
যানজট নিরসনে নেয়া মহাসড়ক প্রকল্পও চলছে ঢিমেতালে। দুই দফায় আড়াই বছর সময় বাড়ানোর পাশাপাশি খরচ বাড়ল ৪০ কোটি টাকা। প্রকল্পের যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই না হওয়া, প্রকল্প পরিচালক ঘন ঘন পরিবর্তন, ইউটিলিটি স্থানান্তরে অতিরিক্ত সময় ব্যয়, ভূমি অধিগ্রহণে বিলম্বের কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি হওয়ায়। পুরো মেয়াদে বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৫৮ শতাংশ। সরকারি খাতে উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই বাধ্যতামূলক, যা ২০১৬ সালের পরিপত্র মোতাবেক ৫০ কোটি টাকার ঊর্ধ্বের প্রকল্পে প্রযোজ্য। প্রকল্পের আওতায় ৮৯.৩৬ একর ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদনে কোনো পর্যালোচনা নেই। এর ওপর নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি এবং সড়কের অতিরিক্ত লোড-জনিত ক্ষতির মতো ঝুঁকিগুলোর সমাধান করা জরুরি বলে আইএমইডি মনে করছে। প্রকল্পটি যৌক্তিক ও সময়োপযোগী হলেও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। প্রায় ৪০ শতাংশ কাজ বাকি থাকায় প্রকল্পটি চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের (সওজ) তথ্য থেকে জানা গেছে, সিরাজগঞ্জ-কাজিপুর-ধুনট (জেড-৫৪০১) সড়কটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা সড়ক যার দৈর্ঘ্য ৫৫.২৩ কিলোমিটার। ওই সড়ক দিয়ে ২৪ ঘণ্টায় অসংখ্য যানবাহন চলাচল করে। সড়কটি মূলত সিরাজগঞ্জ শহরের কাজিপুর মোড় থেকে শুরু হয়ে কাজিপুর উপজেলা এবং ধুনট উপজেলা হয়ে বগুড়া জেলার শেরপুরে জাতীয় মহাসড়ক এন-৫-এর সাথে মিলিত হয়েছে। সড়কটি দু’টি জেলাকে স্বল্পতম দূরত্বে সংযোগ স্থাপন করেছে বিধায় সড়কটি জেলা আঞ্চলিক মহাসড়কে উন্নীতকরণ প্রয়োজন। এ ছাড়াও যমুনা সেতুর পশ্চিম প্রান্তের অ্যাপ্রোচ সড়কে এবং জাতীয় মহাসড়ক এন-৫-এ দুর্ঘটনা বা যানজট সৃষ্টি হলে উত্তরবঙ্গে যাতায়াতের জন্য বিকল্প সড়ক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সড়কটির প্রশস্ততা কম থাকায় যানজট এবং দুর্ঘটনা একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সড়কটির প্রথম কিলোমিটার থেকে চতুর্থতম কিলোমিটার পর্যন্ত মোট চার কিলোমিটার চার-লেনে এবং অবশিষ্ট অংশ সাড়ে পাঁচ মিটার থেকে ৭.৩০ মিটার (হার্ড সোল্ডার ২ ঢ ১.৫০ মিটার) এ উন্নীতকরণের উদ্যোগ নেয়া হয়। সিরাজগঞ্জ-বাগবাটি-ধুনট (সোনামুখি) (জেড-৫৪০৫) মহাসড়কটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা সড়ক যার মোট দৈর্ঘ্য সাড়ে ২১ কিলোমিটার। সড়কটি মূলত সিরাজগঞ্জ-কাজিপুর-ধুনট-শেরপুর সড়কের ঘোড়াচড়া মোড় থেকে শুরু হয়ে বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার সাথে মিশেছে। সড়কের বিভিন্ন অংশে ৩.৬৩ কিলোমিটার কাঁচা সড়ক এবং ১৭.৮৭ কিলোমিটার সড়ক ৩.৭০ মিটার বা ১২ ফুটের মতো প্রস্থ হওয়ায় যানবাহন চলাচলে ব্যাপক অসুবিধা হয়।
