
১০০ কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিক্রয় ও বিপণন বিভাগের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ইতিমধ্যেই সংস্থাটি একটি অনুসন্ধান দল গঠন করেছে। দুদক সূত্র মানবজমিনকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। সূত্র জানায়, ভুয়া টিকিট বুকিং এবং বুকিং বাতিলের মাধ্যমে চারটি গ্লোবাল ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম-জিডিএস কোম্পানি-অ্যামাডিউস, অ্যাবাকাস, গ্যালিলিও ও সাবরি-বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স থেকে এক বছরে শতকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এমন একটি অভিযোগ বেশ কিছুদিন আগেই জমা পড়ে দুদকে। সেই অভিযোগ আমলে নিয়ে সংস্থাটি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় গত জুলাই মাসে। দুদক সূত্র জানায়, সংস্থাটির উপ-পরিচালক সৈয়দ আতাউল কবিরের নেতৃত্বে একটি দল অনুসন্ধানের জন্য গঠন করেছে কমিশন। দলটি ইতিমধ্যেই বিমানে রেকর্ডপত্র চেয়ে চিঠি দিয়েছে।
সূত্র বলছে, বিমানের একটি উচ্চপর্যায়ের সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগসাজশ এবং অসম চুক্তির ফায়দা নিয়ে এক বছরে ৯৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় অ্যামাডিউস, অ্যাবাকাস, গ্যালিলিও ও সাবরি নামের ৪টি জিডিএস কোম্পানি। ভয়াবহ এ লুটপাটের অন্যতম সহযোগী বিমানেরই তালিকাভুক্ত তিন শতাধিক ট্রাভেল এজেন্ট। বিনিময়ে তারাও মোটা অঙ্কের ভাগ পেয়েছে। ২০১৯ সালের বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের এক তদন্ত প্রতিবেদনেও এ লুটপাটের চিত্র উঠে আসে।
জিডিএস কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে বিমানের কোটি কোটি টাকা অপচয়ের কারণ উদ্ঘাটন, এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি-এজেন্সি চিহ্নিতকরণ এবং আর্থিক ক্ষতি সাধনের লক্ষ্যে সে সময় ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত শুধু ১০ মাসে টিকিট বুকিং বাতিলের জন্য ৪টি জিডিএসকে ৯৩ কোটি ৯৩ লাখ ৯ হাজার ৮৮৮ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। যার বেশির ভাগ বুকিং ছিল ভুয়া ও উদ্দেশ্যমূলক। এই সময়ে ৫টি দেশের ২২ জন এজেন্ট ৮০ শতাংশ বুকিং বাতিল করেছে এবং ৭টি দেশের ৩১ জন এজেন্ট ৭৫ শতাংশ টিকিট বুকিং বাতিল করেছে। অথচ চুক্তিতে যদি বুকিং বাতিলের জন্য বিল দেয়ার কথা উল্লেখ না থাকতো, তাহলে এরকম ভুয়া বুকিং হতো না আর বিলও দেয়া লাগতো না। বিমানের প্ল্যানিং ও মার্কেটিং বিভাগ কৌশলে ৪ জিডিএস কোম্পানির সঙ্গে এ চুক্তি করেছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বিমানের রেভিনিউ ইন্টিগ্রিটি শাখার মাধ্যমে টিকিট বুকিং, ব্লক, ডুপ্লিকেট বুকিং মনিটরিং করার কথা। কিন্তু বাস্তবে কখনোই এ কার্যক্রম সমন্বিতভাবে করা হয়নি। দুদকের অভিযোগ সূত্রে আরও জানা যায়, টিকিট বুকিং দেয়ার জন্য জিডিএস কোম্পানির সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে, তা বিমানের স্বার্থবিরোধী। ৩০০ আসনের একটি ফ্লাইটের ২ থেকে ৩ হাজার টিকিট বুকিং রহস্যজনক। বেশির ভাগ বুকিং ভুয়া। যে কারণে এসব বুকিং বাতিলও হয়ে যায়। প্রতিটি বুকিং ও বাতিলের জন্য জিডিএস কোম্পানিকে বিল গুনতে হয় বিমানকে। অভিযোগ আছে, শুধু জিডিএসের বিল বাড়াতে কিছু ট্রাভেল এজেন্সি প্রচুর টিকিট বুকিং দেয় আবার তা বাতিলও করে। যার বিনিময়ে ওইসব এজেন্সি জিডিএস কোম্পানির কাছ থেকে কমিশন পায়।
দুদকের অভিযোগের বরাতে আরও জানা যায়, ২০০৯ সাল থেকে বিভিন্ন সংস্থার একাধিক তদন্ত রিপোর্টে জিডিএস কোম্পানির ভয়াবহ লুটপাটের চিত্র উঠে এলেও এ নিয়ে কারও মাথাব্যথা ছিল না। বিমানের তৎকালীন অপসারিত সাবেক এমডি মোসাদ্দিক আহম্মেদের আমলে সবচেয়ে বেশি লুটপাট হয়েছে এ খাতে। ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এক তদন্ত রিপোর্টে এই ৪ জিডিএস কোম্পানি ও ৩০০ ট্রাভেল এজেন্টের ভুয়া টিকিট বুকিং ও বুকিং বাতিলের মাধ্যমে ১৩৪ কোটি টাকা লোপাটের তথ্য পেয়েছিল মন্ত্রণালয়। অথচ এ সময়ে ট্রাভেল এজেন্টগুলোকে কমিশন বাবদ দিয়েছিল আরও ৩৯ কোটি টাকা। ওই তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ দুই বছরে বুকিং করা যত টিকিট বিক্রি হয়েছে, তার ৮ গুণ বেশি ছিল ভুয়া বুকিং। এসব টিকিট পরবর্তী সময়ে বাতিল করা হলেও সেজন্য বিমানকে বিল পরিশোধ করতে হয়েছে। সেই তদন্ত রিপোর্টে অবিলম্বে ৪ জিডিএস কোম্পানির সঙ্গে করা চুক্তি বাতিল করে বিমানের নিজস্ব সফটওয়্যার ব্যবহারের সুপারিশ এলেও সিন্ডিকেট তা করেনি।
তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে আরও জানা যায়, এজেন্টরা অনৈতিকভাবে ভুয়া নামে টিকিট বুকিং করে রাখে এবং তা বারবার বাতিল করে। বিমান নিয়োজিত এয়ারলজিকার অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী, বিমানের সাধারণ টিকিট বাতিল হয় ৬০ শতাংশের নিচে। আর অনৈতিকভাবে বাতিল করা টিকিট বুকিংয়ের হার ৮০-৯০ শতাংশ। বিমানের সঙ্গে জিডিএসের অসম চুক্তির কারণে প্রতিটি বাতিল বুকিং বাবদ জিডিএসকে বিমান দশমিক তিন পাঁচ থেকে দশমিক চার শূন্য (০.৩৫-০.৪০) ডলার পরিশোধ করছে। এ অসম চুক্তির সুযোগ নিয়ে কিছু এজেন্টের সহযোগিতায় জিডিএসগুলো বিমান থেকে কোটি কোটি টাকা বিল নিয়ে যাচ্ছে। এসব জিডিএসের সঙ্গে বিমানের চুক্তির ক্ষেত্রে যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি। চুক্তিতে সই করেছেন তৎকালীন মার্কেটিং ও সেলসের পরিচালকরা। এক্ষেত্রে বিমানের পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন নেয়া হয়নি, যা অযৌক্তিক বলে মনে করে তদন্ত কমিটি।