
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষ্যে সাড়ে ১১ লাখ মানুষকে প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ২৯ আগস্ট কোর ট্রেইনারদের প্রশিক্ষণ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। এর মধ্য দিয়ে সংসদ নির্বাচনের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। এটা চলবে প্রায় ৫ মাস। এ সময়ে প্রায় ১১ হাজার (১০৮৫০) জন রাজনৈতিক কর্মীকে ‘মাস্টার ট্রেইনার’ হিসাবে প্রশিক্ষণ দেবে ইসি। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা তাদের দলীয় পোলিং এজেন্টদের দায়িত্ব-কর্তব্য, ভোটগ্রহণের নিয়ম-কানুন এবং আইন ও বিধি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেবেন।
নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রথমবার এ ধরনের প্রশিক্ষণ আয়োজন করা হয়েছিল। তখন খুব একটা সুফল পাওয়া যায়নি। এবারও নির্বাচনি প্রশিক্ষণ পরিকল্পনায় সম্ভাব্য ১০ হাজার ৮৫০ জন রাজনৈতিক কর্মীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। তারা আশা করছেন, পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এবার সুফল পাওয়া যাবে। পোলিং এজেন্টদের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে জানা থাকলে ভোটের দিন কাজ করা সহজ হবে। ইসি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
জানতে চাইলে নির্বাচনি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (ইটিআই) মহাপরিচালক এসএম আসাদুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর পোলিং এজেন্টরা ভোটের দিন ভোটকেন্দ্রে থাকেন। তাদের নির্বাচনি আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী দায়িত্ব, কর্তব্য ও করণীয় বিষয়ে সচেতনতা তৈরির জন্য মাস্টার ট্রেইনার তৈরি করা হবে। তারা দলীয় পোলিং এজেন্টদের প্রশিক্ষণ দেবেন। এতে ভোটগ্রহণের দিন পোলিং এজেন্টরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করার বিষয়ে সচেতন থাকবেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও নির্বিঘ্ন করতে যত ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, ইসি তার সবই করছে। এরই অংশ হিসাবে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আমরা আশা করছি, নির্বাচনে এর বড় সুফল পাওয়া যাবে।
আরও জানা গেছে, ফেব্রুয়ারিতে ভোটগ্রহণ এবং ডিসেম্বরে তফশিল ঘোষণা সামনে রেখে এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। এবার ২৩ ধরনের প্রশিক্ষণের আয়োজন করবে ইটিআই। এর আওতায় ১১ লাখ ৬৮ হাজার ব্যক্তিকে ট্রেনিং দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে আছেন ১০ লাখ ৮৯ হাজার প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং এবং পোলিং কর্মকর্তা। নির্বাচনে ৪৫ হাজার ভোটকেন্দ্র হতে পারে, এমনটা ধরে এই সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে। ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা কমে এলে প্রশিক্ষণার্থী ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার সংখ্যাও কমবে। এছাড়া যাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে তারা নির্বাচন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা, নির্বাহী ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটসহ বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী। এর মধ্যে রয়েছেন সাংবাদিক ও দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকরাও। তাদেরও দিনব্যাপী নির্বাচনি প্রশিক্ষণ দেবে কমিশন। যদিও ওই প্রশিক্ষণের নাম দেওয়া হয়েছে ‘ওরিয়েন্টেশন বা ব্রিফিং’। কেন্দ্রীয় ও মাঠপর্যায়ে পৃথকভাবে এসব প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হবে।
এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে প্রায় ১১০-১২০ কোটি টাকা খরচ হবে। নির্বাচনের প্রধান আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনীর অধ্যাদেশ জারি না হওয়ায় এখনো নতুন প্রশিক্ষণ ম্যানুয়েল তৈরি করতে পারেনি ইটিআই। এ কারণে ‘নির্বাচনি পরিচালনা বিধিমালা’ এবং ‘সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা’ চূড়ান্ত হয়নি। ফলে নির্বাচনি ব্যবস্থায় যেসব সংস্কার ও সংশোধন হচ্ছে, সেগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল ছাপা সম্ভব হয়নি।