তা ছাড়া সড়কের কয়েকটি স্থানে তীব্র বাঁক থাকায় প্রায়ই সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। সড়কটিতে বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় যানবাহন চলাচল করছে। জনদুর্ভোগ নিরসনের লক্ষ্যে কাঁচা সড়ক পাকা করা, বাঁক সোজা করাসহ সড়কটি সাড়ে পাঁচ মিটার প্রশস্ততায় উন্নীত করার কাজ চলমান রয়েছে। ২০১৯ সালের অক্টোবরে একনেক সভায় ৯৮৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়া হয় যা ২০২২ সালের জুনে শেষ করার কথা।
পরবর্তী সময়ে প্রকল্পটির ব্যয় ও মেয়াদ বৃদ্ধি করে এক হাজার ২৮ কোটি ৬১ লাখ ১৯ হাজার টাকা ব্যয়ে ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ মেয়াদে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৭ অক্টোবর ২০২২ সালে প্রকল্পটির প্রথম সংশোধন অনুমোদিত হয়। এরপর ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া মেয়াদ আরো দেড় বছর বৃদ্ধি করে ৩০ জুন ২০২৫ পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়।
প্রকল্পের আওতায় প্রধান কাজগুলো হলো : যেহেতু মহাসড়ক উন্নয়ন, তাই মূল কাজগুলো ভূমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিপূরণ। যার পরিমাণ হলো, ৮৯.৩৮৬ একর। এ ছাড়া ২৭ লাখ ২০ হাজার ২০৯.২৫ ঘনমিটার সড়ক বাঁধে মাটির কাজ, চার লেন রাস্তা নির্মাণ চার কিলোমিটার, দুই লেন রাস্তা নির্মাণ ৪২.২০ কিলোমিটার, কঠিন পিচঢালা সড়ক নির্মাণ দুই কিলোমিটার, বাঁক সরলীকরণ (১০.৩০ মি) ৩০০ মিটার, আরসিসি রিজিড পেভমেন্ট নির্মাণ দুই কিলোমিটার, পিসি গার্ডার সেতু নির্মাণ (তিনটি) ১৭৯.৪ মিটার, আরসিসি বক্স কালভার্ট নির্মাণ (১২টি) ৬৯ মিটার, আরসিসি বক্স কালভার্ট বর্ধিতকরণ/প্রশস্থকরণ (২৭টি) ২৫৪.১৫ মিটার, বাস-বে নির্মাণ ২৪ টি, কংক্রিট স্লোপ প্রটেকশন উইথ জিও টেক্সটাইলস এক লাখ ছয় হাজার ৫০ ব.মি, রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ ৬.৩ কি.মি, ব্রিক ম্যাশনারি টো-ওয়াল নির্মাণ ৫৬ শ’ মি, সসার ড্রেন নির্মাণ ১৪.৭৭০ কি.মিটার।
প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি : ৫৮ শতাংশ : প্রকল্পের আওতায় আরডিপিপি অনুযায়ী কার্য ক্রয়ের ১১টি প্যাকেজ রয়েছে। এরমধ্যে তিনটি প্যাকেজের কাজ শতভাগ সম্পন্ন করা হয়েছে। দু’টি প্যাকেজের কাজ বর্তমানে চলমান রয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন না হওয়ায় ছয়টি প্যাকেজের কাজ বন্ধ আছে। ২০২৫ সালের মে পর্যন্ত প্রকল্পের ক্রমপুঞ্জিত আর্থিক অগ্রগতি ৫১.৫৬ শতাংশ। অর্থাৎ ৫৩০ কোটি ৩৪ লাখ ৩৯ হাজার টাকা। যেখানে বাস্তব অগ্রগতি ৫৮ শতাংশ।
