
গত ২০ বছরের মধ্যে গেল অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) সর্বনি¤œ বাস্তবায়ন হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মাত্র ৬৮ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়ন হয়। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) ওয়েবসাইটে ২০০৪-২৫ অর্থবছর থেকে গত ২০ বছরের এডিপি বাস্তবায়নের তথ্য দেওয়া আছে। ওই সময়ের মধ্যে সবচেয়ে কম এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে গেল অর্থবছরে। অবশ্য গতবছর অনেক কারণে প্রকল্প, এডিপি বাস্তবায়নে দেরি হয়েছে।
বাস্তবায়নের যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল তার থেকে অনেক কম প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছিল। এ বছর আরো গতিশীল হওয়ার কথা। কারণ ইতোমধ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচনের চ‚ড়ান্ত সময় ফেব্রæয়ারির মাঝামাঝি ঘোষণা হয়েছে। নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কার্যক্রমে গতিশীলতা আসবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবে ভিন্ন। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে বরাদ্দের এক শতাংশেরও কম অর্থ খরচ করেছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। যা ইতিহাসে সর্বনি¤œ। এবং বড় ধরনের ধীরগতি। আইএমইডি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একমাসে এডিপি বাস্তবায়ন ইতিহাসে সর্বনি¤œ। এমনকি ৭৪’র দুর্ভিক্ষের সময়েও এ রকম পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। এদিকে কারণ হিসেবে একাধিক বিশেষজ্ঞ উল্লেখ করেছেন, আমলাদের অসহযোগিতাকে। তাদের মতে, স্বৈরাচার হাসিনার আস্থাভাজন আমলারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বড় বড় পদে বসে আছেন। একই সঙ্গে আগের মতো প্রকল্পে চুরি নেই। চুরি বন্ধ হওয়ায় আমলারা কাজে আগ্রহ কম দেখাচ্ছেন। এছাড়া আওয়ামী ঠিকাদাররা উন্নয়ন কাজ বন্ধ রাখছেন দেশের খারাপ পরিস্থিতি তুলে ধরতে। এডিপি বাস্তবায়নে ধীরগতির বিষয়টি নিয়ে অর্থনীতিবিদরাও হতাশা প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও অর্থনীতির সামগ্রিক পরিবেশ আগের তুলনায় অনেক ভালো হলেও বাস্তবায়নের হার এত কম হওয়া উদ্বেগজনক।
অবশ্য পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, গতবছরের অজুহাত এ বছর দেয়া চলবে না। গেল জুলাই মাসে সরকারের নেয়া প্রকল্পের বাস্তবায়ন হার এক শতাংশেরও কম। তিনি বলেন, এটা ভাল লক্ষণ নয়। দ্রæত বিষয়টি ক্ষতিয়ে দেখা হবে। একই সঙ্গে এখন থেকে প্রকল্পের কাজে ধীরগতির পেছনে কোনো অজুহাত মানবে না সরকার। সব মন্ত্রণালয়কে এই বার্তা দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, গত বছর অনেক কারণে প্রকল্প, এডিপি বাস্তবায়নে দেরি হয়েছে। বাস্তবায়নের যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল তার থেকে অনেক কম প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছিল। এ বছর আরো গতিশীল হওয়ার কথা। গতবছরের অজুহাত এ বছর দেয়া চলবে না। তবে আমরা শুনছি অনেক প্রকল্পের ঠিকাদার ও প্রকল্প পরিচালক বদলি হয়ে চলে গেছেন। এখনো নতুন ঠিকাদার নিযুক্ত হয়নি। এবার এডিপি পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হবে সেটাই আমাদের লক্ষ্য। কাজেই আমরা সকল মন্ত্রণালয়কে তাগিদ দেব এখন তো আর কোনো অজুহাত দেয়া চলবে না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে একটা সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্প দেয়া হয় মার্চ-এপ্রিলে গিয়ে। তখন দেখা যায় কোনো মন্ত্রণালয় তাদের বরাদ্দ খরচ করতে পারেনি আবার কোনো মন্ত্রণালয়ের আরো চাহিদা আছে। এরপরে বাকি যে সময় থাকে তখন ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য অত্যন্ত দ্রæত গতিতে শেষের দুই মাসে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায়। তখন বর্ষাকাল বা কালবৈশাখীর সময় শুরু হয়ে যায়। আমরা এবার চিন্তা করছি যেহেতু ফেব্রæয়ারিতে নির্বাচন তাই ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে যাতে সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা দিতে পারি। এজন্য অবশ্যই পুরো বাজেটের একটা রূপরেখা লাগবে। বাজেটের রূপরেখা ছাড়া তো বলা যাবে না আমরা উন্নয়ন বাজেটের জন্য কত টাকা বরাদ্দ পাবো। পুরো বাজেটের একটি রূপরেখা দিয়ে যাওয়া উচিত। তবে নির্বাচিত সরকার আসার আগেই বলে উল্লেখ করেন ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, সরকার এখন প্রকল্পগুলো যাচাই-বাছাই করে অর্থ ছাড় করছে। এতে একদিকে সচেতনভাবে খরচ হচ্ছে, অন্যদিকে প্রশাসনিক জটিলতাও প্রভাব ফেলতে পারে।
আইএমইডির তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের এডিপিতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে দুই লাখ ৩৮ হাজার ৬৯৫ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। কিন্তু জুলাই মাসে বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র এক হাজার ৬৪৪ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। শতাংশের হিসেবে তা দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ৬৯ ভাগে। অথচ গত অর্থবছরের একই সময়ে বাস্তবায়ন হয়েছিল দুই হাজার ৯২২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা, যা বরাদ্দের এক দশমিক ০৫ শতাংশ। অর্থাৎ চলতি বছর প্রথম মাসের বাস্তবায়ন একক মাস হিসেবে গত এক দশকের মধ্যে সর্বনি¤œ পর্যায়ে নেমে এসেছে।
আইএমইডির প্রতিবেদন বলছে, জুলাই মাসে চলমান এক হাজার ১৯৮টি প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে এক হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন বাবদ খরচ হয়েছে ৭২৮ কোটি টাকা, বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান বাবদ খরচ হয়েছে ৮৩৮ কোটি টাকা এবং প্রকল্পগুলোর নিজস্ব অর্থায়ন ছিল ৭৮ কোটি টাকা।
এদিকে কেবল খরচ কম হয়নি নয়, বহু মন্ত্রণালয় ও বিভাগ পুরো মাসে এক টাকাও ব্যয় করেনি। জুলাই মাসে ১২টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ শূন্য বরাদ্দ খরচ করেছে। এগুলো হলো- পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, জননিরাপত্তা বিভাগ, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইএমইডি নিজেই, বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং সংসদ সচিবালয়।
তবে নামমাত্র অর্থ খরচ করেছে আরো ১৩টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। এদের বাস্তবায়ন হয়েছে শূন্য দশমিক শূন্য ১০ শতাংশেরও নিচে। এদের মধ্যে রয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, সুরক্ষা সেবা বিভাগ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়, তথ্য ও স¤প্রচার মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও পরিকল্পনা বিভাগ (উন্নয়ন বরাদ্দ)।
অন্যদিকে, তুলনামূলকভাবে কিছু মন্ত্রণালয় ও বিভাগ বাস্তবায়নে এগিয়ে রয়েছে। জুলাই মাসে সর্বোচ্চ বরাদ্দের অর্থ খরচ করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। তারা ২৯ কোটি ৮৭ লাখ টাকা খরচ করেছে, যা তাদের মোট বরাদ্দের ১১ দশমিক ৩০ শতাংশ। বাস্তবায়নের হারে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, যার বাস্তবায়ন সাত দশমিক ০৫ শতাংশ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় তিন দশমিক ৫৬ শতাংশ বাস্তবায়ন করে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে।
চতুর্থ অবস্থানে থাকা শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় তাদের ১৯৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকার বরাদ্দের মধ্যে ব্যয় করেছে সাত কোটি টাকা, যা শতাংশের হিসেবে তিন দশমিক ৫১ ভাগ। আর পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ। তারা তিন হাজার ৮০ কোটি টাকার বরাদ্দের মধ্যে ১০৬ কোটি টাকা খরচ করেছে, যা শতাংশের হিসেবে চার দশমিক ৪৬ ভাগ।
অর্থনৈতিক রিপোর্টারদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম বলেন, প্রকল্প কাজে চুরি বন্ধ হওয়ায় আমলাদের মধ্যে কাজের আগ্রহ কম। একই সঙ্গে প্রকল্পের আগের ঠিকাদাররা অনেকে দেশ ছেড়েছেন। অনেকে পলাতক আছেন। আবার অনেকে ভয়ে কাজ করছেন না। এছাড়া আগের কাজ সঠিকভাবে বাস্তবায়নে খরচও বাড়বে তাই কাজ বন্ধ রেখেছেন।