রাজনৈতিক কর্মীদের প্রশিক্ষণের সুফল নিয়ে প্রশ্ন : সূত্র জানায়, নির্বাচনে প্রার্থী চূড়ান্ত হওয়ার পর অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দল বা প্রার্থীর কাছ থেকে ৩-৫ জনের তালিকা নিয়ে ওইসব ব্যক্তিকে মাস্টার ট্রেইনারের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। ইসির মাঠপর্যায়ের কার্যালয়গুলো এসব কার্যক্রম পরিচালনা করবে। প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের নির্বাচনি উপকরণ দেওয়া হয়। ইসি সচিবালয়, ইটিআই ও মাঠপর্যায়ের পাঁচজন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, অতীতে এ ধরনের প্রশিক্ষণের সুফল পাওয়া যায়নি। তারা বলেন, এ ধরনের প্রশিক্ষণে সাধারণত রাজনৈতিক কর্মীরা আগ্রহ দেখান না। আবার যারা অংশ নেন, তারা নিজ দলের পোলিং এজেন্টদের খুব কমই প্রশিক্ষণ দেন। এছাড়া বিগত নির্বাচনে প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক কর্মীদের হয়রানি করার বিস্তর অভিযোগ ছিল। এমনকি প্রশিক্ষণে অংশ নিতে এসে অনেকেই গ্রেফতার হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। তখনকার নির্বাচন কমিশন তাদের রক্ষার উদ্যোগ নেয়নি। ওই কর্মকর্তারা আরও বলেন, এবার ভিন্ন প্রেক্ষাপটে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। অনেক নতুন দল এবার নির্বাচনে অংশ নেবে। তারা হয়তো আগ্রহ দেখাবেন।
প্রশিক্ষণযজ্ঞ শুরু ২৯ আগস্ট : সূত্র আরও জানায়, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দুই ব্যাচে ৭৫ জন কোর ট্রেইনারদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে ইটিআই। প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণ ২৯ ও ৩০ আগস্ট ইটিআইতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। পরবর্তী ব্যাচের প্রশিক্ষণ হবে ৫ ও ৬ সেপ্টম্বর। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে এই ৭৫ জন বাছাই করা হচ্ছে। যদিও ২৮ আগস্ট প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন কানাডা প্রবাসী ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রম উদ্বোধন করতে যাবেন। তার অনুপস্থিতিতে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে।
এছাড়া সেপ্টম্বরের শুরুতে নির্বাচন ব্যবস্থাপনার ওপর প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ শুরুর কথা রয়েছে। সম্ভাব্য এক হাজার ৫৩৪ জনকে এ প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে নির্বাচন কমিশনে সম্প্রতি যোগ দেওয়া কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম থাকায় এই প্রশিক্ষণ সেপ্টম্বরের শেষের দিকে শুরু হতে পারে। ইসির কর্মকর্তারা জানান, বিদ্যমান আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী এসব কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। আইন ও বিধিমালা সংশোধন হলে সেগুলো নিজ দায়িত্বে রপ্ত করার জন্য তাদের নির্দেশনা দেওয়া হবে।
আরও যারা প্রশিক্ষণ পাবেন : এবার নির্বাচনে যে ১১ লাখ ৬৮ হাজার ব্যক্তিকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। তার মধ্যে উপজেলা ও থানাভিত্তিক সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা রয়েছেন সম্ভাব্য ২১০০ জন। তারা প্রশিক্ষক হিসাবে এ প্রশিক্ষণ পাবেন। অন্যান্য ক্যাটাগরির মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সম্ভাব্য ৫০ হাজার কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, আরপিও সংশোধনী পাশ হলে সশস্ত্র বাহিনীও (সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী) স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসাবে মাঠে থাকবে। এই তিন বাহিনীর কর্মকর্তাদেরও প্রশিক্ষণের আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া ৭২ জন রিটার্নিং ও ৬০০ জন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা, ১১৮৮ জন নির্বাহি ম্যাজিস্ট্রেট, ইলেকটোরাল ইনকোয়ারি কমিটির ৩০০ জন সদস্য পৃথক প্রশিক্ষণ পাবেন। এ কর্মসূচির আওতায় কেন্দ্রীয় ও মাঠপর্যায়ে চার হাজার সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকদেরও নির্বাচনি আইনবিধির ওপর ধারণা দেওয়া হবে।