Image description

২০২৬ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বইয়ের দরপত্র আহ্বানের তিন মাস পার হয়েছে, অথচ এখনো কোনো বইয়ের কার্যাদেশ দেওয়া সম্ভব হয়নি। এতে এখনো ছাপা শুরু হয়নি আগামী বছরের পাঠ্যবই। ফলে সব প্রক্রিয়া শেষে আগামী চার মাসে ৩০ কোটি বই ছাপার কাজ শেষ করা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।

২০২৫ শিক্ষাবর্ষের সব বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছাতে মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত সময় লেগেছিল।

ফলে ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের বইয়ের দরপত্র অনেকটা আগেভাবেই শুরু করেছিল জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।

সূত্র জানায়, কার্যাদেশ পেলেই বই ছাপার কাজ শুরু হবে না। কারণ কার্যাদেশ পাওয়ার পর প্রেস মালিকরা চুক্তি করার জন্য ২৮ দিন সময় পাবেন। অর্থাৎ কার্যাদেশ পাওয়ারও প্রায় এক মাস পর থেকে কাজ শুরু করার সুযোগ থাকে।

 
আর চুক্তির পর প্রথম পর্যায়ে বই ছাপাতে ৭০ দিন সময় পাবেন প্রেস মালিকরা। যদিও এরপর নানা উপায়ে সেই সময় বাড়ানো যায়।

এনসিটিবি সূত্র জানায়, এখন পর্যন্ত শুধু প্রাক-প্রাথমিকের কার্যাদেশের ফাইল অনুমোদন হয়েছে, তবে কিছু জটিলতায় তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আটকে আছে। এ সপ্তাহের শেষদিকে বা আগামী সপ্তাহে একটি শ্রেণির কার্যাদেশ দেওয়া হতে পারে।

 
অন্যান্য শ্রেণির বইয়ের দরপত্র সম্পন্ন করে ফাইল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও তা অনুমোদন হয়ে কবে নাগাদ আসতে পারে, সে ব্যাপারে সঠিক তথ্য নেই।

এনসিটিবির চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দরপত্র শেষে আমরা ফাইল মন্ত্রণালয়ে দ্রুত পাঠিয়ে দিয়েছি। এরপর অনেক প্রক্রিয়া রয়েছে। ক্রয় কমিটির অনুমোদন পেতে হয়। আমরা ইতিমধ্যে প্রাক-প্রাথমিকের বইয়ের অনুমোদন পেয়েছি।

তবে সেখানেও সামান্য কিছু কাজ আটকে আছে। আগামী সপ্তাহের ক্রয় কমিটির বৈঠকে ষষ্ঠ শ্রেণির বইয়ের প্রস্তাব উত্থাপন হতে পারে। বেশির ভাগ শ্রেণির বইয়ের কার্যাদেশই কাছাকাছি সময়ে হবে বলে আমরা মনে করছি। তবে আগস্টের শেষে একটি শেণির বই হলেও আমরা ছাপার কাজ শুরু করব।’

সূত্র জানায়, এ বছর সবার আগে গত ৪ মে ষষ্ঠ শ্রেণির দরপত্র আহবান করা হয়। এরপর গত ১৮ মে প্রাক-প্রাথমিকের দরপত্র আহবান করা হয়েছিল। তবে প্রাক-প্রাথমিকের বইয়ের দরপত্র উন্মুক্ত হয়েছে গত ১৭ জুন। প্রাথমিক প্রথম থেকে তৃতীয় শেণির বই ৩০ জুন এবং চতুর্থ-পঞ্চম শেণির বইয়ের দরপত্র উন্মুক্ত হয়েছে ১৫ জুলাই। ষষ্ঠ শ্রেণির বই ২ জুন, সপ্তম শ্রেণির বই ৪ জুন, অষ্টম শ্রেণির বই ২৩ জুন, নবম শ্রেণির বই ২৪ জুলাই এবং ইবতেদায়ির বইয়ের দরপত্র উন্মুক্ত হয়েছে গত ১০ জুলাই।

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর একটি লটের বইয়ের দরপত্র উন্মুক্ত করা হয়েছে গত ১৯ জুন। যদিও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না পাওয়ায় প্রায় এক কোটি বই পুনঃ দরপত্রের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনসিটিবি। 

