
কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয় শিবিরে ১৩ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। প্রতিদিনই সীমান্তের স্থল-জলের কোনো না কোনো পয়েন্ট দিয়ে আসছে রোহিঙ্গা। এমন প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গা ঢলের অষ্টম বর্ষপূর্তির দিনে কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ‘রোহিঙ্গা বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলন’। কক্সবাজার সাগরপাড়ের ইনানী সেনা রেস্টহাউসে ২৪ আগস্ট কক্সবাজারে শুরু হওয়া এ সম্মেলনে ২৫ আগস্ট যোগ দেবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
গেল রমজানে জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেসকে পাশে বসিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণা দিয়েছিলেন আগামী রমজানের (ফেব্রুয়ারি-মার্চ) ঈদ রোহিঙ্গারা স্বদেশে (রাখাইন) করবেন। এবারও প্রধান উপদেষ্টার সফর নিয়ে রোহিঙ্গারা নতুন করে আশায় বুক বাঁধছেন। শুধু ক্যাম্প নয়, গোটা কক্সবাজার জেলায় এখন আলোচনা চলছে প্রধান উপদেষ্টার এ সফরের মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের কোনো উপায় বের হবে কি না?
এমন বাস্তবতায় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ও সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে সহিংসতায় আবারও বাংলাদেশমুখী হচ্ছে রোহিঙ্গারা। সম্প্রতি কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের আশ্রয়শিবিরে নতুন করে আসা রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছে। সরকারি হিসাবে তাদের নাম নেই। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারে এখন পর্যন্ত অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা প্রায় ১৩ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরবর্তী কয়েক মাসে। আট বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। এ অবস্থায় আবার তাদের অনুপ্রবেশ ঘটছে। টেকনাফ রোহিঙ্গা ক্যাম্প সূত্র জানায়, গত এক সপ্তাহে কমপক্ষে ২০০ জনের অধিক রোহিঙ্গা কক্সবাজারে অনুপ্রবেশ করেছে।
স্থলপথে বিজিরিব কড়াকড়ির কারণে তারা ভেলা-ছোট নৌকায় চড়ে নাফ নদ পাড়ি দিয়ে অনুপ্রবেশ করে ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে বলে স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সীমান্তে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা জড়ো হয়েছে। তবে তারা ব্যাপক হারে বাংলাদেশে ঢুকতে পারছে না।
গত বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, আগামী ২৪, ২৫ ও ২৬ আগস্ট কক্সবাজারে রোহিঙ্গা বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। সরকার রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে এবং এ বিষয়ে আমরা বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কাজ করছি। সেই ধারাবাহিকতায় রোহিঙ্গা সংকটকে আবারও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আনতে তিনটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, তার প্রথমটি ২৪ আগস্ট শুরু হবে, এরপর ৩০ সেপ্টেম্বর সবচেয়ে বড় সম্মেলন হবে জাতিসংঘে। সেখানে আশা করছি ১৭০টি দেশ অংশ নেবে। তারপর আমরা আরেকটা বড় সম্মেলন আশা করছি কাতারের দোহাতে।
রোহিঙ্গারা যে মানবিক সংকটের মুখোমুখি, সেটিকে আন্তর্জাতিক ফোরামে তুলে ধরা সহজ নয়। এজন্য কক্সবাজারে আয়োজিত সম্মেলনে প্রায় ৪০টি দেশের প্রতিনিধি, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর অংশগ্রহণ আশা করা হচ্ছে। সেখানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সরাসরি সম্পৃক্ত হয়ে নিজেদের কথা বলার সুযোগ পাবেন।
এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে আরকান আর্মির রাখাইনে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় জান্তার সঙ্গে সংঘাত, ত্রাণ তহবিল কমে যাওয়াসহ নানা কারণে প্রত্যাবাসনের স্বপ্ন ‘কঠিন’ হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন রোহিঙ্গা নেতারা।
এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক পরিম লে নিজেদের মর্যাদা, অধিকার ও স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আকাঙ্ক্ষা প্রতিষ্ঠা ও নিজেদের সংগঠিত রাখার লক্ষ্য নিয়ে ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশ্রিত রোহিঙ্গারা গেল ১৬ আগস্ট অনানুষ্ঠানিক ভোটের মাধ্যমে নিজেদের মতপ্রকাশ করে নির্বাচিত করেছেন পাঁচ নেতা। তারা হলেন- ১৫ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মৌলভি সৈয়দ উল্লাহ, ১৩ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের খিন মং, ১ নম্বর ইস্ট রোহিঙ্গা ক্যাম্পের জাহাঙ্গীর আলম, ১ নম্বর ওয়েস্ট রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মোহাম্মদ শোয়াইফ এবং ১৫ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সাজেদা বেগম। নির্বাচিতদের নাম ঘোষণা করেন রোহিঙ্গা কমিউনিটি শিক্ষক মাস্টার মোহাম্মদ কামাল। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে অনুষ্ঠিতব্য সবচেয়ে বড় সম্মেলনে তারা রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব করবেন বলে জানা গেছে।
নির্বাচিত রোহিঙ্গা নেতা সৈয়দ উল্লাহ বলেন, ‘আমাদের মূল লক্ষ্য হলো অধিকার, মর্যাদা এবং সমতার সঙ্গে নিজেদের মাতৃভূমি আরাকানে ফেরার স্বপ্ন পূরণ করা। সে লক্ষ্যে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে নতুন এই যাত্রা শুরু করেছি। রোহিঙ্গারা আজীবন বাংলাদেশের কাছে কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশের সরকারপ্রধান (প্রধান উপদেষ্টা) ড. ইউনূস গত রমজানে আমাদের যে স্বপ্ন দেখিয়েছেন, আমরা আশাবাদী আমাদের জন্য কিছু করবেন। আমরা তাঁর ওপর আস্থা রাখতে চাই।’