
ড. মো. আদনান আরিফ সালিম
গত বছরের জুলাই-আগস্টের উত্তাল গণঅভ্যুত্থানের মুখে ফ্যাসিবাদের পতনের পর মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভের বিস্তার দেখা গিয়েছে তা পুরোপুরি প্রশমিত হয়নি। এই রাজনৈতিক অস্থিরতা অতিক্রম করে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথটি তত্ত্বের দিক থেকে যতটা সহজ, তথ্যে ও বাস্তবতায় ততটাই কঠিন। বিশেষত দীর্ঘ ফ্যাসিবাদের প্রভাবে ধ্বংস হয়ে যাওয়া রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, বিচারিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবকাঠামোর পুনর্গঠন ও রূপান্তরের প্রক্রিয়া যেমন জটিল, তেমনি সময়সাপেক্ষ ও শ্রমনির্ভর। সম্প্রতি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জরিপে প্রাপ্ত তথ্যও এই কথাটি বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) প্রকাশিত সাম্প্রতিক ‘পালস সার্ভে ৩’ আমাদের সামনে এক জটিল ও চিন্তাজনক চিত্র হাজির করেছে। জরিপে দেখা যাচ্ছে—প্রায় অর্ধেক, অর্থাৎ ৪৮.৫০ শতাংশ ভোটার এখনও ঠিক করেননি কাকে ভোট দেবেন। গত বছরের অক্টোবরে এই হার ছিল ৩৮ শতাংশ; অর্থাৎ মাত্র আট মাসে অনিশ্চয়তা বেড়েছে এক লাফে ১০ শতাংশেরও বেশি।
আমরা যদি রাষ্ট্রচিন্তক স্যামুয়েল হান্টিংটনের “Political Decay” তত্ত্বকে সামনে রেখে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করি, তাহলে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা সামনে আসে সবার আগে। এই ব্যর্থতা পুরোপুরি ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা ফ্যাসিবাদের অবদান। হান্টিংটন বলেছেন, যখন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়, তখন রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ধরণ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে এবং সিদ্ধান্তহীনতা বেড়ে যায়। বাংলাদেশের বর্তমান চিত্র তারই একটি প্রতিফলন। এখানে দলীয় জনপ্রিয়তার পতন ও নতুন রাজনৈতিক শূন্যতা আওয়ামী লীগের আকস্মিক পলায়ন এবং সরাসরি গণহত্যায় অংশ নেওয়ার কারণে বাধ্যতামূলক রাজনৈতিক নির্বাসনের সঙ্গে জড়িত।
সাম্প্রতিক এই জরিপ বলছে, বিএনপির সমর্থন গত অক্টোবরে ১৬.৩০ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ১২ শতাংশে। জামায়াতে ইসলামীও ১১.৩০ শতাংশ থেকে ১০.৪০ শতাংশে নেমেছে। আওয়ামী লীগের (যার কার্যক্রম বর্তমানে নিষিদ্ধ) সমর্থন ৮.৯০ শতাংশ থেকে কমে ৭.৩০ শতাংশে ঠেকেছে। আবার একটু তত্ত্বের দিকে তাকাই। আমরা যদি “Cleavage Theory” কে প্রাসঙ্গিক ধরি, তাহলে তার আঙ্গিকে লিপসেট ও রোক্কা প্রস্তাব করেছিলেন প্রতিনিধিত্বকে সামনে রেখে। তাদের মতে, সামাজিক বিভাজন (ধর্ম, ভাষা, শ্রেণি) যদি রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বারা কার্যকরভাবে প্রতিনিধিত্ব না পায়, তবে দলগুলো ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা হারায় এবং ভোটাররা বিকল্প খোঁজেন অথবা অনিশ্চিত হয়ে পড়েন।
এখানে বিকল্প খোঁজার চেয়ে ভোটারদের দ্রুত ‘কূল নাই, কিনার নাই’ হয়ে যাওয়াটা দৃশ্যমান। তবে “Political Opportunity Structure” এর ফল হিসেবে দেখা যাচ্ছে এনসিপির সমর্থন সামান্য হলেও বেড়েছে—২ শতাংশ থেকে ২.৮০ শতাংশে। এটিকে বলা যেতে পারে, যেখানে বিদ্যমান বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তির দুর্বলতায় ক্ষুদ্র দলগুলো অপ্রত্যাশিত সুযোগ পায়। কিন্তু এই বৃদ্ধি এখনো তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়; এটি একটি প্রবণতা, স্থায়ী ভিত্তি নয়। তবে বড় রাজনৈতিক দলগুলো ধারাবাহিকভাবে ভুল করতে থাকলে, জনগণের আশা-প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটাতে না পারলে রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদের পতন অব্যাহত থাকবে। এই পতন পুরোপুরি গিয়ে আছড়ে পড়তে পারে নির্বাচনের ফলাফলেও।
অক্টোবরে যেখানে ৫৬ শতাংশ মানুষ রাজনৈতিকভাবে দেশ সঠিক পথে চলছে মনে করেছিলেন, এখন সেটি নেমে ৪২ শতাংশে এসেছে। যদিও অর্থনীতি নিয়ে আশাবাদ সামান্য বেড়েছে (৪৩% থেকে ৪৫%), রাজনৈতিক দিকের এই পতন ইঙ্গিত করছে কিছু বিশ্বাসহীনতার দিকে। ল্যারি ডায়মন্ডের গণতান্ত্রিক তত্ত্বকে সামনে রাখলে আমরা ধরে নিতে পারি, রাজনৈতিক আস্থার এই অবক্ষয় দীর্ঘমেয়াদে গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতার জন্য বিপজ্জনক। ভোটারদের সক্রিয় অংশগ্রহণ কমিয়ে দিয়ে এটা দেশকে চরমপন্থার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
সংস্কার নাকি দ্রুত নির্বাচন—গণতান্ত্রিক রূপান্তরের এই দোটানায় মানুষ বিরক্ত। তারা চেয়ে দেখছে, সংস্কারের নামে মুলা ঝুলিয়ে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। পাশাপাশি এই জরিপে যারা বলছেন, আগে ভালোভাবে সংস্কার তারপর নির্বাচন হওয়া উচিত, তারা কোন সমাজের প্রতিনিধিত্ব করছেন, সেটার স্পষ্ট উল্লেখ নেই। ওদিকে ১৭ শতাংশ চান কিছু জরুরি সংস্কার করেই নির্বাচন। ১৪ শতাংশ সংস্কার বাদ দিয়েই দ্রুত নির্বাচন চান। এই বিভাজনকে বোঝার জন্য বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান্তর পর্যায় সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা জরুরি।
এখানে রাজনৈতিক রূপান্তরের সময়ে একদল জনগণ দীর্ঘমেয়াদি প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ওপর জোর দিচ্ছেন, যেখানে সরাসরি তাদের স্বার্থ জড়িত। অন্যদিকে, আরেকদল অবিলম্বে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু করতে চান, যাদের জনসমর্থন দৃশ্যত অনেক বেশি। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই দ্বন্দ্ব বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর ওপরই নির্ভর করবে নির্বাচনোত্তর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা।
সংস্কারের অগ্রাধিকারের তালিকায় আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন (৩০%), দুর্নীতি দমন (১৭%), বিচারব্যবস্থার উন্নতি (১৬%) এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা কমানো (১৯%) প্রাধান্য পেয়েছে। একটি সুস্থ গণতন্ত্রের জন্য কার্যকর আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো অপরিহার্য। তবে এই নির্বাচনী আস্থার পরিসংখ্যান থেকে বোঝা কঠিন যে এটি বাস্তবতা নাকি কেবল প্রত্যাশা।
অবাক করার মতো বিষয় হলো, ৭০ শতাংশ মানুষ মনে করেন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। কিন্তু রাজনৈতিক আস্থার অবক্ষয়ের সঙ্গে এই উচ্চ আশাবাদ একটি বৈপরীত্য তৈরি করছে। প্রশ্ন আসে, এটি কি আশাবাদজনিত শূন্যতা? বাংলাদেশের নির্বাচন-ইতিহাসে এই ধরনের উচ্চ প্রত্যাশা প্রায়ই ভোট-পরবর্তী হতাশায় রূপ নিয়েছে। এবারও কি তার ব্যতিক্রম হবে?
জরিপে যখন প্রশ্ন করা হয়, আপনার এলাকায় কোন দলের প্রার্থী জিতবে বলে মনে করেন—৩৮% বলেছেন বিএনপি, ১৩% জামায়াত, ৭% আওয়ামী লীগ। এটি সরাসরি ব্যান্ডওয়াগন ইফেক্টের ইঙ্গিত দেয়, যেখানে মানুষ জনপ্রিয় মনে হওয়া প্রার্থীর পক্ষে ঝুঁকে পড়ে। তবে বাস্তব নির্বাচনে এই অনুমান ভ্রান্ত হতে পারে, বিশেষ করে যদি প্রচারণা কৌশল, জোটগত সমীকরণ ও প্রশাসনিক প্রভাব শেষ মুহূর্তে দৃশ্যপট বদলে দেয়। তবুও ধারণা করা যায়, এবারের ভোটে মানুষ হয়তো মার্কার চেয়ে ব্যক্তিকে বেশি গুরুত্ব দিতে পারে।
জরিপটি নিয়ে সন্দেহ, বিশ্বাসহীনতা, বিভ্রান্তি ও অশনিসংকেত থাকলেও এটি মূলত একটি রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণের আংশিক ছবি। প্রচলিত ক্ষমতাসীন দলগুলো নিয়মিত জনগণের আস্থা হারাচ্ছে, পলাতক স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্ট সরকারের আতঙ্ক মানুষকে ভীত করছে, আর নতুন বিকল্প এখনো শক্তিশালী হয়নি। সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রায় সব সেক্টরে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। জনগণের বড় একটি অংশ রাজনৈতিকভাবে দ্বিধান্বিত, শত্রু চিহ্নিত করতে না পেরে অনেক সময় নিজেদের মধ্যে বিভক্ত হয়ে মাঠ ও অনলাইন রাজনীতিকে উত্তপ্ত করছে।
রবার্ট ডাহলের পলিআর্কি তত্ত্ব অনুসারে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া তখনই সুদৃঢ় হয় যখন রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বাড়ে এবং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশে সক্রিয় অংশগ্রহণের ইচ্ছা থাকলেও প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র সীমিত, আর আস্থার ঘাটতি বহুগুণ বেশি।
বড় রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এই সিদ্ধান্তহীনতা এক ভয়াবহ সতর্কবার্তা। এখনই যদি তারা কার্যকর সংস্কার, স্বচ্ছতা এবং জনগণের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততা না বাড়ায়, তবে এই অনিশ্চিত ভোটাররা হয় ভোটদানে বিরত থাকবে, নয়তো রাগ করে এমন প্রার্থীকে ভোট দেবে যে অযোগ্য হয়েও জয়ী হতে পারে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এটি শুধু দলগুলোর জন্য নয়, রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার জন্যও বিপজ্জনক। মুক্তির জন্য দলগুলোকে ক্ষমতার পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন ও জনগণের প্রকৃত চাহিদা পূরণে প্রতিযোগিতা শুরু করতে হবে এখনই, নচেৎ তাদের এবং বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য ভয়াবহ অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।