
সবুজবাগের বরদেশ্বরী কালিমাতা মন্দিরে শেষবার যখন বিভুরঞ্জনের মুখটি দেখার সুযোগ দেওয়া হল, তখন কান্না যেন কিছুতেই থামছিল না স্ত্রী শেফালী সরকারসহ অন্য স্বজনদের।
শনিবার সন্ধ্যা সোয়া ৬টা থেকে শুরু হয় বিভুরঞ্জনের সৎকারের আনুষ্ঠানিকতা, যা সম্পন্ন হয় রাত সাড়ে ৮টার দিকে।
অফিস যাওয়ার কথা বলে বেরিয়ে লাশ হয়ে বাসায় ফেরা সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারকে চিরবিদায় জানাতে এদিন সন্ধ্যায় অনেকেই জড়ো হন বরদেশ্বরী কালিমাতা মন্দিরে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) প্রেসিডিয়াম সদস্য সাজ্জাদ জহির চন্দন, যুব ইউনিয়নের সভাপতি খান আসাদুজ্জামান মাসুম, ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন শুভসহ অনেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান তাকে।
বিভুরঞ্জনের শেষ কর্মস্থল ‘আজকের পত্রিকা’ থেকেও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
এর আগে বিকাল সোয়া ৫টার দিকে সিদ্ধেশ্বরীতে ‘অপ্সরা’ নামের ভাড়া বাসায় তার লাশ আনা হয়। সেখানে বিভুরঞ্জনের গ্রামের বাড়ি থেকে আসা অনেকে শেষ বিদায় জানান। পরে সন্ধ্যা ৬টার দিকে মরদেহ নেওয়া হয় বরদেশ্বরী মন্দিরে।
৭১ বছর বয়সী বিভুরঞ্জন অফিসে যাওয়ার কথা বলে বৃহস্পতিবার সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার পর থেকে নিখোঁজ ছিলেন। পরদিন বিকালে মুন্সীগঞ্জে মেঘনা নদী থেকে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। শনিবার দুপুরে মুন্সীগঞ্জ ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে হয় ময়নাতদন্ত।
বিভুরঞ্জন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত কলাম লিখতেন। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের মতামত পাতাতেও তিনি লিখতেন। তিনি সর্বশেষ নিবন্ধটি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে মেইল করেন বৃহস্পতিবার সকাল সোয়া ৯টায়। ফুটনোটে তিনি লেখেন, “জীবনের শেষ লেখা হিসেবে এটা ছাপতে পারেন।”
এরপর যোগাযোগ করা হলে তার ছোট ভাই চিররঞ্জন সরকার বলেছিলেন, নানা কারণে হতাশায় ভুগছিলেন বিভুরঞ্জন।
‘খোলা চিঠি’ শিরোনামে বিভুরঞ্জনের শেষ লেখাটি শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের মতামত বিভাগে প্রকাশিত হয়। সেখানে নিজের ও ছেলের অসুস্থতা, মেডিকেল পাস সরকারি কর্মকর্তা মেয়ের উচ্চতর পরীক্ষায় ‘ফেল করা’, বুয়েটে থেকে পাস করা ছেলের ‘চাকরি না হওয়া’ এবং নিজের আর্থিক দৈন্য নিয়ে হতাশার কথা লিখেছেন তিনি।
পরিবার জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় বিভুরঞ্জন তার মোবাইল ফোনটিও বাসায় রেখে গিয়েছিলেন।
তিনি না ফেরায় এবং কারো কাছে তার কোনো তথ্য না পাওয়ায় বৃহস্পতিবার রাতে রমনা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তার ছেলে ঋত সরকার।
সেখানে তিনি বলেন, প্রতিদিনের মত বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে অফিসে যাওয়ার জন্য রওনা করেন তার বাবা। কিন্তু এরপর আর বাসায় ফেরেননি।
মর্যাদা নিয়ে, যোগ্যতাকে ব্যবহার করে বেঁচে থাকতে চাই: চিররঞ্জন
বরদেশ্বরী মন্দিরে চিররঞ্জন সাংবাদিকদের বলেন, “আমার দাদা পৃথিবী থেকে চলে গেছেন। এতে কারো কোনো ক্ষতি হয়নি। কিন্তু আমরা, আমাদের পরিবারের সদস্যদের যে ক্ষতিটা হয়েছে, তা কোনো কিছুই দিয়েই পূরণ হবে না। আমরা কীভাবে এই শোক কাটিয়ে উঠব, তা সত্যিই জানি না। আমার ৯৩ বছর বয়সী মা, তাকে কীভাবে শান্তনা দেব? আমার অত্যন্ত মেধাবী ভাতিজা- ভাতিজি– তারা কীভাবে জীবন-সংগ্রামে টিকে থাকবেন? এগুলো নিয়ে আমরা খুবই চিন্তিত।”
বিভুরঞ্জনের মৃত্যু নিয়ে কেউ যেন রাজনৈতিক বয়ান তৈরি না করে সে অনুরোধও করেন চিররঞ্জন। তিনি বলেন, “আমার দাদা নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে তাকে কীভাবে খুঁজে পাব, সেটাই ছিল আমাদের মূল ভাবনার জায়গা। আমরা কাউকে দায়ী করি না।
