Image description

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দুই পর্বের সংলাপ থেকে প্রাপ্ত সুপারিশগুলোসহ জুলাই সনদের খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোকে পাঠানো হয়েছে। খসড়ায় জাতীয় সনদকে বিশেষ মর্যাদা ও আইনি ভিত্তি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এতে সনদের পটভূমি, রাজনৈতিক ঐকমত্য হওয়া ৮৪টি বিষয় এবং সনদ বাস্তবায়নের আটটি অঙ্গীকারনামা রয়েছে। এগুলো হচ্ছে এই সনদ নিয়ে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলার সুযোগ থাকবে না।

সনদসংক্রান্ত যেকোনো প্রশ্ন মীমাংসার দায়িত্ব থাকবে সুপ্রিম কোর্টের। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর যেভাবে আন্দোলন, সরকার গঠনসহ সার্বিক বিষয়ে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল, একইভাবে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান বৈধতা পাবে। আর নির্বাচনের আগেই সনদের বাস্তবায়নকাজ শুরু হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের ভিত্তিতে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে।

এরপর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতামত গ্রহণ এবং কিছু শব্দ ও ভাষাগত সংযোজন-বিয়োজন শেষে সনদের চূড়ান্ত খসড়াটি রাজনৈতিক দলগুলোকে পাঠানো হয়েছে। গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় সনদের খসড়া পাওয়ার বিষয়টি কয়েকটি রাজনৈতিক দল নিশ্চিত করেছে। দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের প্রথম পর্বের সংলাপে ১৬৬টি প্রস্তাবের মধ্যে ঐকমত্যে পৌঁছা ৬২টি বিষয়, দ্বিতীয় পর্বে গুরুত্বপূর্ণ ১৯টি সাংবিধানিক বিষয়ে নোট অব ডিসেন্টসহ গৃহীত সিদ্ধান্ত এবং পটভূমি ও অঙ্গীকার যুক্ত করে খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। সনদের চূড়ান্ত খসড়াকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যার মধ্যে প্রথম ভাগে জুলাই সনদের পটভূমি, সংস্কার কমিশন গঠন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন এবং কমিশনের কার্যক্রমের বিষয়ে বর্ণনা করা আছে।
 
দ্বিতীয় ভাগে ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলো এবং সর্বশেষ ভাগে রয়েছে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকারনামা, যেখানে আটটি ধারায় অঙ্গীকারগুলো উল্লেখ আছে।

 

অঙ্গীকারনামায় বলা হয়েছে, ‘যেহেতু বাংলাদেশের সাংবিধানিক কনভেনশনের অংশ হিসেবে ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ হতে ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর পর্যন্ত দেশে কার্যত কোনো সংবিধান না থাকা সত্ত্বেও উক্ত সময়ের সকল কার্যাবলি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের

মহান শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ১৯৭২ সালের সংবিধানে সন্নিবেশিত করে এর আইনি ও সাংবিধানিক বৈধতা প্রদান করা হয়; একইভাবে যেহেতু ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর গণ-অভ্যুত্থানোত্তর সময়ে প্রধান বিচারপতি পদত্যাগ করে উপরাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ, অতঃপর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি পদের দায়িত্ব গ্রহণ এবং পরবর্তীতে প্রধান বিচারপতি পদে ফিরে যাওয়া সংক্রান্ত কোনো আইনি কাঠামো না থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক দল ও জোটসমূহের রূপরেখা ও অঙ্গীকারের ভিত্তিতে ওই ধরনের কার্যাবলিকে বৈধতা দিয়ে পরবর্তী সংসদ গণ-অভ্যুত্থানে প্রদত্ত জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে সাংবিধানিক কনভেনশন এবং গণতন্ত্রকে সংহত করে; সুতরাং উল্লেখিত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, জনগণের ইচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং সাংবিধানিক কনভেনশন বজায় রেখে ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে জনগণের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে আমরা নিম্নস্বাক্ষরকারীগণ এই মর্মে অঙ্গীকার করছি যে-

১. জনগণের অধিকার ফিরে পাওয়া এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে হাজারো মানুষের জীবন ও রক্তদান এবং অগণিত মানুষের সীমাহীন ক্ষয়ক্ষতি ও ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত সুযোগ এবং তেপ্রক্ষিতে জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে দীর্ঘ ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রণীত ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দলিল হিসাবে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করব।

২. এই রাষ্ট্রের মালিক জনগণ; তাদের অভিপ্রায়ই সর্বোচ্চ আইন এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের অভিপ্রায় প্রতিফলিত ও প্রতিষ্ঠিত হয় রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে, এমতাবস্থায় আমরা রাজনৈতিক দল ও জোটসমূহ সম্মিলিতভাবে দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে জনগণের অভিপ্রায়ের সুস্পষ্ট ও সর্বোচ্চ অভিব্যক্তি হিসাবে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ প্রণয়ন করেছি বিধায় এই সনদের সকল বিধান, নীতি ও সিদ্ধান্ত সংবিধানে অন্তর্ভুক্তকরণ নিশ্চিত করব এবং বিদ্যমান সংবিধান বা অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর কিছু থাকলে সেই ক্ষেত্রে এই সনদের বিধান/প্রস্তাব/সুপারিশ প্রাধান্য পাবে।

