Image description
চোখে অনেকটা ঝাপসা দেখতেন ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ডিপিডিসি) কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন। সমাধান পেতে শরণাপন্ন হোন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস (নিন্স) হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ও ইসলামী ব্যাংকে হাসপাতালে কনসালন্ট ডা. কে এম আতিকুল ইসলামের কাছে। চিকিৎসকের দেওয়া পরীক্ষায় মাথায় ছোট্ট একটি টিউমার ধরা পড়ে। যা অতি সাধারণ অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অপসারণ করা সম্ভব বলে জানান চিকিৎসক। কথা ছিল তিন দিনের মধ্যে ঘরে ফিরবেন। হ্যা, হেলাল উদ্দিন বাড়িতে ফিরেছেন, তবে লাশ হয়ে।
 

 

 

অভিযোগ উঠেছে, চিকিৎসকের অর্থলোভের বলি প্রায় ৪২ বছর বয়সী ডিপিডিসি কর্মকর্তা। এ ঘটনায় প্রতিকার পেতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে (বিএমডিসি) অভিযোগ দিয়েছে ভুক্তভোগী পরিবার। ডা. আতিকুলের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি জানিয়েছেন স্বজনেরা।

 

হেলাল উদ্দিনের চিকিৎসায় অবহেলা নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার (১৪ আগস্ট) জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে ভুক্তভোগী হেলালের পরিবার ও স্বজনেরা।

 

এ সময় হেলালের ছোট বোন উম্মে ছাবেরীন স্মৃতি বলেন, ‘আমার ভাই বাম চোখে ঝাপসা দেখতেন। এজন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। পরে ডা. আতিকের কাছে গেলে ভুল চিকিৎসার শিকার হন এবং দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। আমরা ওই চিকিৎসকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং চিকিৎসাখাতের পরিবর্তন চাই।’

 

তিনি বলেন, ‘আমার ভাইয়ের দুটি সন্তান এখন এতিম হয়ে গেছে। এভাবে আর কত প্রাণ নিভে যাবে, কে দায় নেবে? আমরা ডা. আতিকের বিচার ও লাইসেন্স বাতিল চাই।’

 

হেলালের মামা মোহাম্মদ আসাদ আলী ভূঁইয়া বলেন, ‘ডা. আতিকের অপারেশনের (অস্ত্রোপচার) আগের এবং পরের কথার সাথে মিল ছিলনা। তিনি মিথ্যা এবং ছল-চাতুরির আশ্রয় নিয়েছেন। অপারেশনটি ছোট বলেছিলেন, এমনকি রোগী তিন দিনের মধ্যে হেঁটে বাসায় যেতে পারবেন বলে গ্যারান্টি দিয়েছিলেন। কিন্তু অপারেশন করার পর তিনি বলেন, অপারেশনটি বড়, আপনারা দোয়া করেন।’

 

তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘আমরা সিটিস্ক্যানের রিপোর্ট চেয়েছি, তাও দেয়নি ডা. আতিক। এই চিকিৎসক রিপোর্ট গায়েব করে দিয়েছে। অপারেশনের সময় কোন কোন চিকিৎসক ছিল, তাও জানাননি।

 

হেলালের ছোট বোন উম্মে ছাবেরীন স্মৃতি লিখিত বক্তব্যে জানান, হেলালের এমআরআই রিপোর্টে উল্লেখ আছে তার ব্রেনে ছোট সাইজের (৩.৬৬০২.৬৪০২.১৮ সে.মি.) টিউমার আছে। গত ১২ জুলাই রাতে একমাত্র ছোট বোন, স্ত্রী, শ্বশুর ও চাচা শ্বশুরকে নিয়ে ডা. আতিকের সঙ্গে কাকরাইলের ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে দেখা করেন। ডা. আতিক হেলালের এমআরআই রিপোর্ট দেখে বলেন, এটি দ্রুত অপারেশন করতে হবে। নাকের ভিতরে একটি পাইপ দিয়ে এন্ডোস্কপিক সার্জারির মাধ্যমে টিউমারটি তিনি অপারেশন করবেন। এটি একটি মাইনর অপারেশন, এতে কোনো কাঁটা ছেঁড়া ও ঝুঁকি নেই, তিনি শত শত এ ধরনের অপারেশন করেছেন বলে জানান।

 

