Image description
ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন আয়োজনের সব প্রস্তুতি চলছে, আশা করি নভেম্বরের শেষে তফসিল ঘোষণা করতে পারবো : সিইসি স্বৈরাচার বিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের ও জোটের শরিকদের নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নির্বাচনে যাওয়ার প্রস্তুতি আমাদের আছে : ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের তারিখ নিয়ে আমাদের আপত্তি নেই, তবে আমাদের দাবি সকল দলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করে, জুলাই সনদের ভিত্তিতে নির্বাচন হতে হবে : আখতার হোসেন গণতন্ত্র মঞ্চের ব্যানারে আমরা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি : জোনায়েদ সাকি

জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী রোজার আগে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হবে প্রধান উপদেষ্টার এমন ঘোষণার পর থেকে সর্বত্রই চলছে ভোটের প্রস্তুতি। সরকার, নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল সবাই এখন আগামী নির্বাচনকে ঘিরে ব্যস্ত সময় পার করছেন। গত ৫ আগস্ট ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবসে’ জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রোজার আগে ফেব্রুয়ারিতে সংসদ নির্বাচন হবে এমন ঘোষণা দেন। এরপর ওই দিন রাতেই ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের জন্য সব প্রস্তুতি শেষ করতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) চিঠি দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। এ চিঠির মাধ্যমে নির্বাচন আয়োজনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ইসিকে জানানোর আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়েছে।

সরকারের চিঠি পাওয়ার পর ইসিও আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজন সার্বিক প্রস্তুতি শুরু করেছে। ভোটার তালিকা, সংসদীয় আসনের সীমানা পুনঃর্নিধারণ, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, নির্বাচনী সামগ্রী কেনাকাটার মতো বড় কাজগুলো আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে ইসি শেষ করবে। এসব কাজের মধ্যে গতকাল খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের খসড়া ইতিমধ্যে প্রকাশ করা হয়েছে। গতকাল (১০ আগস্ট) পর্যন্ত দাবি আপত্তি নেওয়ার সময় ছিল। এখন শুনানি করে সীমানা নির্ধারণ চূড়ান্ত করা হবে। প্রয়োজনীয় কেনাকাটাও চলছে, এটি সেপ্টেম্বরের মধ্যে শেষ হবে। নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। নির্বাচনী সামগ্রী কেনা কাটার কাজও চলছে। এ ছাড়া অনেকগুলো ইতিমধ্যে অনেক দূর এগিয়েছে।

নির্বাচন আয়োজনে যে খরচ, তা সরকার বরাদ্দ দিয়ে দিয়েছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে চলতি অর্থবছরের বাজেটে নির্বাচন কমিশনের জন্য ২ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা গত অর্থবছরের চেয়ে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা বেশি। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটের দলিল থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে। এদিকে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, নির্বাচনের জন্য যত টাকা লাগবে, তা দেওয়া হবে। এ নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।

সব মিলিয়ে আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন আয়োজনের জন্য ইসি তাদের প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করে নিয়েছে। নির্বাচনের প্রস্তুতি বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক বড় কাজগুলোর মধ্যে ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ শেষ পর্যায়ে, সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণের খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে, নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের কাজ চলছে, কেনাকাটাও চলছে। আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে বড় প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো শেষ হয়ে যাবে। এরপরই নভেম্বরের শেষে তফসিল ঘোষণা করতে পারবেন বলে তিনি আশা করেন। সিইসি বলেন, নির্বাচন কমিশন একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়, ভোটারদের ব্যাপক অংশগ্রহণ চায়। নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষের আস্থা সৃষ্টি করা, ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করা, এআইয়ের অপব্যবহার রোধ করা এসব চ্যালেঞ্জ থাকলেও ইসি আশা করছে, আগামী নির্বাচন আয়নার মতো স্বচ্ছ হবে। নির্বাচন কমিশনের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হতে পারে ৫, ৮ কিংবা ১২ ফেব্রুয়ারি। এই তিনটি তারিখকে চূড়ান্ত করে ভোটের জন্য প্রস্তুতি শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই তারিখগুলোর যেকোনো একটিকে বেছে নেওয়ার বিষয়ে কমিশন সভায় আলোচনা করা হবে।

অন্যদিকে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মপরিকল্পনা বিষয়ে বৈঠক করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, নির্বাচনের আগে পুলিশ সুপার (এসপি) ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) যথাযথভাবে পদায়ন করা হবে। পুলিশসহ প্রশাসনের সর্বস্তরে বদলি, পদোন্নতিসহ সব ধরনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলে ওএসডি হওয়া ৭৮ পুলিশ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। আগামী নির্বাচনে ৮ লাখ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দায়িত্ব পালন করবে এবং তাদের সবাইকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে বলেও জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