সমীক্ষাতেই ছিল দুর্বলতা : পরিকল্পনা কমিশনের তথ্য বলছে, প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন অক্টোবর ২০১৯-এ তৈরি করে মূল ডিপিপিতে সন্নিবেশ করা হয়। তবে প্রতিবেদনটি কার দ্বারা তৈরি হয়েছে তা স্পষ্ট নয়। ২০১৯ সালের ১ অক্টোবর, সম্ভাব্যতা সমীক্ষার ভিত্তিতে প্রকল্প মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করা হয়, যার আলোকে মূল ডিপিপি প্রণয়ন করা হয়। তবে মাঠপর্যায়ে উপকারভোগী জরিপ এবং ইউটিলিটি স্থানান্তর বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। প্রকল্পের আওতায় ৮৯.৩৬ একর ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়ে ফিজিবিলিটি স্টাডিতে কোনো পর্যালোচনা নেই। ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে মৌজা পরিবর্তন সংক্রান্ত জটিলতার কারণে প্রকল্প সংশোধন করতে হয়। ভূমি অধিগ্রহণসহ সম্ভাব্য জটিলতা যথাযথভাবে পর্যালোচনা করা হলে এ ধরনের সমস্যা এড়ানো সম্ভব হতো।
অডিটে ৯.৩৮ কোটি টাকার অভিযোগ : অডিট সংক্রান্ত পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২১-২২ এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ইন্টারনাল অডিট থেকে মোট ৯টি আপত্তি উত্থাপন করা হয়েছে, যার মধ্যে ২০২১-২২ সালে ছয়টি এবং ২০২৩-২৪ সালে তিনটি আপত্তি অন্তর্ভুক্ত। প্রধান আপত্তিগুলোর মধ্যে ছিল : ভুল প্রাক্কলন, যথাযথ চুক্তি না করা, বীমা না করা, স্যালভেজ মালামালের মূল্য নির্ধারণ না করা এবং নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না করায় জরিমানা আদায় না করা। বিশেষভাবে, উপযুক্ত মাটিকে অনুপযুক্ত মাটি দেখিয়ে বিল পরিশোধ করার কারণে উভয় অর্থবছরে সম্মিলিতভাবে প্রায় ৯.৩৮ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির অভিযোগ ওঠে। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, প্রকল্প এলাকায় এখন পর্যন্ত কোনো এক্সটার্নাল অডিট পরিচালিত হয়নি, যা প্রকল্পের আর্থিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে একটি বড় ঘাটতি হিসেবে বিবেচিত। এতে প্রকল্পের কার্যক্রমে আর্থিক শৃঙ্খলা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে।
প্রকল্প সম্পর্কে পরিকল্পনা কমিশনের আইএমইডি বলছে, সার্বিক পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রকল্পের আওতায় ভূমি অধিগ্রহণ, সড়কের পাশের গাছ কাটা এবং বৈদ্যুতিক খুঁটি অপসারণে বিলম্ব হওয়ায় প্রকল্পের নির্মাণকাজ বিলম্বিত হচ্ছে। জুন ২০২৫ সালের মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও পরিকল্পিত অবশিষ্ট কাজ সম্পন্ন করা সম্ভবপর হবে না। সড়ক নির্মাণ ও স্লোপ সুরক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো ইতোমধ্যে শেষ হলেও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলোর অগ্রগতি ধীরগতির হওয়ায় প্রকল্পের সামগ্রিক অগ্রগতি এখনো সন্তোষজনক নয়। তাই মনিটরিং কার্যক্রম আরো জোরদার করতে হবে। ভূমি অধিগ্রহণে বিলম্ব নিরসনে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোকে জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। অনুমোদন ছাড়া নির্মাণ, অপরিশোধিত ক্ষতিপূরণ, ভুল প্রাক্কলন এবং অডিট আপত্তি দ্রুত নিষ্পত্তি করা প্রয়োজন। ভবিষ্যতের প্রকল্প গ্রহণে সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় ভূমি অধিগ্রহণ ও ইউটিলিটি স্থানান্তর বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।