
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ষড়যন্ত্রের নানা সমীকরণ ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন হবে-এমন ঘোষণার পর অপশক্তিগুলো নির্বাচন বানচাল করতে চতুর্মুখী অপতৎপরতা শুরু করেছে। এমন পরিস্থিতিতে সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠী এবং পতিত আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা নাশকতা সৃষ্টিসহ পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির মতো ক্ষেত্র তৈরির অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সমাজের বিভিন্ন সেক্টরে ছদ্মবেশে থাকা পতিত আওয়ামী লীগের দোসররা সক্রিয় রয়েছে।
এ অবস্থায় এসব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করতে হলে সবার আগে দেশে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা জরুরি। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য এটি হলো অন্যতম পূর্বশর্ত। আর দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে এ মুহূর্তে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সেজন্য নির্বাচন পর্যন্ত আগামী ৬ মাস ভালোভাবে পার করতে সরকারের পাশে গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের সব শক্তিকে শক্তভাবে দাঁড়াতে হবে। সরকারকেও নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠকে বসতে হবে। সৃষ্ট সংকট নিরসনে যুগান্তরের কাছে এভাবে সমাধানের উপায় সম্পর্কে খোলামেলা কথা বলেন বেশ কয়েকজন সিনিয়র রাজনৈতিক নেতা ও বিশ্লেষক।
তারা বলেন, একটি মহল তো এখন প্রোপাগান্ডা যুদ্ধ জোরদার করবে। এটি হলো তাদের বড় শক্তি। এজন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে তারা প্রতিনিয়ত গুজব ছড়াতে ব্যস্ত থাকবে। ফলে সৃষ্ট সংকট ও বহুমুখী ষড়যন্ত্র কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে হলে জাতীয় ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। এজন্য গণ-অভ্যুত্থানের সব শক্তিকে সত্যিকারার্থে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। ক্ষমতা ও স্বার্থের দ্বন্দ্বে নিজেরা বিভেদে জড়িয়ে পড়লে বিপদ অনিবার্য।
তারা যুগান্তরকে বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান ঘিরে শক্তিশালী রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে উঠেছিল। কিন্তু এক বছর পর সেই ঐক্যে ফাটল ধরেছে। যা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। অপরদিকে নির্বাচনের সময় নিয়ে কারও অপত্তি না থাকলেও কয়েকটি দল বিতর্কিত কিছু দাবি তুলছে। এমনকি কোনো কোনো নেতা নির্বাচন হবে না বলে সাফ জানিয়ে দিচ্ছেন। এতে করে নির্বাচন নিয়ে জনমনে নানা সন্দেহ ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তৈরি হচ্ছে।
বিষয়টি নিয়ে দুই ধরনের পর্যবেক্ষণ রয়েছে। একটি হচ্ছে-এটি তাদের ‘রাজনৈতিক কৌশল’ হতে পারে। কারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আসন ভাগাভাগি নিয়ে পর্দার আড়ালে হয়তো কিছু দেনদরবার করতে চাইছে ওই সব দল। দ্বিতীয়ত, হতে পারে যারা নির্বাচনে অংশ নিয়ে বেশি সুবিধা করতে পারবে না, তারা নির্বাচন ছাড়া ভিন্ন পথে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছে। এর ফলে প্রকারান্তরে লাভবান হচ্ছে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ। তাদের ষড়যন্ত্রের পথকে এভাবে মসৃণ করে দেওয়া হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, ‘শেখ হাসিনার সময় তিনটি নির্বাচন হয়েছিল। সেসব নির্বাচনে জনগণ ভোটাধিকার বঞ্চিত হয়েছে। কাজেই নির্বাচনহীন অবস্থা থেকে মুক্তির সমাধান হচ্ছে-একটি সুষ্ঠু, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও নির্ভরযোগ্য নির্বাচন। যে নির্বাচন ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে হবে বলে সরকার ও নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচিত সরকার এলেই এসব সংকটের সমাধান হবে। তাই ৫ আগস্টের পর দেশে যে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছিল, আবারও সেই ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। সেজন্য সব দলের উচিত হবে নির্বাচনমুখী হওয়া এবং ঐক্যবদ্ধভাবে ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নেওয়া।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনসহ তার আগে দেশে যতগুলো জাতীয় নির্বাচন হয়েছে, সেখানেও এমন ষড়যন্ত্র ছিল। কিন্তু ওই সব নির্বাচন সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেই হয়েছে-এটাই বাস্তবতা। তাই এসব নতুন কিছু নয়। সামনে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন নিয়েও নানা ষড়যন্ত্র হচ্ছে। সেক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদবিরোধী সব রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ থাকলে কোনো চক্রান্তেই কাজ হবে না। তবে নির্বাচন কেন জরুরি তা জাতীয় স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোকে বুঝতে হবে। আর সেভাবেই তাদের সব কর্মকাণ্ড করা উচিত। দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে জাতীয় ঐক্য জরুরি। দেশ ও জাতির প্রয়োজনে এই দেশের মানুষ বহুবার ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। সামনেও সেই ঐক্য থাকবে বলে আমার ধারণা।’
সোমবার নওগাঁ জেলা বিএনপির দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে (ভার্চুয়ালি) বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, দেশ যাতে গণতান্ত্রিক অবস্থায় ফিরে আসতে না পারে, সেজন্য বিভিন্ন জায়গায় ষড়যন্ত্র চলছে। ষড়যন্ত্র চলছে আগামী জাতীয় নির্বাচন যাতে না হয়, সেজন্যও। তিনি বলেন, বিএনপি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পরিকল্পনা করছে। কিন্তু সেই পরিকল্পনা যাতে বাস্তবায়ন না হয়, ভন্ডুল হয়ে যায়-সেজন্য ষড়যন্ত্র চলছে। বিএনপির নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থেকে এসব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হবে।
সম্প্রতি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণার পর নির্বাচন কমিশনও ভোটের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে। এমন প্রেক্ষাপটে দেশের বড় দল বিএনপি ৪২টি মিত্র দলের সঙ্গে বৈঠক করেছে। এছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নির্বাচন বর্জন করা আরও ২২টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও অনানুষ্ঠানিক বৈঠক শুরু করেছে দলটি। এসব বৈঠকে নির্বাচনকে সামনে রেখে কিভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকা যায়-সে বিষয়ে সবচেয়ে বেশি জোর দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, পতিত আওয়ামী লীগ এখনো দেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্ত করছে। এ ব্যাপারে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ ও সচেতন থাকতে হবে। গত ১৬ বছরের অব্যাহত প্রচেষ্টার ফলেই সংঘটিত হয়েছে জুলাই অভ্যুত্থান। আমরা বারবার লড়াই করে বিজয়ী হলেও সে বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। এবারও যদি দুর্নীতি ও অনাচার থেকে আমরা জাতিকে রক্ষা করতে না পারি তা হলে আমাদের সব অর্জন ব্যর্থ হয়ে যাবে। এজন্য অবশ্যই আমাদের ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য প্রয়োজন। যে ঐক্য জুলাইয়ের চেতনাকে সমুন্নত রাখবে।
তিনি আরও বলেন, বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিসহ অন্য দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব যতই থাকুক না কেন-তারা কেউই অগণতান্ত্রিক দল নয়, সবাই গণতান্ত্রিক দল। কাজেই নির্বাচনের ব্যাপারে কারও কোনো বাধা আছে বলে মনে করি না। নির্বাচনের প্রস্তুতি ও জনগণের আকাঙ্ক্ষা সব কিছুই নির্বাচনের পক্ষে আছে।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, রাষ্ট্রের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে পতিত স্বৈরাচারের অনুসারীরা সক্রিয় রয়েছে। তাই ষড়যন্ত্রকারীদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষে থাকা দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বলেন, ১৫ বছরের পতিত ফ্যাসিবাদের বিষাক্ত বাতাস এখনো দেশকে অনিরাপদ করে রেখেছে। পতিত স্বৈরাচার দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়। এভাবে তারা সুযোগ নেওয়ার পাঁয়তারা করে যাচ্ছে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজ দলের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ কোনো অবস্থাতেই পতিত ফ্যাসিবাদকে সুযোগ করে দেওয়া যাবে না।
এদিকে আন্তর্জাতিক যুব দিবস উপলক্ষ্যে মঙ্গলবার জাতীয় যুব সম্মেলনে জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে স্থিতিশীলতা এবং জাতীয় ঐক্য ধরে রাখা। যদি রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে জাতীয় ঐক্য ধরে রাখতে না পারে, দেশের স্থিতিশীলতা নিশ্চিতে নিজেদের মধ্যে ছাড় দেওয়ার মানসিকতা তৈরি না হয়, তাহলে আরেকটি এক-এগারো আসবে। কারণ, ইতিহাসে এটাই দেখা গেছে।
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তিগুলোর বিভেদের কারণেই ফ্যাসিবাদ বারবার সুযোগ নিচ্ছে। আমরা ফ্যাসিবাদের পতনের পর দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছি এবং এটি রোধ করতে সরকার কার্যকর ভূমিকা নেয়নি। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঘন ঘন বসবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন। আশা করি, ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য অটুট থাকবে।
গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান মনে করেন, যে কোনো ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাবেই মোকাবিলা করতে হবে। তবে ষড়যন্ত্র হলেও ঐক্যমতের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে যথাসময়েই নির্বাচন হবে। এটা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ওয়াদা। তিনি কারও ফাঁদে পড়ে ওয়াদা ভঙ্গ করবেন না। বরং রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত হবে অযথা সময় নষ্ট না করে মাঠঘাট, গ্রামগঞ্জে গিয়ে গণমানুষের কাছে নিজের দলের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য তুলে ধরে জনগণের ম্যান্ডেট আদায়ের চেষ্টা করা।