ছাবেরীন স্মৃতি বলেন, ‘চার দিন পর হেলাল হেঁটে অফিস করতে পারবেন এবং সুস্থ হওয়ার শতভাগ গ্যারেন্টি দেন। এই সার্জন হেলালের এ ধরনের আপারেশনে কোন ধরনের ঝুঁকি থাকতে পারে এমন কথা একবারও বলেননি। হেলাল নিউরোসাইন্স হাসপাতালে অপারেশন করতে চাইলে এই চতুর চিকিৎসক বলেন, ওখানে তো আপনারা তিন মাসেও সিরিয়াল পাবেন না। তাছাড়া সেখানে জুনিয়ররা আপারেশন করবে এবং মেশিনপত্রও ভালো না। নিউরোসাইন্সের খরচও এখানকার প্রায় কাছাকাছি। হেলাল তার ছোট শ্যালিকার বিয়ে গত ২৫ জুলাই থাকায় অপারেশনটি উক্ত তারিখের পরে যেকোনো সময়ে করতে চাইলে প্রতারক এই চিকিৎসক হেলালকে তার বাম চোখ অন্ধ হওয়ার ভয়ভীতি দেখিয়ে সময়ক্ষেপণ না করার পরামর্শ দেন। চিকিৎসকের মনে ভয় ছিল রোগীকে সময় দিলে এ রোগী তার হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। এতে তিনি কাঙ্ক্ষিত অর্থ উপার্জন থেকে বঞ্চিত হবেন। এক পর্যায়ে হেলালের চিকিৎসা দেশের বাইরে করাতে চাই বললে, তখন এই চিকিৎসক মিথ্যা কথার ফুলঝুড়ি ও ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে বলেন, দেশের বাইরে কেন যাবেন? অনেকেই বিদেশ থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসে আমার কাছে অপারেশন করেছে। ওদের চেয়ে আমি ভাল কাজ করি এবং এ ধরনের একের পর এক মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে হেলালকে পরের দিন ভর্তি হয়ে যেতে

 

হেলালের বোন বলেন, আলোচনা করে চিকিৎসক অপারেশন বাবদ আড়াই লাখ টাকা ঠিক হয়। গত ১৪ জুলাই হাসপাতালে ভর্তি হোন হেলাল। পরদিন তার রক্ত চাপ বেশি ছিল কিন্তু অন্য সকল পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলাফল স্বাভাবিক ছিল। অর্থাৎ মাথায় ছোট টিউমারটি ছাড়া হেলালের কোথাও কোনো সমস্য নেই। বেশি বক্ত চাপ থাকা সত্ত্বেও এই লোভী সার্জন টাকার লোভে ঐদিনই তার অপারেশন করেন। 'অপারেশন শেষ করে বিষণ্ন মুখে এই সার্জন বের হয়ে বলেন, একটি মেজর অপারেশন হয়েছে, আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। একটা টিউমার সম্পূর্ণ এনেছি। আর অন্যটি যেটুকু আমার ক্যামেরায় দেখা গেছে সেটুকু এনেছি। কিছু অংশ রয়ে গেছে। আগামী দু-দিন হেলারের জন্য বিপজ্জনক, সবাই আল্লাহকে ডাকেন। সার্জনের অপারেশনের পর এ ধরনের ভাষ্যেই প্রতীয়মান হয় তিনি অপারেশনের সময় এমন কিছু ঘটিয়েছেন যে, হেলাল আর বাঁচবে না। এমআরআই রিপোর্টে একটি ছোট টিউমারের বিবরণ থাকলেও তিনি দুটি টিউমার অপসারণের কথা বলেন, যা তার অদক্ষতা ও ভুল অপারেশনের প্রমাণ।

 

