
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে রাজধানীতে সংঘটিত সব গণহত্যার মিশন বাস্তবায়ন করেন তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত রাজধানী ঢাকায় নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে এই পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন বেপরোয়া। তার উপস্থিতিতেই পুলিশ ১৯ জুলাই রামপুরায় আন্দোলনকারী নাদিম ও বৃদ্ধ মায়া ইসলামকে গুলি করে হত্যা করে। এদিন আহত হয় ৬ বছরের শিশু বাসিত খান মুসা ও আমির হোসেন নামের এক যুবক।
এছাড়াও এদিন আরও অন্তত ২৩ জনকে গুলি করে হত্যা এবং বহু মানুষকে আহত করে পুলিশ। রামপুরায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার অভিযোগপত্রে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে।
রোববার মামলার আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) আমলে নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এ মামলায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ ৪ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। তারা সবাই পলাতক। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ এই মামলা আমলে নিয়ে পরোয়ানা জারি করেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
এ মামলায় আসামি পাঁচজন। তাদের মধ্যে ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ চারজন পলাতক। তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। হাবিবুর ছাড়া ডিএমপির খিলগাঁও অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মো. রাশেদুল ইসলাম, রামপুরা থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মশিউর রহমান এবং রামপুরা থানার সাবেক উপপরিদর্শক (এসআই) তারিকুল ইসলাম ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এ মামলায় একজন আসামি গ্রেফতার আছেন। তিনি হলেন রামপুরা পুলিশ ফাঁড়ির সাবেক সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) চঞ্চল চন্দ্র সরকার। তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ মামলার পরবর্তী শুনানি ১৭ আগস্ট।
মামলায় তিনটি অভিযোগ আনা হয়েছে-গণ-অভ্যুত্থানের সময় ১৯ জুলাই রাজধানীর রামপুরায় কার্নিশে ঝুলে থাকা যুবক আমির হোসেনকে গুলি, বাসিত খান মুসার (৬) মাথা ভেদ করে গুলি চলে যায়। এতে তার দাদি মায়া ইসলাম মারা যান। একই দিন রামপুরায় মো. নাদিম নামের আরও এক ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়।
প্রসিকিউটর বিএম সুলতান মাহমুদ যুগান্তরকে বলেন, রাজধানীর রামপুরা এলাকায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ বৃহস্পতিবার দাখিল করে প্রসিকিউশন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ অভিযোগ দাখিল করা হয়। এতে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ পাঁচজনকে আসামি করা হয়েছে। এ মামলার পরবর্তী শুনানি ১৭ আগস্ট নির্ধারণ করা হয়েছে।
মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, ১৯ জুলাই রামপুরা থানার পাশে নিজ বাসায় নিচতলায় শিশু মো. বাসিত খান মুসা (৬) এবং তার দাদি মায়া ইসলাম (৬০) দাঁড়িয়ে ছিলেন। বেলা সাড়ে ৩টার দিকে পুলিশের (আসামিদের) ছোড়া ১টি গুলি শিশু মুসার মাথা ভেদ করে দাদির পেটে লাগে।
এতে দুজনই গুরুতর আহত হন। পরদিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান মায়া ইসলাম। অভিযোগপত্রে বলা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে সংকল্পবদ্ধ হন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান। তিনি আইন ও সংবিধান লঙ্ঘন করে জনগণের প্রতি তার দায়িত্ব ও কর্তব্য ভুলে আন্দোলন দমনে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালান। তিনি আন্দোলন দমেন ৫ আগস্ট ঢাকার বিভিন্ন প্রবেশমুখ এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসংলগ্ন চানখাঁরপুল এলাকায় প্রাণঘাতী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করে পুলিশ মোতায়েন করেন। যেন আন্দোলনকারীরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হয়ে শাহবাগের দিকে অগ্রসর হতে না পারেন। সেজন্য ৫ আগস্ট ভোর থেকে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের নির্দেশে ওই এলাকায় গুলি চালিয়ে নৃশংসভাবে ৬ জনকে হত্যা করে পুলিশ।
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, হাবিবুর রহমান গুলি করার নির্দেশ সংবলিত অডিও ক্লিপস উদ্ধার করেছে তদন্ত সংস্থা। হাবিবুর রহমান যে নির্দেশ দেয়েছেন, এ বিষয়ে ওয়্যারলেস অপারেটর কনস্টেবল শফিক মোহাম্মদ ডিএমপি কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টারে ১৮ জুলাই রাত ৯টা ৫ মিনিটে একটি জিডি করেন। তদন্তকালে পলাতক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের সরাসরি তত্ত্বাবধান, অধীনস্থদের নির্দেশ প্রদানে সহযোগিতা, নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার অপরাধ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
অভিযোগে বলা হয়, ১৯ জুলাই শুক্রবার বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অন্যতম রক্তাক্ত দিনে পরিণত হয়। পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমানের নির্দেশনা অনুযায়ী খিলগাঁও জোনের এডিসি রাশেদুল ইসলাম, রামপুরা থানার ওসি মশিউর রহমান, এসআই তারিকুল ইসলাম ভুইয়া, এএসআই চঞ্চল চন্দ্র সরকার, বিজিবি ও অন্য পুলিশ সদস্যদের তাদের নির্ধারিত ডিউটি থেকে প্রত্যাহার করা হয়। হাবিবুর রহমান তাদের সঙ্গে নিয়ে দুপুর ২টা থেকে আড়াইটার দিকে বনশ্রী এলাকায় অবস্থিত রামপুরা থানার কাছে বনশ্রী জামে মসজিদের সামনে গলির মুখে যান। জুমার নামাজ শেষে ছাত্র-জনতা আন্দোলন করছিল। এ সময় পুলিশ চাইনিজ রাইফেল, শটগান, পিস্তল দিয়ে নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ছোড়ে। এতে নাদিম (৩৮) শহীদ হন। অভিযোগপত্রে বলা হয়, একই দিন বেলা ৩টার দিকে আমির হোসেন (১৮) কর্মস্থল অফতাবনগর থেকে বাসায় ফিরছিলেন। পথে রামপুরা থানার পাশে পুলিশের এলাপাতাড়ি গুলিবর্ষণ দেখে একটি নির্মাণাধীন ভবনে আশ্রয় নেন। পুলিশ ধাওয়া করলে একটি নির্মাণাধীন ভবনের তিন তলার ছাদের পাইপ ধরে ঝুলে থেকে নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করেন আমির। তখন খিলগাঁও জোনের এডিসি রাশেদুল ইসলাম, রামপুরা থানার ওসি মশিউর রহমান, এএসআই চঞ্চল চন্দ্র সরকার ও এসআই তারিকুল ইসলাম ভুঁইয়া সেখানে যান। আমিরকে নিচে লাফ দিতে বলেন। আমির লাফ না দিলে তাকে পিস্তল দিয়ে পরপর ৬টি গুলি করেন তারা। এতে আমির হোসেন গুরুতর আহত হন।
অভিযোগে বলা হয়, হাবিবুর রহমানের উপস্থিতিতে রামপুরা থানা পুলিশ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর কোনো কারণ ছাড়াই সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। পিস্তল, চায়না রাইফেল ও শটগান দিয়ে ১ হাজার ৭০২ রাউন্ড গুলি ছোড়ে পুলিশ। রামপুরা, বনশ্রী এলাকায় ওইদিন হাবিবের উপস্থিতিতে আরও ২৩ জনকে হত্যা এবং বহু মানুষকে আহত করে।