
কম খরচ, কম সময়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ও সেবা মেলায় প্রান্তিক মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে টেলিমেডিসিন সেবা। তবে অর্থ সংকটে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয় ইন্টারনেটভিত্তিক এই মানসম্পন্ন চিকিৎসা প্রদান প্রকল্প। যদিও থমকে যাওয়া এ সেবা আবার চালুর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এবার এ সেবায় যুক্ত করা হচ্ছে স্টাফ নার্সদের, যেন রোগীরা নিয়মিত ও সহজে চিকিৎসা পরামর্শ পেতে পারেন।
স্টাফ নার্সদের যুক্ত করে টেলিমেডিসিন সেবা চালু রাখার উদ্যোগ একদিকে আশা জাগানিয়া হলেও নতুন করে শঙ্কা তৈরি করেছে পুরোনো টেলিমেডিসিন স্টাফদের জন্য। কারণ দীর্ঘ দেড় দশক ধরে অস্থায়ীভাবে কাজ করে যাওয়া অভিজ্ঞ টেলিমেডিসিন স্টাফরা এ উদ্যোগ থেকে বাদ পড়ছেন। এতে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন পুরোনো কর্মীরা।
বর্তমানে ২৩৪টি টেলিমেডিসিন সেন্টারে চিকিৎসকদের পাশাপাশি নার্সদের দায়িত্ব পালনের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। ‘এখনই স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোরগোড়ায়’ কর্মসূচি কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।- এমআইএস, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) থেকে পাঠানো এক চিঠিতে সারাদেশের টেলিমেডিসিন সেন্টারগুলোতে নির্ধারিত স্টাফ নার্সদের সম্পৃক্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এমআইএস পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) ডা. রুকসানা আক্তার স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, বর্তমানে ২৩৪টি টেলিমেডিসিন সেন্টারে চিকিৎসকদের পাশাপাশি নার্সদের দায়িত্ব পালনের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। ‘এখনই স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোরগোড়ায়’ কর্মসূচি কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এ নির্দেশনার ফলে টেলিমেডিসিন কার্যক্রম আরও গতিশীল ও জনসেবামুখী হবে বলে আশা প্রকাশ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
‘অর্থ সংকটে টেলিমেডিসিন প্রকল্পের মেয়াদ গত বছরের ডিসেম্বর থেকে আর বাড়ানো যায়নি। যে কারণে অনেক স্টাফের বেতন কয়েক মাস ধরে বন্ধ। আমাদের অর্থ সংকট এখনো কাটেনি। ফলে তাদের রেখে সেন্টারগুলো চালানো সম্ভব হচ্ছে না।’ -সুখেন শেখর রায়, সিস্টেম অ্যানালিস্ট (এমআইএস)
টেলিমেডিসিনের একটি বড় সুবিধা হলো রোগীকে সরাসরি চিকিৎসকের কাছে যেতে না হলেও ভিডিওকলের মাধ্যমে পরামর্শ ও প্রাথমিক চিকিৎসা পাওয়া সম্ভব। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে টেলিমেডিসিন প্রকল্পের মাধ্যমে ২৩৪টি সেন্টার থেকে ভিডিওকলের মাধ্যমে বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে প্রান্তিক পর্যায়ের রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। টেকনোলজিতে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন করে সাপোর্ট স্টাফ প্রতিটি সেন্টার পরিচালনা করেন।
কিন্তু ২০২৪ সালের জুন মাসের পর থেকে অর্থ সংকটে পড়ে বন্ধের মুখে প্রয়োজনীয় এ স্বাস্থ্যসেবা। এ নিয়ে সম্প্রতি অর্থ সংকটে বন্ধের পথে প্রান্তিক রোগীদের ‘টেলিমেডিসিন সেবা’ শিরোনামে জাগো নিউজে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। সেই সংবাদের পর কর্তৃপক্ষের নজরে আসে বিষয়টি।
নার্সদের মাধ্যমে টেলিমেডিসিন সেন্টার পরিচালনার সিদ্ধান্তের বিষয়টি নিশ্চিত করে এমআইএসের সিস্টেম অ্যানালিস্ট সুখেন শেখর রায় জাগো নিউজকে বলেন, ‘টেলিমেডিসিন সেন্টারগুলো উপজেলা হাসপাতালে। সেখানকার একজন স্টাফ নার্সকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এখন থেকে তারাই টেলিমেডিসিন সেন্টার চালাবেন।’