অপারেশনের পরে সাধারণ পোস্ট অপারেটিভ কক্ষে অন্যান্য সাধারণ বোগীর সাথে ব্রেনে সার্জারি করা হেলালকে রাখা হয়। অপারেশন শেষে এক ঘণ্টার মধ্যেই তার জ্ঞান ফিরিয়ে এনে প্রতারক সার্জন ১২ সেকেন্ডের একটি ভিডিও রেকর্ড করে রাখেন, রোগী বেঁচে আছে দেখানোর জন্য। কিন্তু সেই ভিডিওতে দেখা যায় রোগী মুমূর্ষু অবস্থায় আছে। পরদিন সকালে রোগীর জ্ঞান ফিরলে তাকে স্যুপ ও জাউ ভাত খেতে দেওয়া হয়। রোগীর নাকে একটি মোটা পাইপ লাগানো থাকা সত্ত্বেও তাকে ওরাল ওষুধ ও খাবার দেওয়া হয়। এতে রোগীর খুব কষ্ট হচ্ছিল। দায়িত্বরত সেবিকাদের অবগত করলে তারা জানান, সার্জন এ ধরনের নির্দেশ দিয়েছেন। গত গত ১৬ জুলাই রাতে হেলালের ব্রেইনের একটি সিটিস্ক্যান করা হয়। ওই রিপোর্টা ফিলা সার্জন দেখেন, রোগীর স্বজনদের দেওয়া হয়নি। রাত ৮ টার দিকে সার্জনকে তার চাহিত এক লাখ ৩০ হাজার টাকা পরিশোধ করার সময় রোগীর অবস্থা জানতে চাইলে এই সার্জন এড়িয়ে গিয়ে বলেন, রোগী অবস্থা তো আপনারাই আমাকে বলবেন। রাত একটু বেশি হলে রোগীর কোন এ্যাটেনডেন্টকে রোগীর কাছে যেতে দেওয়া হয় না। ২/৩ জন অল্প বয়সী অদক্ষ নার্স পোস্ট অপারেটিভে ডিউটিতে থাকেন। অপারেশনের রাতে ও পরের দিন রাতে রোগীর মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা হয়, ফলে

 

১৭ জুলাই সারাদিন হেলাল ধীরে ধীরে অচেতন থেকে ক্রমেই নিস্তেজ হতে থাকে। বার বার সেবিকাদের অবগত করলে তারা জানান, সার্জনকে ভিডিও কলে দেখিয়েছেন রোগীর অবস্থা। সার্জন ভিডিওকলে রোগী দেখে কিছু ওষুধ পরিবর্তন করে দিয়ে তাব দায়িত্ব শেষ করেছেন। কিন্তু রোগীর অবস্থা ধীরে ধীরে অবনতি হতে থাকে। ওই দিন রাত ৮টার দিকে সার্জন আতিক হেলালকে পুনরায় ওটিতে নিয়ে উপস্থিত স্বজনদের সবাইকে ডেকে কাউন্সেলিং করে বলেন, ‘অপারেশনের পরে কিছু জটিলতা তৈরি হয়েছে। এখন ওষুধে না কমলে মাথার পানি বের করার জন্য ফুটা করে একটি ড্রেন লাইন করতে হবে, সবার দোয়া চাই।’ রাত ১১টার দিকে রোগীকে এ্যানেস্থেশিয়া ছাড়াই মাথায় ফুটো করে ড্রেন লাইন করে দিয়ে সার্জন চলে যান। হেলাল সারারাত অচেতন অবস্থায় পোস্ট অপারেটিভে পড়ে থাকে এবং সকালে তার প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট শুরু হলেও পোস্ট অপারেটিভের কেউ কোন ব্যবস্থা নেয়নি। ১৮ জুলাই সকাল ১০টার দিকে হেলালের ছোট চাচা এসে হেলালের অবস্থা দেখে তাকে দ্রুত আইসিইউতে নেওয়ার কথা বলেন। তখন ডিউটি ডাক্তার ও নার্সরা তাকে আইসিইিউতে প্রেরণ করেন এবং সকাল ১১টা ৫৪ মিনিটে আইসিইউতে মারান যান হেলাল।

 

ছাবেরীন স্মৃতি বলেন, ঘাতক অর্থলোভী ডা. আতিক হেলালকে বাঁচানোর জন্য ন্যূনতম চেষ্টাটুকুও করেননি। অল্প বয়সী একটা সরল বিশ্বাসী ছেলেকে ভুল অপারেশনের মাধ্যমে মৃত্যুর দিকে ধাবিত করেন। তিনি চাইলে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য নিউরোসায়েন্স কিংবা ঢাকা মেডিকেলে নিতে পারতেন। অথবা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের এনে রোগীকে দেখিয়ে পরামর্শ নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি ভেবেছেন এসব করলে তার অর্থ আয়ে ভাটা পরবে এবং তার ভুল চিকিৎসার বিষয়ে দেশবাসী জেনে যাবে। তাই সবকিছু গোপন রেখে সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম হেলালকে নির্মমভাবে চিকিৎসার নামে হত্যা কবে মায়ের কোল খালি করেছেন। সার্জন আতিক এবং ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই হেলালের মৃত্যুর দায় এড়াতে পারেনা।