“প্লিজ আমার দাদাকে নিয়ে কোনো রাজনৈতিক রঙ চড়াবেন না। আমরা বিএনপি, আওয়ামী লীগ কিংবা এনসিপি নয়। আমরা মানুষ হিসেবে এ দেশে শুধু মর্যাদা নিয়ে, আমাদের নিজের যোগ্যতাকে ব্যবহার করে বেঁচে থাকতে চাই। আমাদের আর কোনো চাওয়া নেই। কারো কোনো সহযোগিতা, করুনা কিছুই চাই না। আমরা শুধু চাই, আমাদের প্রাপ্য যে মর্যাদা, আমাদের যোগ্যতার যে প্রকাশ– সেই জায়গাটা যেন বহাল থাকে।
“আমার ভাই একজন সাংবাদিক, সৃজনশীল ও মননশীল মানুষ ছিলেন। তার যাপিত জীবনের ক্ষোভগুলো যে এরকম মেঘের মতো অভিমান হয়ে জমা ছিল, তা আমরা বুঝতে পারিনি। খোলা চিঠিতে তিনি তা কিছু প্রকাশ করেছেন। সবার কাছে অনুরোধ, আমাদের কথাকে কেউ বিকৃত করে যেন প্রচার না করে। কোনো রাজনৈতিক রঙ যেন না লাগায়।”
চিররঞ্জন বলেন, “ওই খোলা চিঠিতে আমাদের সাংবাদিকতা জীবনের যে চিত্র উঠে এসেছে, সেই জায়গাটি নিয়ে সবার উপলব্ধি করা উচিত বলে মনে করি। আমি নিজেও এক সময় সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত ছিলাম। ভেতর থেকে অনেক কিছুই দেখেছি। এখানে কীভাবে আমরা পরিবর্তনটা আনতে পারি, ভবিষ্যতে আর কোনো সাংবাদিকের জীবনে এমন দুর্দশা যেন নেমে না আসে, এটুকুই আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে নিবেদন।”

সৎকারের জন্য শনিবার সন্ধ্যায় সবুজবাগের বরদেশ্বরী কালিমাতা মন্দিরে নেওয়া হয় সাংবাদিক বিভুরঞ্জনের লাশ।
বিভুরঞ্জনের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে কোনো মামলা করা হবে কিনা, এক সাংবাদিকের এমন প্রশ্নে চিররঞ্জন বলেন, “আমরা মামলা করব কিনা, তা নিয়ে এখনো আমাদের কোনো ভাবনা নেই। যে চলে গেছে, কোনো কিছুর বিনিময়ে আর তাকে ফিরিয়ে আনা যাবে না। বিভুরঞ্জন যে ক্ষতটা নিয়ে চলে গেলেন– এর জন্য আমাদের পরিবার, প্রতিষ্ঠান, সমাজ, রাষ্ট্রব্যবস্থার দায় রয়েছে। আমরা যে ব্যবস্থার মধ্যে আছি, সেটি একটি মামলা করে সমাধান করা যাবে বলে মনে করি না। এ ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য একটা বড় পরিবর্তন দরকার। তা নিয়ে সবাইকে চিন্তা করতে হবে।”
মর্যাদা ও আর্থিক নিশ্চয়তার দাবি
শেষকৃত্যে অংশ নেওয়া বিভুরঞ্জনের পরিবারের সদস্য ও বন্ধু-স্বজনদের অনেকেই সাংবাদিকদের সামাজিক এবং আর্থিক মর্যাদা নিশ্চিত করার দাবি জানান।
সাংবাদিক আবদুর রহিম হারমাছি বলেন, “সাংবাদিকতা পেশায় টিকে থাকতে হলে সততা, দায়িত্বশীলতার বিকল্প নাই। এখন সততার সঙ্গে টিকে থাকতে হলে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যারা আছেন, তাদেরকেও ভাবতে হবে। সাংবাদিকদের বেঁচে থাকার একটা নিশ্চয়তা দিতে হবে।”
বিভুরঞ্জন সরকারের শেষ দিনগুলো কেমন কাটছিল, সে প্রসঙ্গ টেনে হারমাছি বলেন, “শেষ জীবনে তো বিভু দা লেখালেখি করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। কষ্ট লাগে অনেক, প্রতিষ্ঠানই তার লেখার সম্মানীটাও ঠিকমতো দিত না। একজন বিভুরঞ্জন সরকার, তিনি ‘তারিখ ইব্রাহিম’ নামে লিখে যে খ্যাতি পেয়েছিলেন, তাকেও কিনা লেখার সম্মানী ঠিকমতো দেওয়া হত না- এটা ভীষণ কষ্টের।”
সাংবাদিকদের আর্থিক নিশ্চয়তার ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানের নীতিনির্ধারণী পর্যায় এবং সাংবাদিক সংগঠনকেও সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে হারমাছি বলেন, “এভাবে আর চলতে পারে না।”
বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে বিভুরঞ্জনের সঙ্গে জগন্নাথ হলের একই কক্ষে থাকতেন রঞ্জন কর্মকার। বর্তমানে মানবাধিকার কর্মী হিসেবে কাজ করছেন তিনি।
রঞ্জন কর্মকার বলেন, “ছাত্রজীবন থেকেই বিভুরঞ্জন আপসহীন ছিল। যে বিষয়টি নিয়ে বলতে পারছে না, সেখানে নিরব থাকত, কিন্তু আপস করত না। ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়নের ‘জয়ধ্বণি’তে কাজ করত। পরে কমিউনিস্ট পার্টির একতা পত্রিকায় কাজ করেছে। বন্ধু হিসেবে তাকে যেভাবে দেখেছি, সে কখনোই আপস করেনি। সামরিক সরকারের সময় সে ‘তারিখ ইব্রাহিম’ ছদ্মনামে অনেক সাহসী লেখা লিখেছে।”
সাংবাদিকতা পেশায় একজন সাংবাদিককে সৎ রাখতে হলে সততার সাথে বেঁচে থাকার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাংবাদিকবান্ধব হওয়ারও আহ্বান জানান তিনি।
রঞ্জন কর্মকার বলেন, “সাংবাদিকতা নিয়ে বিভুর অভিমান, কষ্ট এবং বিভুর যন্ত্রণাকে আমরা বুঝতে পারিনি।”