
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে তিস্তা প্রকল্পের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে অবশেষে চীনের কাছ থেকেই ঋণ নিতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের কাছে ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকার ঋণ চেয়ে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। বাকি টাকা দেবে বাংলাদেশ সরকার। যদিও এই প্রকল্পের জন্য প্রথম পর্যায়ে ব্যয় হবে ৯ হাজার ১৫০ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর মতে, চলতি বছরের মধ্যেই এই ঋণচুক্তিতে সই করতে পারে দুই দেশ। ইতোমধ্যে চীনের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সংস্থা পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশন অব চায়না (পাওয়ার চায়না) প্রকল্পের সমীক্ষা সম্পন্ন করেছে। এ সংস্থা মূলত কোনো প্রকল্পের পরিকল্পনা, নির্মাণ, অর্থায়ন ও বিনিয়োগ করে থাকে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় গত ২৬ মে একটি চিঠি পাঠায় পরিকল্পনা কমিশনে। চিঠিতে তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের ঋণের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। পরে গত মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে চীনা দূতাবাসে চিঠি পাঠায় অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ শুরু হবে ২০২৬ সালে। শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০২৯ সালে।
এই মহাপরিকল্পনাটি বাস্তবায়নে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের আগ্রহে চীন সরকারই এই প্রকল্পটির সমীক্ষার কাজ সম্পন্ন করে। কিন্তু পরে প্রকল্পের অর্থায়নে চীনের সম্পৃক্ততা নিয়ে ভারতের আপত্তিতে এর পরবর্তী অগ্রগতি ঝুলে যায়। প্রকল্পটির পুরো নাম কম্প্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন অব তিস্তা রিভার প্রজেক্ট বা তিস্তা নদীর সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে চীন ও ভারত দুই দেশই বিভিন্ন সময়ে আগ্রহ দেখিয়েছে। ২০২৪ সালের মে মাসের শুরুতে বাংলাদেশ সফরে এসে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রসচিব বিনয় কোয়েত্রা বিনিয়োগের আগ্রহের কথা জানিয়েছিলেন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারও চেয়েছিল, প্রকল্পটিতে যেন ভারত অর্থায়ন করে। চীন সফর নিয়ে ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘চীন তো রেডি। কিন্তু আমি চাচ্ছি যে এটা ইন্ডিয়া করে দিক, তাতে এই প্রজেক্টটার জন্য যা দরকার, ইন্ডিয়া দিতেই থাকবে।’ কিন্তু সংবাদ সম্মেলনের ২২ দিন পর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার।
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার চাইছে, চীনের ঋণে তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়িত হোক। এ লক্ষ্যে গত মার্চে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফরের পর প্রকল্পটি এগিয়ে নিতে কাজ শুরু হয়। পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের কথায়, তিস্তা প্রকল্প চীনের ঋণে বাস্তবায়নে বর্তমান সরকারের আগ্রহ রয়েছে। চীনও প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে চায়। দুই পক্ষের সম্মতিতেই বিষয়টি অগ্রসর হচ্ছে। তবে প্রকল্পের নকশা এখনো ঠিক হয়নি। এখন মূল কাজ হবে নকশা ঠিক করা। এটি করতে পারলে প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি ও আর্থিক চুক্তির প্রক্রিয়া একসঙ্গে চলতে পারে।
ইআরডি সূত্র জানায়, বাংলাদেশ থেকে ঋণের প্রস্তাব পাওয়ার পর চীন সরকার চুক্তির একটি খসড়া তৈরি করে পাঠাবে। এ সময়ের মধ্যে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় প্রকল্প প্রস্তাব চূড়ান্ত করবে। কাজ দুটি সমান্তরালভাবে চলবে।
তিস্তা প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়ে ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন সম্প্রতি বলেন, তিস্তা প্রকল্পে চীন কাজ করতে চায়। তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক অনুরোধ তারা পাননি।
পর্যটন নগরী, পরিকল্পিত শহর, নগর ও বন্দর গড়ে তোলার পরিকল্পনা
২০১৬ সালে চীনের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সংস্থাটির সমীক্ষা শুরুর মধ্য দিয়ে তিস্তা প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয়। সমীক্ষায় বলা হয়, প্রকল্পের আওতায় নদীর ১০২ কিলোমিটার খনন করা হবে। এতে নদীর গভীরতা প্রায় ১০ মিটার বাড়বে। ফলে বন্যার পানিতে নদী-তীরবর্তী বিস্তীর্ণ জনপদ প্লাবিত হবে না। ভূমি উদ্ধার ও উন্নয়ন করা হবে ১৭১ বর্গকিলোমিটার এলাকায়। বাঁধ নির্মিত হবে ২০৩ কিলোমিটার। এ ছাড়া চর খনন, নদীর দুই পাড়ে স্যাটেলাইট শহর নির্মাণ, বালু সরিয়ে কৃষিজমি উদ্ধার করা হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্যমতে, প্রকল্পের আওতায় বাঁধ নির্মাণ ও তীর প্রতিরক্ষার কাজের মাধ্যমে নদীভাঙন রোধ হবে। বাঁধ নির্মাণ ও মেরামতকাজের মাধ্যমে বন্যার ঝুঁকি কমবে। নদী খননের মাধ্যমে নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ ও নদী পুনরুদ্ধার হবে এবং শাখা নদীগুলোর নাব্য রক্ষা করা হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নদীর দুই পাড়ে থানা, কোস্টগার্ড ও সেনাবাহিনীর ক্যাম্প থাকবে। এ ছাড়া বাঁধের দুই পাশে সমুদ্রসৈকতের মতো মেরিন ড্রাইভ, হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ ও পর্যটন নগরী, পরিকল্পিত শহর, নগর ও বন্দর গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছে পাউবো।
তিস্তা বাংলাদেশ ও ভারতের গুরুত্বপূর্ণ অভিন্ন নদী। এটি ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য এবং বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। কিন্তু ভারত তিস্তা নদীর বিভিন্ন অংশে বাঁধ নির্মাণ করে পানি প্রত্যাহার করে থাকে। ভারতের এই পানি প্রত্যাহার ও ভাঙনের কারণে বাংলাদেশ অংশে নদীটির তীরবর্তী মানুষের জীবন-জীবিকা ও বসতি হুমকিতে পড়েছে। তিস্তা পাড়ের মানুষ শুষ্ক মৌসুমে পানি না পাওয়ায় উত্তরাঞ্চলের গাইবান্ধা, নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও দিনাজপুরের কৃষি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে এই এলাকার দারিদ্র্য পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। গত জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দারিদ্র্যের যে মানচিত্র প্রকাশ করেছে, তাতে উত্তরাঞ্চলের এসব জেলার দারিদ্র্যের হার তুলনামূলক বেশি বলে উঠে আসে।