
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হওয়া ঠেকাতে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) একক প্রার্থীর ক্ষেত্রে ‘না’ ভোটের বিধান ফিরিয়ে আনার যে সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশন নিয়েছে, তা নিয়ে দুই ধরনের পর্যবেক্ষণ সামনে আনছেন বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, নির্বাচনি আইন সবার জন্য এক হওয়া উচিত। কোনো প্রার্থীকেই পছন্দ না হলে ভোটার যেন ‘না’ ভোট দিয়ে তা প্রকাশ করতে পারেন, সেই অধিকার সবারই থাকা দরকার। কেবল একক প্রার্থীর ক্ষেত্রে নয়, সব আসনেই ‘না ভোট’ দেওয়ার সুযোগ রাখা উচিত।
আবার একক প্রার্থীর ক্ষেত্রে ‘না’ ভোটের বিধান রাখায় ‘ডামি’ প্রার্থী অংশগ্রহণের ঝুঁকি বাড়বে বলেও মনে করছেন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য জেসমিন টুলী ও মো. আব্দুল আলীম।
আর রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান বলছেন, সব আসনে ‘না’ ভোটের সুযোগ রাখলে কী অসুবিধা হতে পারে সেটাও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান করা দরকার।
বাংলাদেশে ‘না’ ভোট
ফখরুদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সংশোধিত নির্বাচনী আইনে নবম সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো ‘না ভোট’ দেয়ার সুযোগ পান বাংলাদেশের ভোটাররা।
ওই নিয়মে প্রার্থী পছন্দ না হলে একজন ভোটার ব্যালট পেপারে 'উপরের কাহাকেও নহে' লেখা একটা ঘরে সিল দিতে পারতেন। কোনো আসনে 'না' ভোটের সংখ্যা বাক্সে পড়া মোট ভোটের অর্ধেক বা তার বেশি হলে নতুন করে ভোট আয়োজনেরও বিধান ছিল।
তখন নির্বাচন কমিশনের যুক্তি ছিল, বেশি সংখ্যক ভোটারকে কেন্দ্র আনার জন্য এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কারণ কোনো প্রার্থী পছন্দ না হলে অনেকে ভোট দিতে চান না। তাদের বিষয় বিবেচনায় রেখে এ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে।
নবম সংসদ নির্বাচনে মোট ৩ লাখ ৮১ হাজার ৯২৪ জন ‘না’ ভোট দিয়েছিলেন। ‘না’ ভোটের এই পরিমাণ ছিল বাক্সে পড়া মোট ভোটের শূন্য দশমিক ৫৫ শতাংশ।
সবচেয়ে বেশি ৩২ হাজার ৬৪টি 'না' ভোট পড়েছিল পার্বত্য রাঙামাটি আসনে। তবে কোনো আসনেই পুনর্নির্বাচন হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক 'না' ভোট পড়েনি।
সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ পরে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন করে ‘না’ ভোটের বিধান বাদ দেয়।
তবে এর পরেও ‘না’ ভোটের বিধান নিয়ে আলোচনা হয়েছে বেশ কয়েকবার। ওই বিধান ফিরিয়ে আনতে আদালতে রিট মামলা হয়েছে। বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সংগঠন ‘সুজন’ সংবাদ সম্মেলন করে ‘না’ ভোট ফিরিয়ে আনার সুপারিশ করেছে।
এমনকি ২০১৫ সালে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের জন্য মাঠ কর্মকর্তাদের মতামত চাওয়া হলে তখনো ‘না’ ভোট চালু করার প্রস্তাব উঠে এসেছিল।
তবে আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে বিষয়টি আর হালে পানি পায়নি ।
এবার কী নিয়ম?
