আহসান হাবীব ইমরুস (Ahsan Habib Imrose)
৬৪ বছরের জীবনে (১৯৫২-১৬) ৬৪ জেলার বাংলাদেশসহ তামাম মুসলিম দুনিয়ায় ইসলাম, সৌভ্রাতৃত্ব,সাহস ও উন্নয়নের নয়া জাগরণ এনেছিলেন তিনি।
শৈশব-কৈশোরে কুয়াশা-মাসুদরানায় বুদ ছিলাম। এমনও হয়েছে কারও বাগড়া এড়াতে সকালের নাস্তা মুখে গুজেই ২/১টি বই নিয়ে বাড়ির দক্ষিণ-পূবের বড় আম গাছটায় উঠে যেতাম । শেষ বিকেলে বই দুটি খতম করে তবেই নামতাম।
কলেজে উঠবো উঠবো তখনই ইনকিলাবের হাওয়া লাগলো প্রাণে। রুচির পরিবর্তন হলো । হাতে নিলাম অপারেশন তেলআবিব, মিন্দানাওয়ের বন্দী, পামিরের আর্তনাদ নামক দমবন্ধ হওয়া, রোমাঞ্চকর সাইমুম সিরিজ।
মানুষের এক অদ্ভুত প্রকৃতি, সে কল্পলোকের চরিত্রগুলো বাস্তবে পেতে চায়। তাই তারুণ্যের সেই অগ্নিঝড়া দিনে আমিও ইতি-উতি খুজছি সাইমুমের নায়ক আহমদ মুসা-কে। অবশেষে পেয়েও গেলাম, সেই গল্পই আজ বলছি ।
১৯৮৯ সালের এপ্রিলের এক গুমোট বিকেল। তখন আমাদের অফিস আদালত পাড়াতে বাকা মিয়ার বাসার তিনতলায় । এই বাকামিয়া ঐতিহ্যবাহী বানিয়ারার এক বিখ্যাত মানুষ, নিজে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনও করেছেন।
তখন দায়িত্বশীল বৈঠক চলছে। আমরা অধিকাংশই কেবলই ইন্টারের পর্ব শেষ করেছি মাত্র। টগবগে তারুণ্য; বুকে-চোখে বিপ্লবের ভিসুভিয়াস। ভাবতাম বিপ্লব এই কালই হলো বলে।
হঠাৎ চর্তুদিক অন্ধকার, ঝড়ো-বৃষ্টি মুহূর্তেই ভয়ঙ্কর রূপ নিলো প্রকৃতি। ভয়াবহ গর্জন ও বিদ্যুতের চমক। এক সময় সেই দানবীয় ঝড় থামলো।
বৈঠক বন্ধ করে সব সাথীরা শপথ নিলাম, সবার আগে দুর্গতদের পাশে যাব। তখনতো মোবাইল নেই, রিক্সাওয়ালাদের জিজ্ঞেস করে জানলাম, আদি টাঙ্গাইলে বেশ ক্ষতি হয়েছে।
রেসেরঘোড়ার মতো ছুটলাম সে দিকে। আ. কাদের, যোবায়ের ও মুনিরদের বাসার আশপাশে বেশ ক্ষতি হয়েছে । বাড়ির লোকজনের সাথে আমরাও যুক্ত হলাম বিধস্ত স্থাপনা পরিষ্কার, আহতদের উদ্ধারে। আমাদের দেখে সবাই অবাক কোথা থেকে, কীভাবে এলাম আমরা ।
রাতেই খবর এলো পশ্চিম আকুরটাকুর, কাগমারা এলাকাতেও প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পরদিন সকালেই দলবদ্ধভাবে সব এলাকায় ঝাপিয়ে পড়লাম উদ্ধার ও মেরামত কাজে।
গ্রুপলিডার ঠিক করে দূর্গত তিন এলাকার জন্যই আলাদা আলাদা গ্রুপ করা হলো । শুরু হলো সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মেরামত, ঘরতোলা, চিকিৎসাসহ সাধ্যানুযায়ী সকল তৎপরতা। প্রায় একমাস চললো এই অমানুষিক কাজ। এলাকার লোকজনও আমাদের সাথে নব-উদ্দীপনায় ঝাপিয়ে পড়েছে।
মাঝে মজার এক ঘটনা, কাজ প্রায় শেষ এমন একদিনে হাজির হলেন সাবেক স্বরাষ্টমন্ত্রী, বর্তমান এমপি আব্দুল মান্নান সাহেব। তার সাদা ফিনফিনে পাঞ্জাবি উড়ছে । একজন সঙ্গী নিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। আমরা কাছে এগিয়ে গেলাম । তিনি আমার বেশ ঘনিষ্ট আত্মীয়ও বটে। আফসোসের সাথেই বললেন, আমিতো এলাকার এমপি কিন্তু তোমরাইতো সব করে ফেললে আমি এখন কী করবো ?
