
প্রশাসনে পদ-পদায়ন নিয়ে চরম বিশৃঙ্খলা চলছে। জনপ্রশাসনে বর্তমানে দেড় হাজারের মতো প্রকল্প চলমান। এর মধ্যে প্রায় এক হাজার ১০০ প্রকল্প ৫০ কোটি টাকার ওপরে। এমন প্রকল্পে যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার একজন পূর্ণকালীন পিডি (প্রকল্প পরিচালক) নিয়োগ দেওয়ার বিধান রয়েছে।
অন্যদিকে প্রশাসনে এই দুই স্তরে অনুমোদিত পদের বিপরীতে কয়েক গুণ বেশি কর্মকর্তা মন্ত্রণালয়গুলোতে সংযুক্তিতে রাখা হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে একই ব্যক্তি একাধিক অনুবিভাগের দায়িত্বে রয়েছেন।
উল্লিখিত বিষয়ে জানতে চাইলে প্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. ফিরোজ মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পদায়ন নিয়ে প্রশাসনে চরম বিশৃঙ্খলা চলছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২১৩ কোটি টাকার জামালপুর জেলা কারাগার পুনর্নির্মাণ প্রকল্পের পিডি উপসচিব সুব্রত কুমার রায়।
এ ব্যাপারে পিডি সুব্রত কুমার রায় কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একটি প্রকল্পের দায়িত্বই সঠিকভাবে পালন করতে রাত-দিন পরিশ্রম করতে হয়। সেখানে দুটি প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া হলে প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি হবে এবং ব্যয় বাড়ে।’
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সরকারি খাতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধন পদ্ধতিসংক্রান্ত পরিপত্রের ১৬.৩৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোনো প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ৫০ কোটি টাকা বা তার চেয়ে বেশি হলে একজন পূর্ণকালীন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দিতে হবে। একই সঙ্গে পিডিকে হতে হবে অভিজ্ঞ ও যোগ্য। একজন কর্মকর্তাকে একাধিক প্রকল্পের পিডি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। কিন্তু পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সেই নির্দেশনা বছরের পর বছর ধরে উপেক্ষিত হয়ে আসছে।
বিষয়টি নিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করা হলে নাম প্রকাশ করে দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তাই কথা বলতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন অতিরিক্ত সচিব জানান, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে অন্তত দেড় হাজারের মতো উন্নয়ন প্রকল্প রয়েছে। এর মধ্যে অন্তত এক হাজার ১০০ প্রকল্পই ৫০ কোটি টাকার ওপরে। নিয়ম অনুযায়ী, ৫০ কোটি বেশি টাকার প্রকল্পে যুগ্ম সচিব বা অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের একজন পূর্ণকালীন পিডি নিয়োগ দিতে হবে। কিন্তু এ ধরনের যোগ্য কর্মকর্তা পাওয়া যাচ্ছে না। প্রকল্পের পিডি হওয়ার চেয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সংযুক্তিতে থাকার আগ্রহীর সংখ্যাই বেশি। যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিবরা সচিবালয়ের বাইরে পদায়ন নিতেই চান না।’ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রশাসনের সহকারী সচিব থেকে সিনিয়র সচিব পর্যন্ত অনুমোদিত পদ তিন হাজার ৬৯৬টি। এসব পদের বিপরীতে কাজ করছেন ছয় হাজার ৫৩৫ জন। অর্থাৎ পদের থেকে দুই হাজার ৮৩৯ জন বেশি কর্মকর্তা থাকলেও একজন কর্মকর্তাকে একাধিক উইংয়ের দায়িত্বেও রাখা হয়েছে অনেক মন্ত্রণালয়ে।
মন্ত্রণালয়গুলোতেও প্রয়োজনের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি কর্মকর্তা কাজ করছেন। যেমন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে মাত্র দুটি অনুমোদিত পদের বিপরীতে আটজন অতিরিক্ত সচিব কর্মরত আছেন। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ক্ষেত্রেও মাত্র দুটি অনুমোদিত পদের বিপরীতে ১১ জন কর্মকর্তা অতিরিক্ত সচিব পদে রয়েছেন। এই বিভাগের প্রশাসনিক শাখায় যুগ্ম সচিবের অনুমোদিত পদ না থাকলেও এখন সাতজন কর্মকর্তা ওই শাখায় কর্মরত আছেন। আবার একই কর্মকর্তা একাধিক অনুবিভাগের দায়িত্ব পালন করছেন। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ইমাম উদ্দীন কবীর প্রশাসন অনুবিভাগের পাশাপাশি প্রাণিসম্পদ অনুবিভাগ, সমন্বয় ও আইসিটি অনুবিভাগ এবং ব্লু ইকোনমি অনুবিভাগও সামলাচ্ছেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এ বি এম সফিকুল হায়দার প্রশাসন অনুবিভাগের পাশাপাশি সেবা অনুবিভাগ, ত্রাণ প্রশাসন অনুবিভাগ এবং পরিকল্পনা ও উন্নয়ন অনুবিভাগও দেখভাল করছেন। স্বরাষ্ট্র, ধর্ম, ভূমি, কৃষি, স্থানীয় সরকার বিভাগ, অর্থ বিভাগ, খাদ্য মন্ত্রণালয়সহ প্রায় সব মন্ত্রণালয়েই এক অবস্থা।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, পদ ছাড়াই পদোন্নতি দেওয়ার ফলে পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তাদের আগের পদেই কাজ করতে হয়, যা প্রশাসনিক ভাষায় ‘ইনসিটু’ বলা হয়। অর্থাৎ পদোন্নতির প্রজ্ঞাপন হওয়ার পরই পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তারা নিজ নিজ (পদোন্নতির আগের কর্মস্থল) মন্ত্রণালয়ে সংযুক্তির জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে তদবির করে থাকেন। পরে পছন্দমতো মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে সুবিধামতো পদায়ন নিয়ে থাকেন। প্রকল্পের পিডি বানাতে চাইলেও তাঁরা রাজি হন না। কর্মকর্তার অভাবে একই কর্মকর্তাকে একাধিক প্রকল্পের পিডির দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে অপেক্ষাকৃত জুনিয়র কর্মকর্তাদেরও পিডি করা হচ্ছে। তবে বড় বা বিদেশি বিনিয়োগ আছে—এমন প্রকল্পের পিডি হতে ব্যাপক তদবির করে থাকেন কর্মকর্তারা। দামি গাড়িসহ বিদেশে যাওয়ার সুযোগ থাকে এমন প্রকল্পের পিডি হতে আপত্তি নেই তাঁদের। বিদেশ পদায়নেও কর্মকর্তাদের মধ্যে এখনো সোনার হরিণের মতো চাহিদা রয়েছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে এসে প্রশাসনে বদলি ও পদায়ন করে। জটিলতা দেখা দিলে পরে বেশ কিছু বদলির আদেশ বাতিল করা হয়। সরকারের চারজন উপদেষ্টা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে তাঁদের মতামত না নিয়ে তাঁদের মন্ত্রণালয় ও বিভাগে কর্মকর্তাদের বদলি ও পদায়ন না করার নির্দেশনা দেন। এতে জটিলতায় পড়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।