গত সোমবার নির্বাচন ভবনে কমিশন সভায় গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের প্রস্তাব চূড়ান্ত করে নির্বাচন কমিশন।
সেখানে সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা কোনো প্রার্থীর বিজয়ী হওয়া ঠেকাতে ‘না’ ভোটের বিধান ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়।
অর্থাৎ, কোনো আসনে একের বেশি প্রার্থী না থাকলে সেখানে ব্যালট পেপারে ‘না’ ভোট দেওয়ার সুযোগ থাকবে। ‘না’ ভোটের সংখ্যা ওই প্রার্থীর ভোটের চেয়ে বেশি হলে সেখানে নতুন করে নির্বাচন হবে।
তবে ২০০৮ সালের নির্বাচনের মত সব আসনে ‘না’ ভোটের বিধান এবার থাকছে না।
বিগত সরকারের সময় ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও সমমনাদের বর্জনের মধ্যে দেড়শর বেশি আসনে আওয়ামী লীগের একক প্রার্থীরা বিনাভাটে এমপি হয়ে যান, যা ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়।
সেরকম পরিস্থিতি যাতে আর না ঘটে, সেজন্যই এবার একক প্রার্থীর আসনে ‘না’ ভোটের ব্যবস্থা রাখতে চায় ইসি।
একই সঙ্গে অনিয়ম হলে প্রয়োজনে পুরো আসনের নির্বাচন বাতিল, সম ভোট পেলে লটারি প্রথা বাদ দিয়ে পুনঃনির্বাচন, আইন শৃঙ্খলার সংজ্ঞায় সশস্ত্রবাহিনী অন্তর্ভুক্ত করা, হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিলে ভোটের পরও প্রার্থিতা বাতিলের বিধান করাসহ একগুচ্ছ সংশোধনের বিষয়ে সেদিন সিদ্ধান্ত নেয় এএমএম নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ সেদিন বলেন, “আমরা আশা করছি এ সপ্তাহের মধ্যে আমরা এটার খসড়া চূড়ান্ত করে ফেলব; আগামী সপ্তাহে আইন মন্ত্রণালয়ে এটা পাঠিয়ে দিতে পারি।”
আইন মন্ত্রণালয়ের সম্মতি পেলে ওই প্রস্তাব উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। সরকারের সায় পেলে আরপিও সংশোধন অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হবে।
‘না’ ভোটের অধিকার ‘সবার হোক’
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ও নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "এবার ‘না’ ভোটের বিষয়ে যেটা করা হচ্ছে, একক প্রার্থীর ক্ষেত্রে ‘না’ ভোটের বিধান করা হচ্ছে। কিন্তু অন্য নির্বাচনি আসনে একাধিক প্রার্থী থাকলে সে ক্ষেত্রে না ভোট থাকবে না। নির্বাচনি আইনটা সবার জন্য এক হওয়া উচিত। আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রয়োগ হওয়া উচিত।
সব আসনের ক্ষেত্রে 'না' ভোটের বিধান রাখার সুপারিশ নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের ছিল, সে কথা জানিয়ে কমিশনের এ সদস্য বলেন, "সেটি হলে ভালো হত। ধরেন কোথাও চারজন প্রার্থী, কিন্তু কোন ভোটারের কাউকেই পছন্দ না। সে ক্ষেত্রে 'না' ভোট না থাকলে তার ভোটটা নষ্ট হয়ে যায়। এজন্য না ভোটের বিধান করার প্রস্তাব করা হয়েছিল।"
একই ঝুঁকি দেখছেন সাবেক সচিব আব্দুল আওয়াল মজুমদারও। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "একক প্রার্থীর ক্ষেত্রে 'না' ভোটের বিধান করাটা ঠিক হয়নি। আইন সব আসনের জন্য সমান হওয়া দরকার।
"সব আসনের জন্য না ভোটের বিধান থাকাটা সমীচীন ছিল। ভোটারের কোনো প্রার্থীকেই পছন্দ না হলে যেন সে ভোট দিয়ে তা প্রকাশ করতে পারে।"
সব আসনের ক্ষেত্রে না ভোটের বিধান না রাখায় ভোটারের অধিকার ক্ষুণ্ণ হবে বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য মো. আব্দুল আলীম।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,"এবারের 'না' ভোটের বিধানটা যে তা আমার কাছে একটু অসামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হয়েছে। কারণটা হচ্ছে, এই অধিকারটা সবারই থাকা দরকার। এক জায়গায় প্রার্থী একজন থাকলে না ভোট থাকবে, আরেক জায়গায় চারজন থাকলে না ভোট থাকবে না–এটা আমার কাছে মনে হয় অসামঞ্জস্যপূর্ণ।”
