
তিনি একজন দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা। চাকরি করেন গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে। চড়েন ব্যক্তিগত গাড়িতে। হাতে লাখ টাকার ঘড়ি। ড্রাইভার, কাজের লোক, আয়া-বুয়া সবই আছে। ছেলে মেয়েদেরও নামি স্কুলে পড়ান। আছে ফ্ল্যাট কেনার শখ। সুযোগ পেলেই এখানে সেখানে ফ্ল্যাট ও জমির শেয়ার কেনেন। ফাইল আটকিয়ে ভবনের মালিকানা শেয়ারও লিখে নেন। বিনিয়োগ করেছেন আবাসন প্রকল্পেও। তিনি গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (গাউক) ইমারত পরিদর্শক মুরাদ আলী। যিনি ১০ বছরের চাকরিজীবনে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। সরকারি চাকরি নয়, যেন আলাদিনের চেরাগ হাতে পেয়েছেন। গাজীপুর চোরাস্তা এলাকায় করেছেন ৪টি বাড়ি। শহরে রয়েছে আরও ৭টি ফ্ল্যাট। পরিবারের সদস্যদের নামেও জমি কিনেছেন বিভিন্ন স্থানে। তবে চাকরি ছাড়া বৈধ আয়ের অন্য কোনো উৎস নেই মুরাদ আলীর। গত কয়েকদিনে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে মুরাদ আলীর জ্ঞাত আয়বহির্ভূত বিপুল পরিমাণ সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। অর্জিত অধিকাংশ বাড়ি, ফ্ল্যাট ও জমি তিনি স্ত্রী রোকসানা পারভীন, বাবা আশরাফুল আলম খান, বোন মাহমুদা আক্তার ও বন্ধু আনিসুর রহমানের নামে কিনেছেন। তবে পার্টনারশিপে কিছু জমি তিনি নিজের নামে কিনে সেখানে ভবন করেছেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভবন নির্মাণে নকশা অনুমোদনে প্রতিটি ফাইলে ‘এম’ চিহ্ন লিখে দেন মুরাদ। এম চিহ্ন ছাড়া কোনো ফাইলই অনুমোদন হয় না। এই বিশেষ চিহ্ন মানে তিনি এই ফাইল ডিল করেছেন এবং উৎকোচ নিয়েছেন।
মুরাদের নামে বেনামে যত সম্পদ: মানবজমিন অনুসন্ধানে গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ইমারত পরিদর্শক মো. মুরাদ আলীর সদরের বিভিন্ন এলাকায় ফ্ল্যাট, কমার্শিয়াল স্পেস, প্লট, বাড়ি ও জমি পাওয়া গেছে। পার্টনারশিপে জমি কিনে ভবন করে ফ্ল্যাট ভাগাভাগি করেছেন মুরাদ। এরমধ্যে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ১৮নং ওয়ার্ডের চৌরাস্তা নলজানি গ্রেটওয়াল সিটি কাঁচাবাজারের অপর পাশে নির্মাণাধীন ১০ তলা ভবনে দু’টি ফ্ল্যাট পাওয়া গেছে। যা মুরাদ আলীর বোন ও স্ত্রীর নামে রয়েছে। এই ভবনের নকশা অনুমোদনে মুরাদ আলীর সহায়তা রয়েছে। এর পাশেই নলজানি ৭ নম্বর রোডের সি-ব্লকে গণসেবা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের অপরপাশে নির্মাণাধীন দু’টি ১০ তলা ভবনের দু’টি ফ্লোর রয়েছে মুরাদ আলীর। এই দু’টি ভবনের গাউকের ছাড়পত্র আটকে দিয়ে ফ্ল্যাট মালিকদের সঙ্গে নিজে যুক্ত হন মুরাদ আলী। পরে শেয়ারে তিনি এই বিল্ডিং নির্মাণ করছেন। মুরাদ আলীর সবচেয়ে উচ্চ মূল্যের সম্পদ রয়েছে গাজীপুর সিটির চৌরাস্তা ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের পালের মাঠ শহীদ বরকত সরণি রোডে। এখানে তার স্ত্রী রোকসানা পারভিন, বাবা আশরাফুল আলম খান ও বন্ধু আনিসুর রহমানের নামে তিনটি শেয়ার রয়েছে। ১০ জনের পার্টনারশিপে পাশাপাশি ৩টি আলিশান বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করছেন মুরাদ আলী। ভবনের নাম সানরাইজ টাওয়ার। প্রতিটি ১০তলা করে ভবনের নির্মাণকাজ চলমান আছে। ইতিমধ্যে ৩ নম্বর ভবনের নিচতলা একটি ওষুধ কোম্পানির কাছে ভাড়া দেয়া হয়েছে।
সানরাইজ টাওয়ারের ঠিক উল্টোপাশে পার্টনারশিপে ২৯ শতাংশ জমি কিনেছেন। জমিটি তার বোনের নামে কেনা হয়। যার বাজারমূল্য ৪ কোটি টাকা। যার দলিল নং-৬৯৫/২৫। এই জমিতে একটি কাপড়ের গোডাউন রয়েছে। সম্প্রতি মুরাদ আলী নিজের বসবাসের জন্য একটি বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণ করেছেন। বাড়িটি গাজীপুর ডুয়েটের অপরপাশে পশ্চিম ভূরুলিয়া সাত্তার সরণি (রাঙ্গামাটি নীড়) রোডের শেষ মাথায়। এটি ৫ তলাবিশিষ্ট ভবন। এর পাশেই একটি ৭ তলা ভবনে ২৫০০ স্কয়ার ফিটের একটি ফ্ল্যাট আছে তার। ভবনটি মিতালি ভবন নামে পরিচিত। এটি সিটি করপোরেশনের ২৫নং ওয়ার্ডে অবস্থিত। এই ভবনের অনুমোদনেও জালিয়াতি করেন মুরাদ আলী। গাজীপুর শিমুলতলী এলাকায় মুরাদ আলীর ২০০০ স্কয়ার ফিটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। এটি ওই এলাকার চক্ষু হাসপাতাল রোডসংলগ্ন সেলিম ভিলা রোডের সেলিম ভিলার পাশে। যার হাউজ নং ৪৭৭/১, সাউথ চত্বর গাজীপুর। ভবনের নাম বন্ধন ভিউ। ফ্ল্যাট নং-৩ সি। এই ভবনের রাজউকের ছাড়পত্র আটকে দিয়ে তিনি এই ফ্ল্যাট লিখে নেন। বর্তমানে তিনি ফ্ল্যাটটি বিক্রির চেষ্টা করছেন। এ ছাড়া উত্তরা হাউজ বিল্ডিং ও খিলক্ষেত নিকুঞ্জ এলাকায় মুরাদ আলীর স্ত্রী রোকসানা পারভীনের নামে ৩টি ফ্ল্যাট রয়েছে। মুরাদ আলীর গাজীপুর চাপুলিয়া মৌজায় ১০ বিঘা জমি রয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে ২৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি এসব জমি কেনেন। এ ছাড়া মুরাদ আলী ও কয়েকজন পার্টনারশিপে কেনা নামে দু’টি দলিল পাওয়া গেছে। এরমধ্যে দলিল নং-৪১৬৫/১৫। জমি ৬.৬০ শতাংশ। আরেকটি দলিল নং-৬০৩২/১৫। জমি ৩.৩০ শতাংশ। এ ছাড়া পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলার শ্রীরামপুর গ্রামেও বাবা ও ভাইদের নামে জমি কিনেছেন মুরাদ। মুরাদ আলী ব্যক্তিগত গাড়িতে চড়ে অফিসে আসেন। গাড়ি নম্বর ঢাকা মেট্রো-গ- ১৩-০৮১৩।
স্ত্রীর নামে কোটি টাকার ডেভেলপার কোম্পানি: মুরাদ আলীর স্ত্রী রোকসানা পারভীনের একটি ডেভেলপার কোম্পানি রয়েছে। পনেরো ইঞ্জিনার্স হোল্ডিং লিমিটেড নামের এই কোম্পানির মাধ্যমে ভবন নির্মাণ করলেই অটো রাজউকের অনুমোদন মেলে। এই কাজে সহায়তা করেন ইমারত পরিদর্শক মুরাদ আলী। এই কোম্পানি দিয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকায় অনেক ভবন নির্মাণ ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণ করছেন মুরাদ আলী।
ঘুষ নিয়ে যত ফাইল পাস: গাজীপুর সিটি এলাকায় বাড়ি মালিকদের আতঙ্কের নাম ইমারত পরিদর্শক মুরাদ আলী। কোনো ভবনের প্লান পাস করতে গেলেই মুরাদ আলীর ইশারা থাকতে হয়। গাউকের বেশির ভাগ ফাইলের পেছনে এম চিহ্ন দেয়া থাকে। জয়দেবপুর মৌজায় ড্যাপের নকশায় চিহ্নিত জলাশয়ে ১৩ তলা ভবন নির্মাণের অনুমতি দিয়ে তেলেসমাতি কাণ্ড করেছেন মুরাদ আলী। গত বছর ২৬শে নভেম্বর গাউক থেকে এই ফাইল অনুমোদন হয়। সংশ্লিষ্ট নথিপত্রের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ভূমি ছাড়পত্রটি গাজীপুর সদর উপজেলার জয়দেবপুর মৌজার সিএস-৮৭৫ (অংশ), আরএস-২৪৫৩ (অংশ) খন্দকার নাজিমউদ্দিন গং অনুমোদন পান। যার স্মারক নং-১৫০৫.২৪.১৬৮১। বরুদা এলাকায় ৩৬ শতাংশ জমিতে এই ভূমি ছাড়পত্র প্রদান করা হয়। ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (২০২২-২০৩৫) বিশেষ প্রকল্পের আওতায় আবাসিক এলাকা দেখিয়ে এই ছাড়পত্র প্রদান করা হয়।
প্রস্তাবিত জমির পশ্চিম পাশে ২০ ফুট প্রশস্ত রাস্তা দেখানো হয়েছে। যাতে এ-৫ ক্যাটাগরিতে ১০ তলা বা তদূর্ধ্ব সুউচ্চ ভবন নির্মাণের অনুমতি নেয়া যায়। অথচ জমিটি চিহ্নিত জলাশয় এলাকা। এ ছাড়া ঘুষের মাধ্যমে মুরাদ আলী ফাইল পাস করেছেন তার কয়েকটি নথি মানবজমিনের হাতে এসেছে। এরমধ্যে ছাড়পত্রের নথি নং-১৪৩৫/২৪ একটি। ফাইলটি লুৎফর রহমানের নামে জমা হয়। মৌজা আড়াইশ’ প্রসাদ। নথি ইস্যু হয় মো. আব্দুস সোবাহান গং নামে। মৌজা আরিচপুর। আব্দুস সোবাহানের নামে যে নকশা অনুমোদন হয় তার নথি নং-১৫৯/২৫। এই ২টি ফাইলেই ছাড়পত্র জালিয়াতি করা হয়। এ ছাড়া জয়দেবপুরে একটি নকশা অনুমোদনে ভবনের সামনের ১০ ফিট রাস্তাকে ২০ ফিট দেখিয়ে ১১ তলার অনুমোদন নেয়া হয়। কাজী শায়লা শারমিন গং নথি নং ৬২/২৫। এটি ১১ তলা বিল্ডিং প্লান দেয়ার জন্য ২০ ফিট রাস্তা প্রয়োজন। কিন্তু মুরাদ টাকার বিনিময়ে ১০ ফিট রাস্তা থাকা এলাকাকে বিশেষ প্রকল্প এলাকা দেখিয়ে ছাড়পত্র দিয়ে দেন। এ ছাড়া আইরিশ ফ্যাশন লিমিটেডের সকল ভবন গাউকের অনুমোদন ছাড়াই করা। বর্তমানে মুরাদ তাদের ছাড়পত্র দিয়ে দিচ্ছে। ভূমি ছাড়পত্র ব্যবহার, ত্রুটিপূর্ণ জমিতে বিশেষ প্রকল্প দেখিয়ে ছাড়পত্র অনুমোদন করা হয়। এটারও ভূমি ব্যবহার ছাড়পত্র ও বিশেষ প্রকল্প ছাড়পত্র হয়েছে। গত কয়েক বছরে গাউক থেকে ৭ তলার অনুমোদন নিয়ে ৯ তলা এবং ১০ তলার অনুমোদন নিয়ে ১১ থেকে ১২ তলা ভবন নির্মাণ করেছে ভবন মালিকরা। মুুরাদ আলী রাজউকের নথি ধরে ধরে এসব ভবন মালিকদের নকশা বহির্ভূত ভবন নির্মাণের অভিযোগে নোটিশ পাঠান। কাউকে কাউকে মোবাইল ফোনে ভবন গুঁড়িয়ে দেয়ার অভিযানের হুমকি দেন। পরে কৌশলে ওই মালিকদের সঙ্গে সমঝোতা করে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নেন মুরাদ। এমন অসংখ্য অভিযোগের কপি মানবজমিনের হাতে রয়েছে।
যা বলেছেন মুরাদ আলী: জানতে চেয়ে ইমারত পরির্দশক মুরাদ আলীকে ফোন করা হলে তিনি মানবজমিনকে বলেন, প্রথমত আমি ফোনে কথা বলতে চাই না। আমার সঙ্গে কথা বলতে হলে গাজীপুর আসতে হবে। আর আমার এবং আমার পরিবারের সদস্যদের নামে যত সম্পদ রয়েছে সব বৈধ। অল্প বেতনে কীভাবে প্রায় ৫০ কোটি টাকার সম্পদ করলেন এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সব আমার ট্যাক্স ফাইলে উল্লেখ করা আছে। ট্যাক্স ফাইলে কোনো সম্পদের তথ্য নেই। এই তথ্য জানানো হলে তিনি ফোন কেটে দেন। এরপর একাধিকবার চেষ্টা করেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।