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আগের বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় এ বছরও সক্ষমতার বাইরে অনেক বেশি কাজ পেয়েছে কিছু মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান। এমনকি গত বছর যারা নিম্নমানের বই ছেপেছে, তারাও কাজ পেয়েছে। এসব মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান তাড়াহুড়া করে কাজ করা পছন্দ করে। কারণ যদি নভেম্বর-ডিসেম্বরে পুরোপুরি কাজ শুরু হয়, তখন এনসিটিবির পক্ষেও বিপুলসংখ্যক বইয়ের মান নিশ্চিত করা কষ্টকর হয়ে পড়ে। তারা তখন মানের চেয়ে দ্রুত বই পৌঁছাতে চায়। আর সেই সুযোগে কিছু মুদ্রণকারী নিম্নমানের কাগজে বই ছাপে। কার্যাদেশ পেতে দেরি হওয়ায় এ বছরও একই আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক ড. রিয়াদ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কার্যাদেশ দিতে কিছুটা দেরি হলেও আমরা নির্ধারিত সময়েই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিতে পারব। আমরা এ বছর মানের ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেব না। প্রত্যেক প্রেসে সিসিটিভি বসানো হয়েছে, যা এনসিটিবি থেকে সার্বক্ষণিক মনিটর করা হবে। এ ছাড়া ইন্সপেকশন এজেন্ট আছে। এনসিটিবির নিজস্ব তদারকি টিম আছে। এ বছর কাগজের স্পেসিফিকেশনেও বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। আমরা সবচেয়ে ভালো মানের বই শিক্ষার্থীদের দিতে চাই। এ জন্য যা যা করার, তা আমরা করব।’

এনসিটিবি সূত্র জানায়, আগামী শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিকে প্রায় ৯ কোটি ও মাধ্যমিকে প্রায় ২১ কোটি বই ছাপানো হবে। এ জন্য প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। এর মধ্যে মাধ্যমিকের বই ছাপতে প্রায় এক হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা ও প্রাথমিকের জন্য প্রায় ৪২৩ কোটি টাকা খরচ ধরা হয়েছে। ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে ৪০ কোটি বই ছাপা হলেও, ২০২৬ শিক্ষাবর্ষে ১০ কোটি বই কমেছে। এ বছর দশম শ্রেণির জন্য পাঁচ কোটি এবং অতিরিক্ত বিষয়ের জন্য আরো পাঁচ কোটি বই কম ছাপা হচ্ছে।

২০২৬ শিক্ষাবর্ষের বই কবে নাগাদ মাঠ পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে, সে ব্যাপারে আগেই একটি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে এনসিটিবি। আগামী ২৫ অক্টোবরের মধ্যে প্রাথমিকের সব বই ছেপে মাঠপর্যায়ে ৫৮৫টি স্থানে (পয়েন্ট) পৌঁছে দেওয়া হবে। মাধ্যমিকের সব বই দেওয়া হবে মধ্য নভেম্বরের মধ্যে।

প্রেস মালিকরা বলছেন, এ বছর আগেভাগে যখন দরপত্র শুরু হয়, তখন এনসিটিবি একটি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু তারা সে অনুযায়ী কার্যাদেশ দিতে পারেনি। ফলে কোনোভাবেই এই সময়ে বই সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। আর সব বইয়ের কার্যাদেশ একসঙ্গে দেওয়া শুরু হলে একটি জটের সৃষ্টি হবে। কারণ প্রতিটি কার্যাদেশেই ৭০ দিন সময় দেওয়া থাকবে। কিন্তু মুদ্রণকারীদের তো একসঙ্গে একটি বা দুটি শ্রেণির বইয়ের বেশি কাজ করা সম্ভব হবে না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বইয়ের কাজ শেষ হতে দেরি হবে। আর এ মাসের মধ্যে বেশির ভাগ শ্রেণির বইয়ের কার্যাদেশ পাওয়া না গেলে ডিসেম্বরের মধ্যেও শতভাগ বইয়ের কাজ শেষ করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।

বাংলাদেশ মুদ্রণশিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি বলব, এ ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অবহেলা রয়েছে। এ বছর কার্যাদেশ দেওয়ার যে গতি, তাতে স্বাভাবিকভাবেই ক্রাইসিস তৈরি হবে। যেসব প্রেস মালিক নিম্নমানের বই ছাপান, তাদের জন্য সুযোগ তৈরি হচ্ছে। কারণ শেষ সময়ে মান দেখার সময় থাকে না, এনসিটিবি শুধু বই চায়। আমি বুঝি না, সংসদে আইন দ্বারা পাস করা এনসিটিবি একটি অটোনোমাস বডি। তাদের কেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতি এত নির্ভরশীল থাকতে হয়?’