নিজের বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দিয়ে তিনি বলেন, "ধরুন একটি আসনে চারজন প্রার্থী আছে, আর আমি সেই আসনের ভোটার। আমার চারজনের একজনকেও পছন্দ নয়, তখন আমি না ভোটার অপশনটা খুঁজব। কিন্তু সেটাতো আমি পাচ্ছি না। আমার অধিকারটা কিন্তু খর্ব হল।"
‘ডামি’ প্রার্থীর ফাঁদ
বিএনপি ও সমমনা দলগুলো ২০২৪ সালে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জন করলে ২০১৪ সালের মত অনেক আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। ওই পরিস্থিতিতে নতুন কৌশল নেয় আওয়ামী লীগ।
আগের নির্বাচনগুলোতে দলের মনোনয়নের বিরুদ্ধে প্রার্থী হওয়ার যে বাধা ছিল, তা তুলে নেওয়া হয়। ফলে অধিকাংশ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর বিপরীতে স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেন আওয়ামী লীগের নেতারাই।
কোথাও আবার আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী তার আত্মীয় পরিজনকে স্বতন্ত্র হিসেবে ভোটে দাঁড় করিয়ে দেন। সেই ‘স্বতন্ত্র’রা পরিচিতি পান ‘ডামি’ প্রার্থী হিসেবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিনাভোটে এমপি হওয়া ঠেকাতে গিয়ে ‘না’ ভোটের যে নিয়ম ইসি করছে, ‘ডামি’ প্রার্থী বসিয়ে সেই কৌশল ঠেকিয়ে দিতে পারেন সেই একক প্রার্থী।
জেসমিন টুলী বলেন, "ধরুন কোনো প্রার্থী যদি দেখেন তার আসনে তিনি একাই প্রার্থী, তাহলে তিনি বুঝতে পারবেন তাকে না ভোটের সঙ্গে কমপিট করতে হবে। এজন্য তিনি একজন ডামি প্রার্থীকে দাঁড় করিয়ে দিতে পারেন। এর মাধ্যমে নির্বাচন প্রভাবিত হবে।"
একই ঝুঁকি দেখছেন সাবেক সচিব আব্দুল আওয়াল মজুমদার। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, " একক প্রার্থীর ক্ষেত্রে 'না' ভোটের বিধান ডামি প্রার্থীর অংশগ্রহণের শঙ্কা বাড়াবে।”
শুধু একক প্রার্থীর ক্ষেত্রে 'না' ভোটের বিধান অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি পুনর্বিবেচনার পরামর্শ দিয়ে আব্দুল আলীম বলেন, "আমার কাছে মনে হয় এটা নির্বাচন কমিশনের আবার ভাবা উচিত। যদি কারও কোনো প্রার্থী পছন্দ না হয় তাকে না ভোটের অপশনটা দিতে হবে। একক প্রার্থীর ক্ষেত্রে না ভোটের বিধান ডামি প্রার্থীর অংশগ্রহণের ঝুঁকি সৃষ্টি করবে।"
সব আসনে 'না' ভোটের সুযোগ রাখার প্রস্তাব করলেও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে সে সিদ্ধান্ত নিতে নির্বাচন কমিশনকে তাগিদ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "কোথাও যদি একজন প্রার্থী থাকেন, তিনি ‘না’ ভোট অ্যাভয়েড করার জন্য ডামি প্রার্থী বসাবেন। দুই লাখ, পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে প্রার্থী কিনে আনবেন, যাতে তিনি সহজে নির্বাচনটা জিতে আসতে পারেন। এটা খুবই ভয়ঙ্কর।
“'না' ভোট যদি চালু করতে হয়, তাহলে সব আসনের ক্ষেত্রেই করতে হবে। সব আসনে ‘না’ ভোট হলেও কী অসুবিধা হতে পারে সেটাও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে চালু করা উচিত।”
নির্বাচন কমিশন যেভাবে বিষয়টি চূড়ান্ত করেছে, তার সমালোচনা করে মাহবুবুর রহমান বলেন, "এ নির্বাচন কমিশন যেভাবে পলিসি তৈরি করছে, আমার মনে হচ্ছে না তারা এক্সপার্টদের সঙ্গে কথা বলছে, অথবা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলছে। আমাদের যে লিমিটেশনগুলো ছিল, সেই লিমিটেশনগুলো উতরাতে যে কাজগুলো করা দরকার, এইতো কয়টা মাস গেল, তারাতো ইচ্ছা করলে রাজনৈতিক দলগুলো ও অংশীজনদের সঙ্গে পর্যায়ক্রমে আলোচনা করতে পারত। কিন্তু তারা সেটা করেনি।"
সশস্ত্র বাহিনীর অন্তর্ভুক্তি আস্থা ফেরাবে
আরপিও সংশোধনের ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে যুক্ত করার প্রস্তাবের প্রশংসা করেছেন নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সদস্য মো. আব্দুল আলীম। তার ভাষ্য, ভোটের মাঠে সশস্ত্র বাহিনীর উপস্থিতি আস্থার পরিবেশ ফিরিয়ে আনবে।