৩. এই সনদের কোনো বিধান, প্রস্তাব বা সুপারিশের ব্যাখ্যা সংক্রান্ত যেকোনো প্রশ্নের চূড়ান্ত মীমাংসার এখতিয়ার বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ওপর ন্যস্ত থাকবে।

৪. জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর প্রতিটি বিধান, প্রস্তাব ও সুপারিশ সাংবিধানিক ও আইনগতভাবে বলবৎ হিসেবে গণ্য হবে বিধায় এর বৈধতা, প্রয়োজনীয়তা, কিংবা জারির কর্তৃত্ব সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না।

৫. জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এ বাংলাদেশের সামগ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা তথা সংবিধান, বিচার ব্যবস্থা, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশি ব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থার বিষয়ে যেসব প্রস্তাব/সুপারিশ লিপিবদ্ধ রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন, লিখন ও পুনর্লিখন এবং বিদ্যমান আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন, পরিবর্তন, পরিমার্জন, লিখন, পুনর্লিখন বা নতুন আইন প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন বা বিদ্যমান বিধি ও প্রবিধির পরিবর্তন বা সংশোধন করব।

৬. আমরা ঐকমত্যে স্থির হয়েছি যে, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণের নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম এবং বিশেষত ২০২৪ সালের অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সাংবিধানিক তথা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হবে।

৭. আমরা সম্মিলিতভাবে ঘোষণা করছি যে, রাষ্ট্র ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানকালে সংঘটিত সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান ও শহীদ পরিবারসমূহকে যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান এবং আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনে ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে।

৮. আমরা এই মর্মে একমত যে, জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর যে সকল প্রস্তাব/সুপারিশ অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য বলে বিবেচিত হবে সেগুলো কোনো প্রকার কালক্ষেপণ না করেই পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সরকার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসমূহ সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করবে।

জুলাই সনদ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) (মার্ক্সবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, সনদের পটভূমিতে ইতিহাস আনা হয়েছে, কিন্তু সেখানে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস যথার্থভাবে উপস্থাপন করা হয়নি। অঙ্গীকারে ৩ নম্বর দফায় বলা হয়েছে, সনদের যেকোনো প্রশ্নের মীমাংসার এখতিয়ার সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত থাকবে। আবার ৪ নম্বর দফায় বলা হয়েছে, জুলাই সনদের বৈধতা নিয়ে আদালতে কোনো প্রশ্ন তোলা যাবে না। এটা সাংঘর্ষিক বক্তব্য। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় মূলনীতি প্রশ্নে বাসদ (মার্ক্সবাদী)সহ চারটি বাম দল কমিশনের সভা বর্জন করেছে। দুটি দল নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে। অথচ কমিশনের রিপোর্টে এটা উল্লেখ করা হয়নি।

এ বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, প্রত্যাশিত জুলাই সনদের খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোকে পাঠানো হয়েছে। এই সনদের আইনি বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত ও বাস্তবায়নের পদ্ধতি কী হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আরেক দফা বৈঠক করা হবে। রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে শিগগিরই জুলাই সনদ চূড়ান্ত করা হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

উল্লেখ্য, রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাব চূড়ান্ত করতে গত ১২ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সাত সদস্যের জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে এই কমিশন সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারের বিষয়ে ১৬৬টি প্রস্তাব নিয়ে কাজ শুরু করে। কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম ধাপের সংলাপে ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে ৪৫টি বৈঠকে ৬২টি বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছে। এরপর কমিশন দ্বিতীয় ধাপে ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোটের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ৩১ জুলাই পর্যন্ত ২৩টি বৈঠকে বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি)-সহ গুরুত্বপূর্ণ ১৯টি ইস্যুতে সিদ্ধান্তে পৌঁছে, যার ভিত্তিতে এই খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে।

জুলাই সনদের খসড়ার পটভূমিতে আওয়ামী লীগ সরকারের নৈরাজ্যকর, বিভীষিকাময় ভীতির রাজত্ব কায়েমের উধাহরণগুলোর মধ্যে ২০০৯ সালের পিলখানায় বিডিআর হত্যাকাণ্ড এবং ২০১৩ সালে মতিঝিলের শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

জুলাই ঘোষণায় এ দুটি ঘটনা উল্লেখ না করায় কয়েকটি রাজনৈতিক দল অসন্তোষ প্রকাশ করেছিল।