‘চাকরিরত অবস্থায় গ্র্যাজুয়েশন শেষ করি। আমরা আশা করেছিলাম গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পের স্টাফ হিসেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আমাদের বিষয়টি বিবেচনা করবে। এখন আমার সরকারি চাকরির বয়সও শেষ। এ প্রকল্প থেকে বাদ দিলে আমরা কোথায় যাবো? সরকার নানান খাতে এত ব্যয় করছে। এই ২৪০ জনকে কেন রাখতে পারবে না?’- আলমগীর হোসেন, সাপোর্ট স্টাফ (সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল টেলিমেডিসিন সেন্টার)
সুখেন শেখর রায় বলেন, ‘অর্থ সংকটে টেলিমেডিসিন প্রকল্পের মেয়াদ গত বছরের ডিসেম্বর থেকে আর বাড়ানো যায়নি। যে কারণে অনেক স্টাফের বেতন কয়েক মাস ধরে বন্ধ। আমাদের অর্থ সংকট এখনো কাটেনি। ফলে তাদের রেখে সেন্টারগুলো চালানো সম্ভব হচ্ছে না।’
তবে এসব সেন্টার চালানোর মতো প্রযুক্তি জ্ঞান নার্সদের আছে কি না- জানতে চাইলে সুখেন শেখর রায় বলেন, ‘তারা এ ধরনের ভিডিওকল পরিচালনায় অভ্যস্ত। তাছাড়া তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা হবে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, সারাদেশের ২৩৪টি সেন্টারের মধ্যে ৯৪টি সেন্টারের মেয়াদ ২০২৬ সালের মার্চ পর্যন্ত। বাকি ১৪০টি সেন্টারের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস বিভাগের উদ্যোগে সারাদেশে চলমান টেলিমেডিসিন সেবাকেন্দ্রের মধ্যে সেবা প্রদানকারী ৩৯টি এবং সেবা গ্রহণকারী ১৯৪টি। এসব সেবাকেন্দ্রের মধ্যে ১৪টি বিশেষায়িত হাসপাতাল, ১৩টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ১২টি জেলা হাসপাতাল এবং ১৯৪টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। টেলিমেডিসিন কেন্দ্রগুলোর সমন্বয়ের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস বিভাগে একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ রয়েছে।
এই সেবার মাধ্যমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি ও রেফারেল রোগীরা অন্য কোনো হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ও চিকিৎসা নিতে পারেন, যা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দেওয়া হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। শুরু থেকেই প্রতিটি সেন্টারে একজন করে স্টাফ নিযুক্ত করে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান কাজলা টেকনোলজিস লিমিটেড। প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন এসব স্টাফরাই সেন্টারটি পরিচালনা করে আসছিলেন। উপজেলা হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার রোগী এবং অপর প্রান্তের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মধ্যে যোগাযোগটি মধ্যস্থতা করেন। এবার নার্সদের যুক্ত করায় চিরতরে বাদ পড়তে যাচ্ছেন কাজলা টেকনোলজিসের স্টাফরা।
টেলিমেডিসিন প্রকল্পের একজন কর্মী জাগো নিউজকে বলেন, ‘বুধবার (২০ আগস্ট) একটি অনলাইন মিটিংয়ে সব স্টাফকে জানানো হয়েছে আমাদের সঙ্গে নতুন করে আর কোনো চুক্তি করা হবে না। যেসব সেন্টারের মেয়াদ শেষ হয়েছে, সেখানকার স্টাফদের আর কাজে আসতে হবে না। এসব সেন্টার এখন থেকে ফুলটাইম নার্স দিয়ে পরিচালিত হবে। যেগুলোর মেয়াদ ২০২৬ সাল পর্যন্ত সেগুলো মেয়াদ থাকা পর্যন্ত সাপোর্ট স্টাফের সঙ্গে একজন নার্স যুক্ত হয়ে চালাবেন। মেয়াদ শেষে সাপোর্ট স্টাফের দায়িত্ব নার্স গ্রহণ করবেন এবং তখন থেকে ফুল টাইম নার্সই টেলিমেডিসিন সেন্টার পরিচালনা করবেন।’