তিনি বলেন, "সশস্ত্র বাহিনীকে অন্তর্ভুক্তিটা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ছিল। এর কারণ হচ্ছে যে বাংলাদেশে এই ধরনের যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে এবং তাদের নিয়ে যে জরিপগুলো আছে সেগুলো দেখলে দেখা যাবে সেনাবাহিনীর প্রতি জনগণের আস্থা সবচেয়ে বেশি। সেনাবাহিনী সবসময় একটা পজেটিভ রোল প্লে করেছে। ভোটের মাঠে তাদের উপস্থিতি এক ধরনের আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করবে।"
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের আরেক সদস্য ও নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী বলেন, ২০০১ সাল থেকে আরপিওতে শৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনী যুক্ত ছিল। ২০০৯ তা বাতিল করা হয়েছিল।
"সেনাবাহিনীর উপর মানুষের একটা আস্থা আছে। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক দল ও ভোটাররা নিরাপদ বোধ করবে। ভোটের দিন এবং আগে পিছে রাস্তাঘাটে যদি সেনাবাহিনী থাকে, তাহলে অনেক ইলেকশনে যে ধরনের বিরোধ বা মারপিট দেখা দেয় সেগুলো কিছুটা হলেও কমে যাবে, ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবেন।"
ভোটের মাঠে সশস্ত্র বাহিনীর উপস্থিতি ‘সহিংসতা কমাবে’ বলে মনে করছেন সাবেক সচিব আব্দুল আওয়াল মজুমদার।
তিনি বলেন, "আমি ৯১, ৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে মাঠে দায়িত্ব পালন করেছি। যারা বিশৃঙ্খলা করতে চান, সেনাবাহিনী মাঠে থাকলে তারাও একটু ভয় থাকেন।"
তবে ভোটের মাঠে সশস্ত্র বাহিনীর উপস্থিতি কীভাবে থাকবে তা স্পষ্ট করার তাগিদ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান। তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে এ প্রস্তাব চূড়ান্ত করার ওপর জোর দিচ্ছেন।
তিনি বলেন, "সেনাবাহিনীকে নির্বাচনে মাঠে রাখার দাবি রাজনৈতিক দলগুলোরও ছিল। কিন্ত পরিস্থিতি পরিবর্তনের কারণে রাজনৈতিক দলগুলো এটা এখন চায় কিনা সেটা তাদের সঙ্গে আলোচনা করা দরকার।
"বাংলাদেশে পুলিশ বাহিনী নিরপেক্ষ থাকে না। এই পরিপ্রেক্ষিতে সশস্ত্র বাহিনীর সহযোগিতা এবারও যদি নির্বাচন কমিশন চায়, সেক্ষেত্রে কি ফরম্যাটে চায়? কতটুকু চায়? কেন্দ্রের ভেতর চায়? নাকি কেন্দ্রগুলো বাইরে থেকে পর্যবেক্ষণের জন্য চায়? এ বিষয়গুলো স্পষ্ট করেনি কমিশন।"
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে আরপিও সংশোধনের প্রস্তাব চূড়ান্ত করায় নির্বাচন কমিশনের সমালোচনা করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এ অধ্যাপক বলেন, "এমনিতেই আমার কাছে মনে হয় এই নির্বাচন কমিশন দুর্বল৷ আরপিও সংশোধনের ঘোষণা দেখে আমার মনে হয়েছে তারা আসলেই দুর্বল।"
সমভোটে পুনঃনির্বাচন সরকারের ‘খরচ বাড়াবে’
দুইজন প্রার্থী নির্বাচনে সমপরিমাণ ভোট পেলে লটারি না করে পুনঃনির্বাচনের আয়োজনের যে প্রস্তাব আরপিও সংশোধনে ইসি করছে তা সরকারের খরচ বাড়াবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সাবেক সচিব আব্দুল আওয়াল মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, "পুনঃনির্বাচনের ক্ষেত্রে খরচটা বাড়বে। তবে এর ফলে প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়াবে।
“অনিয়ম হলে প্রয়োজনে পুরো আসনের নির্বাচন বাতিল ও হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিলে এমপি পদ বাতিল–এ ধরনের বিধান থাকা ভালো। এতে করে নির্বাচনে প্রার্থীরা সচেতন থাকবে। নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে।"
একই ধরনের কথা বললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান।
তিনি বলেন, "দুইজন প্রার্থী যখন সমান ভোট পান, তাহলে পরের নির্বাচনে এই দুই জনের বাইরে কেউ দাঁড়াতেই পারবেন না। পুনঃনির্বাচনের ভোটের একটা হার নির্ধারণ করা যেতে পারত যে ৫০ শতাংশ ভোট পেলে পুনঃনির্বাচন। কিন্তু এখন যে বিধান করা হল, এতে কি ৫ বা ১০ শতাংশ ভোটের জন্য একমাস পরে পুনরায় তফসিল ঘোষণা করবে?"
