমা বলছিলেন, “আজ আমরা এখানে একত্রিত হয়েছি বিশ্বের কাছে জানান দিতে, যেন আমাদের দেশ আমাদেরকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। আমাদের ভিটেমাটি আমরা ফেরত চাই। যেসব জায়গা-জমি কেড়ে নিয়েছে সেগুলো ফেরত চাই।”
এই প্রত্যাবাসনের জন্য রয়েছে একদিকে আকুতি; আরেকদিকে আছে শঙ্কাও।
দীর্ঘ দিন ধরে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক রাহমান নাসির উদ্দীন।
রোহিঙ্গাদের বাড়ি ফেরানোর বাস্তবতা কতোটুকু- জানতে চাইলে তিনি বলছিলেন, “রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর কার্যকর কোনো প্রতিফল এই মুহূর্তে আমি দেখি না। প্রথমত মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা। রাখাইনে জান্তার কোনো কর্তৃত্ব নেই। ঢাকা-ইয়াঙ্গুন দেন-দরবারে যদি ধরেও নিই যে, তাদের (রোহিঙ্গাদের) ফেরত পাঠানো হবে, তাহলে জান্তার কী সেই সক্ষমতা আছে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের?
“দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গাদের প্রতি আরাকার আর্মির দৃষ্টিভঙ্গি। গত এক বছরে আরাকান আর্মির নির্যাতনেই তো এল প্রায় দেড় লাখ। তাহলে? তৃতীয়ত, রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় ফেরত যাওয়ার সাহস ও আস্থা। নাগরিকত্ব বসতভিটা এসব ফিরে পাবে কী-না সেই শঙ্কা তো তাদের মধ্যে আছেই।”
সমাবেশে আসা আশ্রয়শিবিরের ৫ নম্বর ক্যাম্পের বাসিন্দা রহমত উল্লাহও প্রকাশ করেছেন এমন শঙ্কা। তিনি বলেন, “এখন আমাদের ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করলেও আমরা কি নিরাপদভাবে মিয়ানমারে ফিরতে পারবো? আমাদেরকে নিজ দেশে ফেরানোর পরিকল্পনার পাশাপাশি আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও জাতিসংঘের দায়িত্ব। তাই আজ আমরা সবাই এখানে জড়ো হয়েছি। আমাদের যেন আবার মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসতে না হয় সে ব্যবস্থা করতে হবে।”
‘আরাকান আর্মিও নির্যাতন চালাচ্ছে’
আশ্রয়শিবিরের এই সমাবেশে আসা বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলেছে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
সেখানে তারা ঘরে ফেরার কথা যেমন বলেছেন, তেমনি তাদের উপর হওয়া বর্বরোচিত হত্যার বিচারও চেয়েছেন। আবার প্রত্যাবাসন হলে, তা যেন মর্যাদার সঙ্গে করা হয় সেই দাবিটিও করেছেন।
৪ নম্বর ক্যাম্পে থাকা কলিমুল্লাহ বলেন, “ইউএন অরগানাইজেশনসহ মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সব সংস্থার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানাতে চাই, আমরা এখানে শুধুমাত্র আজকের দিনটিকে স্মরণ করতে মিলিত হইনি। আমাদের হারানো প্রতিটি মা-বাবা, ভাই-বোনের রক্তের হিসাব ও বিচার চাইতে এখানে জড়ো হয়েছি। আমরা এখানে একত্রিত হয়েছি আমাদের নিরাপত্তার স্বার্থে।
“২৫ অগাস্ট শুধু একটি তারিখ নয়, এটি আমাদের মা-বাবার চোখের জল ফেলার দিন। আমাদের ভিটে-মাটি হারানোর দিন। ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্টের পর থেকে আমরা নিজ দেশ ছেড়ে এই দেশে আশ্রিত হিসেবে আছি। আমরা মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত হয়েছি, নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছি। আট বছর পেরিয়ে গেলেও আমরা আমাদের মাতৃভূমিতে ফিরতে পারিনি।”
একই ক্যাম্পের আনোয়ার হাকিম বলেন, “মিয়ানমারে বসবাসরত মুসলিম জনগোষ্ঠী এখনো পরাধীনভাবে বসবাস করছে। তাদের ওপর এখনো নির্যাতন-জুলুম চলছে। আরাকান আর্মিরাও তাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে তারা রাজনীতি করছে।
“আমরা বাংলাদেশে এসেছি আট বছর হচ্ছে। এখানে আমরা এক ব্লক থেকে অন্য ব্লকে যেতে পারি না। আমাদের শিক্ষার তেমন কোনো সুযোগ নেই। আমরা শিক্ষিত হতে চাই। কারণ একটি অশিক্ষিত জাতি কখনো উন্নতি করতে পারে না।”
আনোয়ার হাকিম মনে করেন, “জাতিসংঘের মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংস্থাগুলো চাইলে পারে আমাদের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। তারা জানে, আমরা ক্যাম্পে শান্তিতে নেই। আমরা শিক্ষায় পিছিয়ে পড়েছি। ক্যাম্পে অনেক ছেলেরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করে। তার মূল কারণ নিজেরা কিছু করার।
“গত বছর জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেস ও মুহাম্মদ ইউনুস এসে কথা দিয়েছিলেন আগামী বছর রোজার মধ্যে আমাদেরকে নিজ দেশে পাঠাবেন। আগামী ঈদ আমরা নিজ দেশে করতে চাই।”
কিন্তু এমন কোনো আশা দেখছেন না নৃ-বিজ্ঞানী রাহমান নাসির উদ্দীন।
তাহলে সমাধান কী- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “আমি মনে করি, ১৫ লাখ রোহিঙ্গাকে রাতারাতি মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যাবে না- এই বাস্তবতাকে স্বীকার করতে হবে। কিছু স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। একটা কার্যকর অ্যাকশন প্ল্যান নিতে হবে। তাদের কিভাবে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে তৈরি করা যেতে পারে, তৃতীয় কোনো দেশে পুনর্বাসনের চিন্তাও নতুন করে করা যেতে পারে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সক্রিয়ভাবে সংযুক্ত করে কীভাবে একটি কার্যকর প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা এবং এর সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সম্পৃক্ত করতে হবে। যেন একটা পার্টিসিপেটরি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একটা সম্মানজনক সমাধানের দিকে পৌঁছানো যায়।”
‘স্থানীয়দের কষ্ট কেউ বুঝবে না’
বাংলাদেশে তিনবারের রোহিঙ্গা সংকট দেখেছেন কক্সবাজারের প্রবীন আইনজীবী মু. আব্দুল মন্নান।
তিনি বলছিলেন, এর আগের দুইবারের সংকট দ্রুত সমাধান হয়েছিল। কিন্তু এবারের সংকট সমাধানের প্রক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে, মাঝিবিহীন নৌকার মতো। ১৯৭৮ সালে যারা এসেছিলেন, তারা দুই-তিন মাসের মধ্যে চলে গিয়েছিলেন। ১৯৯২ সালে যারা এসেছিলেন, তারাও চার-পাঁচ মাসে চলে গিয়েছিলেন, যদিও কিছু থেকে যায়। কিন্তু এবারে সমস্ত স্টেক হোল্ডারদের সদিচ্ছার ঘাটতি এবং অভ্যন্তরীণ স্বার্থ রয়েছে।”
কক্সবাজারে চলমান আন্তর্জাতিক সম্মেলন নিয়ে জানতে চাইলে আব্দুল মন্নান বলেন, “এখানে রোহিঙ্গাদের বাড়ি ফেরানোর কথা বলা হলেও বাস্তবতা যে ভিন্ন সেটা সবাই জানে। মূলত আর্থিক সংকট কমাতে দাতাগুলোর নজর ফেরাতে চাইছেন এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে।
“সভা-সিম্পোজিয়াম নিয়ে আমার বিশ্বাস উঠে গেছে। সমাধান তো হয় না, দিন দিন সংকট বাড়ছে আরো। আমরা স্থানীয়রা কী পরিমাণ সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি এটা কেউ বুঝে না।”
প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, “গত আট বছরে কতোজন গেল? কিন্তু প্রতি মাসেই আসে। গত রেজিমেও উদ্যোগ দেখেছি, কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।”