- তানভীরুল ইসলাম বলেন, ‘১৪০ সেন্টারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও সরকার অর্থ বরাদ্দ দেবে এমন আশায় অনেক স্টাফ নিয়মিত সেন্টারগুলো চালিয়ে গেছেন। আমরা তাদের আসতে নিষেধ করলেও তারা কাজ করে গেছেন। এমন পরিস্থিতিতে কাজলা টেকনোলজিসের পক্ষ থেকে জানুয়ারি মাসের অর্ধেক বেতন তাদের দেওয়ার চেষ্টা করি। এরপর থেকে এখন অবধি তারা বিনা বেতনে সেন্টারগুলো চালু রাখার চেষ্টা করে গেছেন। কিন্তু স্টাফ নার্সরা সেন্টার চালাবেন-এমন সিদ্ধান্ত আসার পর তারা অত্যন্ত আশাহত হয়েছেন।’
পুরোনো কর্মীদের ক্ষোভ
২০১১ সালে যখন খুলনার দাকোপ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের টেলিমেডিসিন সেন্টারটি চালু হয় তখন থেকেই এর দায়িত্ব পালন করছেন সাপোর্ট স্টাফ মাহবুবুর রহমান। তিনি টেলিফোনে জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রায় দেড় দশক ধরে এখানে কাজ করছি। কয়েক মাস ধরে বেতন না পেয়েও দায়িত্ব পালন করেছি। কিন্তু হঠাৎ করে এখানে নার্স নিয়োগের সিদ্ধান্ত আমাকে বেকার করে ফেলবে। এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাচ্ছি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে এ সিদ্ধান্ত বাতিল করে আমাদের নিয়মিত করার দাবি জানাচ্ছি।’
সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল টেলিমেডিসিন সেন্টারের সাপোর্ট স্টাফ আলমগীর হোসেন বলেন, ‘সরকারের এ সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য মাথায় বজ্রপাত পড়ার মতো অবস্থা। আমরা বিপদে পড়ে গেছি। ২০১১ সালে সেন্টার চালু হলেও ২০১০ সালে আমাদের নিয়োগ হয়। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর কাজলা টেকনোলজিসের মাধ্যমে এই চাকরিতে যোগ দেই।’
তিনি বলেন, ‘চাকরিরত অবস্থায় গ্র্যাজুয়েশন শেষ করি। আমরা আশা করেছিলাম গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পের স্টাফ হিসেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আমাদের বিষয়টি বিবেচনা করবে। এখন আমার সরকারি চাকরির বয়সও শেষ। এ প্রকল্প থেকে বাদ দিলে আমরা কোথায় যাবো? সরকার নানা খাতে এত ব্যয় করছে। ২৩৪ জনকে কেন রাখতে পারবে না?’
খুলনার দাকোপের টেলিমেডিসিন সেন্টারে দেড় দশক ধরে কর্মরত সাপোর্ট স্টাফ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমাদের জীবন এই টেলিমেডিসিন সেন্টারের সঙ্গেই মিশে গেছে। এখন সেন্টার থাকবে, আর আমরা থাকব না—এমন সিদ্ধান্ত সরকার কীভাবে নিতে পারে? রাষ্ট্রের প্রতি অনুরোধ, আমাদের সঙ্গে এতটা অমানবিক আচরণ করবেন না।’
কাজলা টেকনোলজিসের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, ‘টেলিমেডিসিন সেন্টারে অনেক যন্ত্রপাতি আছে। যেগুলো অপারেট করার জন্য প্রযুক্তিগত জ্ঞান থাকা জরুরি। নার্সরা এই কাজে মোটেই উপযুক্ত নন। তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেটা সময়সাপেক্ষ। আবার তারা কতটা শিখতে পারবেন সেটাও দেখতে হবে।’
এর আগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস শাখার প্রোগ্রামার ইশরাত জাহান কাকন জাগো নিউজকে বলেন, ‘২০১১ সালে আটটি কেন্দ্রে টেলিমেডিসিন সেবা শুরু হয়। এরপর প্রতি বছর ১০টির মতো কেন্দ্র যুক্ত হতে থাকে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৯৪টি কেন্দ্র চালু ছিল। করোনাকালে সেবাটি জনপ্রিয়তা পায়। ২০২২ সাল থেকে এর কার্যক্রম জোরালোভাবে শুরু হয়। ২০২৩ সালে আরও ১৪০টি নতুন কেন্দ্র যুক্ত হয়। একসময় মাসে আট-নয় হাজার রোগীকে সেবা দিতাম, কিন্তু ২০২৪ সালের জুনের পর থেকে অর্থ সংকটে প্রকল্পটি হোঁচট খেতে শুরু করে।’
সবশেষ ২০২৪ সালে টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে ৮৩ হাজার ৯৩ জন রোগী এই সেবা গ্রহণ করেন বলে জানান তিনি।
ইশরাত জাহান বলেন, ‘সাধারণত উপজেলা হাসপাতাল কোনো রোগীকে সামলাতে না পারলে প্রথমে জেলা হাসপাতাল ও পরে ঢাকায় পাঠানো হয়। কিন্তু টেলিমেডিসিনে সরাসরি উপজেলা থেকেই ঢাকার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ পাওয়া যাচ্ছে, যা এ উদ্যোগের মূল লক্ষ্য ছিল।’