বলপ্রয়োগে নির্বাচন বাতিলের বিধান প্রশংসিত
শুধু ভোট নয়, পুরো নির্বাচনের যে কোনো পর্যায়ে বলপ্রয়োগ বা হস্তক্ষেপে নির্বাচন কমিশন ওই এলাকার নির্বাচন বাতিল করতে পারবে বলে যে বিধান আরপিওতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করা হচ্ছে তারও প্রশংসা করেছেন বিশ্লেষকরা।
নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী বলেন, "আগের কমিশন নির্বাচনের জায়গায় ভোট কথাটা নিয়ে এসেছিল, যে ভোটে বল প্রয়োগ বা হস্তক্ষেপ। আসলে বল প্রয়োগ মনোনয়নপত্র দাখিলের ক্ষেত্রেও হতে পারে, প্রচারের ক্ষেত্রেও হতে পারে। কমিশন ২০২৪ সালের আগের জায়গায় চলে গেছে।"
তিনি বলেন, "পুরো এলাকার নির্বাচন বাতিল করার ক্ষমতা কমিশন অন্তর্ভুক্ত করছে। আচরণ বিধিমালায় সোশাল মিডিয়াকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সবগুলো ভালো, কিন্তু এগুলোর বাস্তব প্রয়োগ লাগবে আসলে।"
আব্দুল আলীমের ভাষ্য, “নির্বাচনি অনিয়মগুলোতে শুরু থেকে হয়। একজন প্রার্থীকে অপর একজন প্রার্থী নমিনেশন সাবমিটই করতে দিচ্ছে না–এটাতো বড় ধরনের অনিয়ম। কাজেই এটা পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই কভার করতে হবে। এটা শুধুই ভোটের দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না।"
হলফনামায় ভুল তথ্যে এমপি পদ বাতিল সংসদ সদস্যদের 'জিম্মি করবে'
হলফনামায় ভুল তথ্যে পরবর্তীতে এমপি পদ বাতিলের যে প্রস্তাব আরপিও সংশোধনে করা হয়েছে, তার ফলে সংসদ সদস্যরা নির্বাচন কমিশনের কাছে জিম্মি হয়ে যাবেন বলে মনে করছেন অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান।
তিনি বলেন, "এটা খুবই খারাপ। নির্বাচন তো একটা পরীক্ষা। এটাতে পাস করতে হবে। যখন প্রার্থী বাছাই করবেন তখন ঠিক করবেন প্রার্থী পাস করতে পারবেন কি না। প্রার্থী দিলেন সে পাসও করল, পরবর্তীতে বলা হল ভাই আপনার তো হলফনামায় ভুল ছিল।
“এটা নির্বাচন কমিশনের সীমাবদ্ধতা, কারণ কমিশন প্রার্থী ঠিকভাবে যাচাই বাছাই করতে পারে নাই। কমিশনের যদি যাচাই বাছাইয়ে লোকবল লাগে সেটি চাক। কিন্তু না করে পুরো সংসদের পুরো সময়জুড়ে এমপিদের মনে একটা জুজুর ভয় ধরিয়ে রাখবে। ফলে সংসদ সদস্যরা নির্বাচন কমিশনের হাতে জিম্মি হয়ে যাবে।”
তিনি বলেন, "হলফনামা নির্বাচন কমিশন যাচাইয়ের পর যদি সঠিক ঘোষণা করে, তাহলে তা সঠিক হিসাবে গণ্য হওয়া উচিত। কারণ এক লোক তো দুইবার যাচাই করতে পারে না।"