সরকারের পক্ষ থেকে ভোটের সার্বিক প্রস্তুতি যেমন চলছে তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও নির্বাচনকে ঘিরে ব্যাপক তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোও যে যার কৌশলে ভোটের মাঠে নেমে পড়েছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় গণ-সংযোগ শুরু করে দিয়েছেন। বিশেষ করে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর সম্ভাব্য প্রার্থীদের অনেকে গত শুক্রবার ও শনিবার নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় জনসংযোগ করেছেন। এনসিপি, এবি পার্টি, গণ অধিকার পরিষদসহ অন্যান্য দলগুলোতে চলছে ভোটের প্রস্তুতি।
নেত্রকোণা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ডা. আনোয়ারুল হক নেত্রকোনা-২ (সদর-বারহাট্টা) আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী। তিনি পেশায় একজন খ্যাতিমান চিকিৎসক। ঢাকা ও ময়মনসিংহে তার চেম্বার। তবে এখন নির্বাচনী জনসংযোগের জন্য প্রতি শুক্র-শনিবারই এলাকায় ছুটে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মহোদয় ইতোমধ্যে সবাইকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে নির্দেশনা দিয়েছেন। আমার তার নির্দেশনা অনুযায়ী এলাকায় সংগঠন গোছাচ্ছি। বিভিন্ন উপজেলায় সম্মেলন সম্পন্ন করছি। সব মিলিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতিও চলছে। আমরা আশা করি এবার জনগণ তাদের পছন্দের মার্কা ধানের শীষে ভোট নিয়ে তারেক রহমানকে দেশ পরিচালনার সুযোগ দেবে।
এরই মধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান স্বৈরাচার বিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দল ও জোট নেতাদের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। গত ৯ আগস্ট রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সমমনা দল ও জোটের শরিকদের সঙ্গে পৃথক বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি এ আহ্বান জানান। এদিন গণতন্ত্র মঞ্চ, গণফোরাম, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (পার্থ), গণঅধিকার পরিষদ, আমজনতা দল, এনডিএম, জন অধিকার পিপলস পার্টি, ন্যাপ ভাসানী ও গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যের নেতাদের সঙ্গেও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বৈঠক করেছেন।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনের প্রস্তÍুতি আরও অনেক আগে থেকেই শুরু করেছে। এ দলটি গত জুন মাসেই ৩০০ আসনে তাদের প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এসব প্রার্থী কেন্দ্র থেকে তাদের নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় প্রতি শুক্রবার-শনিবার ছুটে যাচ্ছেন এবং সভা-সমাবেশ করছেন। এসব সভা-সমাবেশে তারা দাড়িপাল্লা মার্কায় ভোটও চাচ্ছেন। এর মধ্যে ঢাকা মহানগর উত্তরের প্রচার-মিডিয়া সেক্রেটারি আতাউর রহমান সরকার সম্প্রতি তার নির্বাচনী এলাকা কসবা-আখাউড়ায় জন সংযোগ করেন। সেখানে তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণ পরিবর্তন চাচ্ছে। তারা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও মাদকের সাথে সম্পৃক্ত নেতৃত্বকে প্রত্যাখ্যান করে সৎ-যোগ্য, আল্লাহ ভীরু নেতৃত্বকে সংসদে পাঠাতে প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, জাতীয় নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে হলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। নির্বাচনে যাওয়ার প্রস্তুতি আমাদের আছে। তবে সব দলের জন্য সমান সুযোগ অর্থাৎ লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরীর ব্যাপারে সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ এখনো দেখা যাচ্ছে না। আমরা চাই একটি অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হোক, আর সে নির্বাচনে জনগণ অবশ্যই তাদের পছন্দ মত সৎ যোগ্য প্রার্থীকে বেছে নেবে এটা আমরা মনে করি।

এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের তারিখ নিয়ে আমাদের কোন আপত্তি নেই। তবে আমাদের দাবি সকল দলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করে, জুলাই সনদের ভিত্তিতে নির্বাচন হতে হবে।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী ও গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম প্রধান জোনায়েদ সাকি বলেন, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচনের ঘোষণা আসায় জনমনে যেমন স্বস্তি এসেছে, তেমনি গণতন্ত্রে উত্তরণের পথও সুগম হয়েছে। ইতোমধ্যে সারাদেশে জনগণের মধ্যে নির্বাচনী আমেজ শুরু হয়ে গেছে। দলগুলোও যে যার মতো করে প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমরা গণতন্ত্র মঞ্চের ব্যানারে নির্বাচনের পুরো প্রস্তুতি নিচ্ছি। ইতোমধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আমাদের সাথে বৈঠক করেছেন। তিনিও সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন।