Image description

গণ-অভ্যুত্থানের পর পুলিশের চিড় ধরা মনোবল ঠিক করতে সরকার ও পুলিশ সদর দপ্তর বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এসব পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে আন্দোলনে নিহত পুলিশ সদস্যদের পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান এবং আহত পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসা নিশ্চিত করা। এ ছাড়া ইউনিটপ্রধানরা মাঠ পর্যায়ে পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন এবং তাঁদের অনুপ্রাণিত করতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দিয়ে যাচ্ছেন। মামলা ও গ্রেপ্তার আতঙ্কও থেমেছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বছর পেরিয়ে পরিস্থিতি এখন অনেকটাই স্বাভাবিক। তবে বাহিনীটি শক্তিশালী ও কার্যকর হওয়ার ক্ষেত্রে এখনো উল্লেখযোগ্য কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে; যদিও হতাশাজনক পরিস্থিতি থেকে পুলিশ সদস্যদের কাজে ফিরিয়ে আনা একটি বড় সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে।

অন্যদিকে গণ-অভ্যুত্থানের পর অনেক পুলিশ কর্মকর্তা পলাতক, অনেকে গ্রেপ্তার হয়ে কারাবন্দি। এ ছাড়া কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা দল আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকতে পারে এমন কর্মকর্তাদের ওএসডি করা হয়েছে।

অনেককে বাধ্যতামূলক অবসর ও চাকরিচ্যুতও করা হয়েছে। যাঁরা দোষী বা সন্দেহভাজন তাঁদের বিরুদ্ধে এক বছর ধরে ব্যবস্থা নেওয়ার পর এখন সেই ব্যবস্থার প্রয়োজন প্রায় শূন্য। ফলে বর্তমানে কর্মরত যেসব পুলিশ কর্মকর্তা রয়েছেন তাঁরা ওই সব আতঙ্ক থেকে মুক্ত হয়ে কাজে মনোযোগ দিয়েছেন। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ৮১ জন পলাতক, ৬৩ জন গ্রেপ্তার হয়ে করাগারে এবং ৮৩ জনকে ওএসডি করা হয়েছে।

কালের কণ্ঠকে একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় চেকপোস্ট বসানো, টহল দেওয়া এবং আসামি গ্রেপ্তারে অভিযান চালানোর কাজ আগের মতোই শুরু হয়েছে। গত শুক্রবার সারা দেশে পুলিশ এক হাজার ৯৯১ জনকে গ্রেপ্তার করে। এদের মধ্যে এক হাজার ১৬৬ জনই মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত আসামি। মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা অতীত ভুলে কাজে মনোযোগী হওয়ায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। পাশাপাশি র‌্যাবও দায়িত্ব পালনে সক্রিয় হয়েছে ।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গণ-অভ্যুত্থানের সময় ৪৪ পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্য নিহত হন। তাঁদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তাও দিয়েছে সরকার। তবে পারিবারিক সমস্যার কারণে তিনজনের পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া যায়নি। এঁদের মধ্যে দুই স্ত্রী সংক্রান্ত ঝামেলার কারণে তাঁদের পরিবারের আর্থিক সহায়তা ঝুলে রয়েছে। ৪৪ জনের বাইরে আর কোনো পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার তথ্য নেই পুলিশ সদর দপ্তরের কাছে। এক কর্মকর্তা জানান, এক বছর চলে যাওয়ার পরও আর কোনো পুলিশ সদস্য মারা গেছেন এমন অভিযোগ নিয়ে কেউ আসেনি। ফলে ধরে নেওয়া যায়, এর বাইরে আর কোনো পুলিশ সদস্য নিহত হননি।

সূত্র জানায়, গণ-অভ্যুত্থানের সময় নিহত পুলিশ সদস্যদের পক্ষ থেকে বিচারের দাবিতে বাহিনীতে চাপ রয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। এতসংখ্যক পুলিশ নিহত না হলে হয়তো পুলিশের মনোবল আরো দ্রুত উন্নত হতো। এত সব চাপ মোকাবেলা করে পুলিশ কর্মক্ষেত্রে সফলতার পরিচয় দিচ্ছে বলে পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

সূত্র জানায়, শেখ মুজিবুর রহমানের ৫০তম মৃত্যুবার্ষিকী ঘিরে গত ১৫ আগস্ট শঙ্কার মধ্যেই ছিলেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তারা। বিশেষ করে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় শেখ মুজিবের সমাধিস্থলে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হবেএমন ধারণা ছিল। এ ছাড়া ঝটিকা মিছিল, সমাবেশ ও ছোটখাটো হামলার আশঙ্কাও করা হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ গোপালগঞ্জসহ সারা দেশে দিনটিকে কেন্দ্র করে যেভাবে দায়িত্ব পালন করেছে তাতে বড় ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। এ বিষয়টিকেও পুলিশের মনোবল ফেরা ও বড় সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আইজিপি বাহারুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশের স্বার্থে পুলিশকে তো ঘুরে দাঁড়াতেই হবে। সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি পুলিশকে আরো গতিশীল করার।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ১৫ আগস্ট ঘিরে আগে থেকেই পুলিশ সতর্ক ছিল।

রাজধানীতে দায়িত্ব পালনকারী ইন্সপেক্টর পর্যায়ের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, নিহত পুলিশ সদস্যরা আমাদের সহকর্মী। তাঁদের মৃত্যু আমাদের কষ্ট দেয়। সবাই যে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন তা তো নয়। কেউ কেউ বাড়ি থেকে বের হয়ে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে নিহত হয়েছেন। 

জানা যায়, জুলাই আন্দোলনে দায়িত্ব পালনকারী অনেক পুলিশ সদস্যের মধ্যে এখনো মানসিক চাপ কাজ করছে, যা অপরাধীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে বাধার সৃষ্টি করছে। এই বাস্তবতায় তাঁদের ট্রমামুক্ত করার জন্যও কাজ করছেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

পুলিশ বাহিনীর শক্তি ও কার্যকারিতা নিয়ে মিশ্র চিত্র দেখা যায়। জাতিসংঘ শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশ পুলিশের নারী কন্টিনজেন্ট তাদের অসামান্য অবদানের জন্য জাতিসংঘ পদকে ভূষিত হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের জন্য সুনাম বয়ে এনেছে। এটি ইতিবাচক দিক। অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ এখনো বহাল।

পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ীই, দেশে খুন, সহিংসতা, ডাকাতি এবং নারী ও শিশু নির্যাতনের মতো গুরুতর অপরাধের ঘটনা বেড়েছে। অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের পর থেকে পুলিশ বাহিনী প্রত্যাশা অনুযায়ী অগ্রগতি করতে পারেনি এবং কিছু ক্ষেত্রে তাদের কর্মক্ষমতা উদ্বেগজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। এর অন্যতম কারণ এই বাহিনীকে দীর্ঘ সময় ধরে রাজনৈতিকীকরণ ও পেশাদারির বাইরে রাখা। 

সংস্কারের উদ্যোগ : পুলিশ বাহিনীকে আরো কার্যকর ও জনবান্ধব করতে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন করার পর এই কমিশন বেশ কিছু সুপারিশ করেছে, যা বাস্তবায়নের কাজ চলমান। সুপারিশগুলোর মধ্যে ১৮৬১ সালের পুরনো পুলিশ আইন যুগোপযোগী করার বিষয়েও আলোচনা চলছে। নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনেরও উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। পুলিশিং ব্যবস্থায় প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো এবং উন্নত দেশের আদলে পুলিশ বাহিনীকে গড়ে তোলার পরিকল্পনাও রয়েছে সরকারের। 

পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, পুলিশকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে একটি পেশাদার বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা হয়নি। বর্তমানে এর ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ পুলিশের মনোবল ফেরানো ও বাহিনীকে শক্তিশালী করার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ চলমান রয়েছে। তবে বাহিনীর অভ্যন্তরীণ সংস্কার, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তকরণ এবং জনগণের আস্থা অর্জনের মতো বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবেই রয়ে গেছে। বর্তমানে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে আয়োজন করাকে পুলিশ তাদের একটি প্রধান লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করেছে।

গত বুধবার রাজারবাগে এক অনুষ্ঠানে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী রাজধানীতে দায়িত্ব পালনকারী সাব-ইন্সপেক্টরদের উদ্দেশে বলেন, পেশাদারি, স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে। আপনারা পুলিশ বাহিনীর মেরুদণ্ড। বাংলাদেশ পুলিশের সুনাম-দুর্নাম আপনাদের কাজের ওপর নির্ভর করে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ এবং তাদের সেবা প্রদানে আপনাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি আরো বলেন, ছিনতাই বেড়ে গেলে মানুষ অনিরাপদ বোধ করে। তাই ছিনতাই প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশনা প্রদান করে তিনি বলেন, নির্বাচনে সততা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে।