
রংপুরের তারাগঞ্জে রূপলাল দাস ও প্রদীপ লালকে পিটিয়ে হত্যার সময় ঘটনাস্থলে পুলিশ এসেছিল। কিন্তু ‘মবের ভয়ে’ তাঁদের উদ্ধার না করে ফিরে যায় পুলিশ। ঘণ্টাখানেক পর সেনাবাহিনীর সহায়তায় তাঁদের অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়, যাঁর মধ্যে একজন হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মারা যান; অন্যজন মারা যান কয়েক ঘণ্টা পর চিকিৎসাধীন অবস্থায়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
তারাগঞ্জ উপজেলার সয়ার ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আবদুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রশাসন কিসের জন্য? পুলিশ আসছিল, লোকগুলাক সেফ করবে না? কিন্তু পুলিশ আসিয়া বহুত লোক দেখিয়া ঘুরি যায়। পুলিশ চাইলে লোক দুইটাক বাঁচার পারত।’
প্রশাসন কিসের জন্য? পুলিশ আসছিল, লোকগুলাক সেফ করবে না? কিন্তু পুলিশ আসিয়া বহুত লোক দেখিয়া ঘুরি যায়। পুলিশ চাইলে লোক দুইটাক বাঁচার পারত।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রূপলাল দাস ও প্রদীপ লালকে যেখানে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তার তিন কিলোমিটার এলাকার মধ্যে এর আগে আট দিনে তিনটি চুরি-ডাকাতি ও এক শিশুকে গলা কেটে হত্যা করে ভ্যান ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ফলে মানুষজন চোর-ডাকাতের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। ৩ আগস্ট থেকে চোর ধরতে এলাকাবাসী রাত জেগে পাহারা দেওয়া শুরু করেন। ঘটনাচক্রে যার নির্মম বলি হন রূপলাল ও প্রদীপ।
রূপলাল দাসের (৪০) বাড়ি রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুর গ্রামে। গত শনিবার রাত ৯টার দিকে সয়ার ইউনিয়নের বটতলা এলাকায় গণপিটুনিতে নিহত হন তিনি। একই ঘটনায় নিহত হন তাঁর ভাগনির স্বামী প্রদীপ লাল (৩৫)। প্রদীপের বাড়ি মিঠাপুকুর উপজেলার বালুয়াভাটা গ্রামে। রূপলাল স্থানীয় বাজারে জুতা সেলাই করতেন। ছোট্ট একটি টিনের ঘরে তিনি মা, স্ত্রী ও তিন সন্তানসহ থাকতেন। আর প্রদীপ লাল জীবিকা নির্বাহ করতেন ভ্যান চালিয়ে।
নিহত রূপলালের পরিবার জানায়, রূপলাল দাসের মেয়ে নুপুর রানীর বিয়ের কথাবার্তা চলছিল মিঠাপুকুরের শ্যামপুর এলাকার এক যুবকের সঙ্গে। গত রোববার বিয়ের দিন–তারিখ ঠিক করার কথা ছিল। এ জন্য মিঠাপুকুর থেকে নিজের ভ্যান চালিয়ে রূপলালের ভাগনির স্বামী প্রদীপ লাল আগের দিন শনিবার ঘনিরামপুর গ্রামে রূপলালের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন। কিন্তু গ্রামের ভেতর দিয়ে রাস্তা না চেনায় প্রদীপ কাজীরহাট এলাকায় এসে রূপলালকে ফোন করেন। সেখানে রূপলাল গিয়ে দুজন ভ্যানে চড়ে ঘনিরামপুর গ্রামের দিকে রওনা হন।
যখন মব তৈরি হয়, তখন স্কুল মাঠে তিন চার হাজার লোক। পুলিশ তাঁদের রক্ষার চেষ্টা করছিল। কিন্তু লোকজন সরছিল না। তিন চার হাজার লোকে ডিঙিয়ে ওদের ওইভাবে সেফ করা পুলিশের পক্ষে সম্ভব হয়নি।তারাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এম এ ফারুক
রূপলালের ছেলে জয় দাস অভিযোগ করেন, শনিবার রাত ৯টার দিকে তারাগঞ্জ-কাজীরহাট সড়কের বটতলা এলাকায় পৌঁছালে কয়েকজন যুবক তাঁদের আটক করেন। একপর্যায়ে প্রদীপ লালের ভ্যানে থাকা বস্তা থেকে কয়েকটি প্লাস্টিকের ছোট বোতল বের করেন তাঁরা। এটা নিয়ে তাঁদের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। একপর্যায়ে লোকজন জড়ো হলে রূপলাল ও প্রদীপ লালকে চোর আখ্যা দেওয়া হয়। বস্তায় থাকা একটি বোতল নাকের সামনে নিয়ে মেহেদী হাসান উপস্থিত লোকজনকে বলেন, ‘এ ভাই, দয়া করে আমাকে ধরো’ বলে মাটিতে পড়ে যেতে থাকেন। এরপর দুজন তাঁকে কোলে করে সরিয়ে নেন। এ ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে সেখানে শত শত লোক জড়ো হন। একপর্যায়ে অচেতন করে চুরি করা চোর সন্দেহে তাঁদের দুজনকে মারধর শুরু হয়। মারতে মারতে তাদের বুড়িরহাট উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে নেওয়া হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, রূপলাল ও প্রদীপকে যখন বুড়িরহাট মাঠে নিয়ে আসা হয়, তখন খবর পেয়ে পুলিশের দুটি ভ্যান রাত সাড়ে ৯টার দিকে বুড়িরহাট বাজারে অবস্থান নিলেও দুজনকে উদ্ধার না করে ফিরে যায়। তখনো রূপলাল ও প্রদীপ লাল জীবিত ছিলেন। এরপর প্রায় এক ঘণ্টা পর পুলিশ ও সেনাবাহিনীর তিনটি গাড়ি সেখানে যায়। তারা বুড়িরহাট উচ্চবিদ্যালয় থেকে অচেতন অবস্থায় এ দুজনকে উদ্ধার করে।

আজ মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে বুড়িরহাট উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের ভবনের প্রধান ফটকের অদূরে যেখানে রূপলাল ও প্রদীপ লালকে মারধর করা হয়, সেখানে তাঁদের জুতা, লুঙ্গি, ছাতা, গামছা, ভ্যানের হ্যান্ডেল, ক্যাবল পড়ে আছে। পুরো এলাকায় থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। সবার চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বুড়িরহাট বাজারের সবজি বিক্রেতা খোকন মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘তখন আমার দোকান খোলা। চারদিক থেকে লোকজন দৌড়াচ্ছে। শুনলাম চোর ধরা পড়ছে। এর কিছুক্ষণ পর দুটি পুলিশের গাড়ি আসে। কিন্তু অনেক লোক দেখে তাঁরা ফেরত যায়।’
বুড়িরহাট গ্রামের ভ্যানচালক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ভ্যান চালে বাড়ি আসছি। তখন রাইত সাড়ে ৯টা। বুড়িরহাট বাজারের পাশোত বুড়িরহাট স্কুলের মাঠে রূপলাল দাস ও প্রদীপ লালকে জনগণ চোর সন্দেহে মারছিল। তখনো বাঁচি আছলো। দুই গাড়ি পুলিশও আলছিলো। জনগণ সরানোর জন্য পুলিশ বাসিত ফুঁকও দিছিলো। কিন্তু জনগণ না সরায় পুলিশ ঘুরি যায়। পর সেনাবাহিনী আর পুলিশের তিনটা গাড়ি আসি অজ্ঞান অবস্থায় ওই দুইজনকে নিয়া যায়।’
রূপলালের মা লালচি দাস বলেন, ‘মোর বাবা তো মাটির মানুষ আছলো। কারও সাথে কোনো দিন ঝগড়া করে নাই। বিনা দোষে মোর বাবাক মারি ফেলাইছে। যায় মোর বাবাকে মারছে তার ফাঁসি চাও।’
তারাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এম এ ফারুক বলেন, ‘থানা থেকে বুড়িরহাট বেশ অনেক দূর। যেখানে যেতে সময় লাগে। যখন মব তৈরি হয়, তখন স্কুল মাঠে তিন চার হাজার লোক। পুলিশ তাঁদের রক্ষার চেষ্টা করছিল। কিন্তু লোকজন সরছিল না। তিন চার হাজার লোকে ডিঙিয়ে ওদের ওইভাবে সেফ করা পুলিশের পক্ষে সম্ভব হয়নি।’