Image description

জুলাই জাতীয় সনদ কার্যকরে সংবিধান সংশোধন কঠিন হবে। অতীতের মতো সরকারি দল দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ইচ্ছামাফিক সংবিধান বদল করতে পারবে না। সনদ অনুযায়ী, সংবিধান সংশোধনে সংসদের নিম্নকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশের সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাগবে। ভোটের অনুপাত (পিআর) পদ্ধতিতে গঠিত উচ্চকক্ষে লাগবে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। দুই কক্ষে প্রয়োজনীয় সমর্থন থাকলেও সংবিধানে বিশেষ কিছু অনুচ্ছেদ সংশোধনে লাগবে গণভোট। 

প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রণীত জুলাই সনদ কার্যকর হলে প্রধানমন্ত্রীর একচ্ছত্র ক্ষমতা কিছুটা কমবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো কার্যকর হলে সরকারপ্রধান উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ, নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন এবং জরুরি অবস্থা জারির একক ক্ষমতা হারাবেন।

ইসির মতো দুদক, ন্যায়পাল, সরকারি কর্ম কমিশন এবং মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের নিয়োগে বিশেষায়িত ও সাংবিধানিক কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত রয়েছে জুলাই সনদের খসড়ায়। যদিও এতে বিএনপি নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি) দিয়েছে। 

সনদের ১৪তম সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, এক ব্যক্তি ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী পদে থাকতে পারবেন না। এতে সব দল একমত হওয়ায়, সনদ কার্যকর হলে কেউ আর ১০ বছরের বেশি সরকারপ্রধান পদে থাকতে পারবেন না। 

সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিচারপতি নিয়োগ বাদে বাকি সব কাজ সরকারপ্রধানের পরামর্শে করতে বাধ্য রাষ্ট্রপতি। ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টিতে ঐকমত্য কমিশন আরও ১২টি পদে নিয়োগে রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল। 

বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসিহ সব দল  মানবাধিকার কমিশন, তথ্য কমিশন, প্রেস কাউন্সিল এবং আইন কমিশনে নিয়োগে রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা দিতে একমত হয়েছে।  সনদ কার্যকর হলে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া নিয়োগ দিতে পারবেন রাষ্ট্রপতি।

সনদে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এবং এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে নিয়োগের ক্ষমতাও রাষ্ট্রপতিকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে বিএনপিসহ ছয়টি দল এ সিদ্ধান্তে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। তারা জানিয়েছে, ক্ষমতায় গেলে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে না। 

সংবিধান রক্ষার চেষ্টা
এখন পর্যন্ত ১৭ বার সংবিধান সংশোধন হয়েছে। অতীতে যে সরকারই দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে, সংবিধান বদল করেছে। এতে একদলীয় শাসন চালু, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের মতো ঘটনা ঘটে। যাতে তৈরি হয় রক্তক্ষয়ী রাজনৈতিক সংকট।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের একাধিক সদস্য সমকালকে বলেছেন, সংস্কার কমিশন গঠনের পর প্রথম আলোচনাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধান পাল্টে ফেলার রীতি বন্ধ করতে হবে। ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি এবং সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ সমকালকে বলেন, অতীত অভিজ্ঞতা থেকে এবারের সংস্কারে সংবিধানকে সুরক্ষা দিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছে, যাতে কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধান পাল্টে ফেলে ক্ষমতায় থেকে যেতে না পারে। 

সংবিধানের সুরক্ষায় ১০০ আসনের সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনের প্রস্তাব করে কমিশন। পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন হবে। অর্থাৎ নির্বাচনে কোনো দলের নিম্নকক্ষে প্রাপ্ত আসনসংখ্যা যা-ই হোক, উচ্চকক্ষে ভোটের অনুপাতে আসন পাবে। ১০ শতাংশ ভোট পেলে উচ্চকক্ষেও ১০টি আসন পাবে।

কমিশনের প্রথম প্রস্তাব ছিল সংবিধান সংশোধনে সংসদের উভয় কক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রয়োজন হবে। বিএনপি উচ্চকক্ষ গঠনে রাজি হলেও পিআরের ঘোর বিরোধী। বিএনপিকে রাজি করাতে কমিশন জুলাই সনদে সিদ্ধান্ত দিয়েছে, সংবিধান সংশোধনে নিম্নকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ এবং উচ্চকক্ষে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে হবে। যদিও বিএনপি এবং এনডিএম এতে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। জুলাই সনদ কার্যকর হলে উচ্চকক্ষে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে একটি দলকে ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেতে হবে। 

বিএনপি পিআরে রাজি না হলে সংবিধানের ৮, ৪৮, ৫৬, ৫৮ ও ১৪২ অনুচ্ছেদ সংশোধনে গণভোট বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্তে একমত হয়েছে। 

১৪২ অনুচ্ছেদ গণভোট-সংক্রান্ত। আওয়ামী লীগ পঞ্চদশ সংশোধনীতে এই বিধান বাদ দিয়েছিল। ৮ অনুচ্ছেদ রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি-সংক্রান্ত। ৪৮ অনুচ্ছেদ রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, ৫৬ অনুচ্ছেদ প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা-সংক্রান্ত। ৫৮ অনুচ্ছেদে ফিরবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। 

জুলাই সনদ কার্যকর হলে ভবিষ্যতে কোনো সরকার রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা হ্রাস বা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বাড়াতে চাইলে গণভোট করতে হবে। গণভোটের বিধান বাতিল করতে চাইলেও গণভোট করতে হবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, এর মাধ্যমে সংবিধানের সুরক্ষা নিশ্চিত হয়েছে। তাই অনির্বাচিত উচ্চকক্ষকে সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। 

এ বক্তব্যে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, কমিশন উচ্চকক্ষে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিধান রেখে সিদ্ধান্ত দিয়েছে একটি দলকে খুশি করতে।

জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়ায় তৃতীয় সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, সংবিধান সংশোধনে উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়োজন হবে। ঐকমত্য কমিশনের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার বলেন, মুদ্রণজনিত ত্রুটি হয়েছে। উচ্চকক্ষে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাগবে সংবিধান সংশোধনে।

প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কতটা কমবে

সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শে আপিল বিভাগ ও হাইকোর্টের অন্যান্য বিচারপতি নিয়োগ দেবেন। কিন্তু ৪৮(৩) অনুচ্ছেদের কারণে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া রাষ্ট্রপতি তা এককভাবে করতে পারেন না।

জুলাই সনদে বলা হয়েছে, উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে স্বাধীন বিচার বিভাগীয় নিয়োগ কমিশন (জেএসি) গঠিত হবে। ফলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আর বিচারক নিয়োগ থাকবে না। 

অধ্যাদেশের মাধ্যমে গত জানুয়ারিতে বিচারক নিয়োগ কাউন্সিল গঠন করা হয়েছে। ফলে ইতোমধ্যে সরকারপ্রধান উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের ক্ষমতা হারিয়েছেন। 
নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটি আইন থাকলেও ৪৮(৩) অনুচ্ছেদের কারণে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শেই নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। নির্বাচন কমিশনকে প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ সব দল একমত হয়েছে। 

সিদ্ধান্ত হয়েছে– প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, বিরোধীদলীয় ডেপুটি স্পিকার এবং প্রধান বিচারপতির প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত বাছাই কমিটির মাধ্যমে ইসি গঠন করা হবে।  জুলাই সনদ কার্যকর হলে প্রধানমন্ত্রী ইসি গঠনের একচ্ছত্র ক্ষমতা হারাবেন।

ন্যায়পাল, কর্মকমিশন এবং মহাহিসাব নিরীক্ষক নিয়োগে একইভাবে কমিটি গঠনের যে সিদ্ধান্ত জুলাই সনদে দেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়ন হলে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা আরও কমবে। যদিও এই তিন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মতো দুদকের নিয়োগেও কমিটি গঠনে আপত্তি রয়েছে বিএনপির। দলটি বলছে, এসব সিদ্ধান্ত হলে নির্বাহী বিভাগ দুর্বল হবে।

বিএনপি জানিয়ে রেখেছে, যেসব  সিদ্ধান্তে তারা নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে, ক্ষমতায় গেলে সেগুলো বাস্তবায়ন করবে না।