
কক্সবাজারের ঈদগড়ের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম। তিন সন্তান আর স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন জীর্ণ একটি ঘরে। দিনে এনে দিনে খাওয়াই যার জন্য মুশকিল, সেই তিনিই শিকার হয়েছেন বড় এক প্রতারণার। চ্যানেল 24-এর হাতে এসেছে এমন একটি কাগজ, যাতে লেখা রয়েছে—নুরুল ইসলাম ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) চট্টগ্রামের একটি শাখা থেকে ২১ কোটি ৫০ লাখ টাকার একটি ঋণ নিয়েছেন। কিন্তু এই ঋণ সম্পর্কে কোনওভাবেই অবগত নন তিনি।
দরিদ্র মানুষটির কাছে কিছুদিন আগে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের চট্টগ্রামের চকবাজার শাখা থেকে আসে একাধিক নোটিশ। জানতে পারেন, কয়েক দফায় ওই ব্যাংক থেকে এই ঋণ নেওয়া হয়েছে। তাকে দেখানো হয়েছে চট্টগ্রামের ইসলাম ট্রেডার্স এবং পটিয়ার কিছু জমির মালিক হিসেবে।
ভুক্তভোগী নুরুল ইসলাম বলেন, করোনার সময় অনুদান দিবে বলে আমার কাছ থেকে এনআইডি নিয়েছিলো। বলেছিল, চাল-ডাল ছাড়াও অন্যান্য জিনিস দিবে। আমি কখনো ব্যাংকেই যাইনি, তাহলে এত টাকা ঋণ নিলাম কিভাবে?
ইসলামের মতো শাহজাহান, মোহাম্মদ তৈয়ব, জহিরুল ইসলামসহ রামুর ঈদগড় এবং নাইক্ষ্যংছড়ির বাইশারীর অন্তত ২২ জনের নামে শাখাটি থেকে ঋণ মঞ্জুর দেখানো হয় প্রায় আড়াইশো কোটি টাকা। অথচ এসব ব্যক্তি জানেনই না ঋণের বিষয়ে। তাদের সবাই দিনমজুর বা শ্রমিক, যারা ঠিকমতো স্বাক্ষরও করতে পারেন না।
এদের মতই ব্যাংকের নোটিশ পাওয়ার পর ২০২৩ সালে স্ট্রোক করে মারা যান গর্জনিয়ার মিজানুর রহমান। ফলে দুর্গম পাহাড়ের ভাঙা বাড়িতে তিন সন্তানকে নিয়ে চরম কষ্টে পড়েছেন তার স্ত্রী।
ঈদগড়ের ভুক্তভোগীরা বলেন, ২০২১–২২ সালে করোনার সময় সহায়তার কথা বলে স্থানীয় মিজানুর রহমান নামে এক ব্যক্তি তাদের কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র নেন। কয়েক মাস পর চট্টগ্রামের পটিয়ায় গিয়ে সহায়তার জন্য ফরমে স্বাক্ষর দেন তারা। বছর দুয়েক পর তাদের কাছে ব্যাংক ঋণের নোটিশ আসা শুরু হলে জানতে পারেন জালিয়াতির বিষয়টি।
একই অবস্থা বাইশারীর ভুক্তভোগীদেরও। চাকরির প্রলোভনে নুর বশর নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে নেওয়া হয় জাতীয় পরিচয়পত্র। তারা বলেন, পটিয়ায় নিয়ে তাদের কাছ থেকে স্বাক্ষর নেওয়া ফরমগুলো ছিল ইংরেজিতে লেখা। পরে তাদেরকে ২০ হাজার, ৪০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দিয়ে গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
মিজানুর ও নুর বশর—যাদের মাধ্যমে মানুষের জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করা হয়েছিল—তারাও ফেঁসে গেছেন ঋণের ফাঁদে। তারা জানান, প্রতারক চক্রের সদস্য আবুল কালাম ঈদগড়ের বাসিন্দা এবং নুর বশরের ভগ্নিপতি। কালাম দীর্ঘদিন ধরে পটিয়ায় থাকার সুবাদে পরিচয় হয় প্রতারক চক্রের সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান, শাহজাহান ও নুরুল আনোয়ারের সাথে। তারা মিলে এই দুইজনকেও ফাঁসিয়ে দেন প্রায় ২০ কোটি টাকার ঋণের জালে।
প্রতারণার শিকার মিজানুর রহমান বলেন, আবুল কালাম আমাকে বলে কয়েকটি এনআইডি কালেকশন করো, আমরা বাইরে থেকে এনে সস্তায় আর্থিক অনুদান দেবো।
আর নুর বশর জানান, সাদা এবং নীল রঙের দুটি কাগজে তাদের কাছ থেকে সই নেওয়া হয়।
এমন জালিয়াতি ও প্রতারণায় বিস্মিত জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয়রা। ঈদগড়ের ইউপি সদস্য মিজানুর রহমান বলেন, তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়, এত কোটি কোটি টাকা কিভাবে দিবে তারা? বাঁচবেই বা কিভাবে?
প্রতারক মোস্তাফিজ, শাহজাহান ও নুরুল আনোয়ারের বাড়ি পটিয়ায় হলেও তাদের অফিস ছিল চট্টগ্রামের নন্দনকানন জেকে টাওয়ারে। সেখানে খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, কয়েক মাস আগে তারা অফিস সরিয়ে নিয়েছেন তিনপুলস্থ বি অ্যান্ড বি টাওয়ারে। তবে সেখানে গিয়েও মেলেনি সন্ধান। সাড়া মেলেনি মুঠোফোনেও।
তবে দুজন নিরাপত্তারক্ষীকে দেখা যায় সেখানে। তারা জানান, ব্যাংকের বিভিন্ন লেনদেন করতো তারা এখান থেকে। বিভিন্ন ডকুমেন্ট নিয়ে আসা-যাওয়া করতেন সবসময়। তবে এখন কোথায় আছেন জানেন না।
ইউসিবি চকবাজার শাখা গেলে জানা যায়, কিছুদিন আগেই যোগদান করেছেন ব্যাংকের নতুন ম্যানেজার। তাই তিনি ডেকে আনেন অপারেশন ম্যানেজারকে। কারণ, তিনি ঋণ মঞ্জুরের সময় এই শাখায় দায়িত্বে ছিলেন।
তবে অপারেশন ম্যানেজার হোসনে মোবারক জিকু ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি হননি। প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষগুলো কখনো ব্যাংকে না এসেও কিভাবে ঋণ পেলেন বা ব্যাংক তদন্ত ছাড়াই কিভাবে ঋণ মঞ্জুর করলো—তার কোনো সদুত্তর দিতে না পেরে উল্টা বলেন, জায়গা না থাকলে তো আর ব্যাংক মর্টগেজে ঋণ দিতো না। যখন তারা নিয়েছিল তখন সব ডকুমেন্ট জমা দিয়েই নিয়েছেন।
পুরো প্রক্রিয়াটি জালিয়াতি আর চরম অনিয়মের নজির, বলছেন ব্যাংক আইন নিয়ে কাজ করা আইনজীবী অ্যাডভোকেট রমিজ আহমেদ। তিনি আরও বলেন, প্রতিষ্ঠানে যারাই জড়িত, তারা সবাই দায়ী এটির জন্য। পুরো গ্রুপ মিলে টাকা আত্মসাৎ করার জন্য এ কাজ করেছে।
অভিযোগ রয়েছে—প্রতারক চক্র ছাড়াও এই ঋণকাণ্ডে জড়িত ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা, যারা সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর কাছের লোক হিসেবে পরিচিত।