সেই এক মাস সেসব এলাকাতে এত ব্যাপক মানবিক কাজ হয়েছিলো যে, বিদায়ের সময় সে এলাকার মানুষেরা আমাদের জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে। ওয়াদা নেয়ার চেষ্টা করেছে গ্রুপলিডারদের যেন সামনের নির্বাচনে সে এলাকাতে দাঁড় করিয়ে দেই।
প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি , হাজার মানুষের আহাজারি। কে যেন বুদ্ধি দিলেন, বাংলাদেশের রাবেতা-আলম আল ইসলামির প্রধানের কাছে সাহায্য চাইতে। সে মাফিক ব্যবস্থা হলো । অবশেষে আবেদনসহ ঢাকায় যাওয়ার ডাক পেলাম। আমি কেবলই ইন্টার শেষ করেছি, সব ভালো চিনিও না কিন্তু সমগ্র জেলার দায়িত্বশীল হিসেবে আমাকেই যেতে হলো ।
কম্পিতবক্ষে নির্দেশ মতো ইবনেসিনা ফার্মার অফিসে গেলাম । গ্লাসের ওপাশে কর্তারা লাঞ্চ করছেন। পরে জেনেছি লাঞ্চ খেতে খেতেই তারা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং সেরে ফেলেন। কীভাবে যেন রাবেতা-প্রধান কালোগ্লাসের ফাক গলে আমাকে দেখে ফেলেছেন, অথচ আমি দেখিনি।
একজন স্টাফ পাঠিয়ে আমার আবেদনপত্র চেয়ে নিলেন। একটু পরই সে স্টাফ হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বললো, এই যে নিন, আপনার আবেদন পাস হয়েছে ; এখনই রাবেতা অফিসে যান বন্ধ হওয়ার আগেই ত্রাণ সংগ্রহ করুন।
বিকেলে ত্রাণ বোঝাই ট্রাক নিয়ে টাঙ্গাইল ফিরছি , তাতে ঠাসা নানা রকম বিদেশী আসবাব, খাবারের সম্ভার । চোখে ভাসছে টাঙ্গাইলের হাজারো দুর্গত মানুষের মুখোচ্ছবি; ত্রান পেয়ে তাদের তৃপ্তির হাসি। পশ্চিমে সূর্যটা ক্রমেই ফিকে হয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে।
আবারো হাতে নিলাম কাঁচাহাতে লেখা আমার আবেদনটা । মনে হলো সবকিছু ছাপিয়ে আবেদনে রাবেতা-প্রধানের স্বাক্ষরটা যেন পূর্ণিমা চাঁদের মতোই জ্বলজ্বল করছে ।
অবাক কান্ড! স্বাক্ষরের জায়গাতে হলদেটে দাগ। বুঝলাম, সেই মহীয়ান জেলা থেকে আসা এ নবীন দায়িত্বশীলকে এক লহমা দাঁড় করিয়ে রাখতে চাননি। চাননি অসহায় দুর্গত মানুষেরা একদিনও বেশি কষ্ট করুক । তাই খাওয়ার মাঝখানেই ঝোলমাখা হাতেই তিনি স্বাক্ষর করেছেন।
সন্ধ্যের সূর্যটা হুট করেই হারিয়ে গেলো। কী এক আবেগে ঝোলযুক্ত স্বাক্ষরওয়ালা আবেদনটা বুকে চেপে ধরলাম। এক দুর্নিবার বিচ্ছুরিত আলোয় ভরে উঠলো আমার মনের দিগন্ত । একহাতে সেই আবেদন আর হাতে চোখের কোনায় আনন্দের অশ্রুমালা সামাল দিচ্ছি।
মনের গহীন ভেতর থেকে উচ্চারিত হলো , হ্যাঁ আমাদেরও অপারেশন তেলআবিব, মিন্দানাওয়ের বন্দী, পামিরের আর্তনাদ থেকে মুক্তির একজন আহমদ মুসা আছেন; তিনি রাবেতা-প্রধান, আরো শত সফল প্রতিষ্ঠানের স্বপ্নদ্রষ্টা মীর কাশেম আলী । আজ তিনি মরহুম মীর কাশেম আলী।
হ্যাঁ তিনিও প্রদীপ্ত সূর্যের আলো ছড়িয়ে দ্রুতই বিদায় নিলেন। কিন্তু না, সূর্যের মতোই তিনি আগামীকাল আর আসবেন না ।
তবে রেখে গেলেন লক্ষ অনুরাগীর হৃদয়ে তার আপন মাহাত্ম্যের মখমল ছোয়া আর প্রেরণার ছড়ানো পেখম।