
জমি অতিমূল্যায়ন করে ঋণ জালিয়াতির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলায় কারাগারে রয়েছেন জনতা ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এ শিক্ষকই কেবল নন, বর্তমানে কারান্তরীণ আছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ছয় অধ্যাপক। ডিভিশন সুবিধায় এসব বন্দি বর্তমানে ঢাকা ও রংপুর কারাগারে অবস্থান করছেন। সময় কাটছে বই পড়ে আর গল্প করে। তাদের কারো বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতি কিংবা অনিয়মের অভিযোগ, আবার কারো বিরুদ্ধে রয়েছে জঙ্গিবাদের সংশ্লিষ্টতা। কারা সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
কারা অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, দেশের কারাগারগুলোয় বর্তমানে বন্দি রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় অধ্যাপক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল বারকাত ছাড়াও রয়েছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও ডিন শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম, যিনি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান। কারাগারে রয়েছেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আবদুস সাত্তার, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামিন মাহফুজ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদালয়ের (বেরোবি) সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলাম। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার গ্রেফতার হয়ে কারান্তরীণ আছেন বেরোবির সাবেক উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ। শিক্ষক হিসেবে তারা প্রত্যেকেই পাচ্ছেন ডিভিশন সুবিধা। তবে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনায় নিয়ে তাদের কে কোথায় বন্দি রয়েছেন তা স্পষ্ট করতে চায়নি কারা অধিদপ্তর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পান ২০০৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। দ্বিতীয় মেয়াদে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন। এক সময় ভালো ব্যাংকের কাতারে থাকা জনতা ব্যাংক বারকাতের অধীনে আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর গত ২৫ ফেব্রুয়ারি জনতা ব্যাংকে ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে অ্যাননটেক্সের ২৯৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করা হয়। সে মামলায় গ্রেফতার হয়েই বর্তমানে কারাগারে আছেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি আবুল বারকাত। এ মামলার আরেক আসামি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান অবশ্য পলাতক রয়েছেন।
দুদকের করা মামলায় কারাগারে রয়েছেন বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। ভুয়া বাড়িভাড়া চুক্তিনামা দেখিয়ে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে তিনি ১ কোটি ৯২ লাখ টাকা ঘুস গ্রহণ করেন বলে অভিযোগ। এছাড়া ভুয়া বিক্রি চুক্তি দেখিয়ে পণ্য রফতানি না করে প্রতারণা ও জালিয়াতির আশ্রয় নেয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় গত বছরের ১০ আগস্ট রাতে বিএসইসি চেয়ারম্যানের পদ ছাড়েন শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। পরে তাকে গত ৪ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডি থেকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিনের দায়িত্ব পালন করা অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতকে জুলাই আন্দোলনের কয়েকটি মামলায়ও আসামি করা হয়েছে।
কারাগার সূত্রে জানা যায়, কারাগারে যাওয়ার পর থেকেই অধ্যাপক আবুল বারকাত খুব বেশি নিজের কক্ষ থেকে বের হন না। অধিকাংশ সময় বই পড়ে এবং গল্প করে কাটান। একইভাবে সময় কাটাচ্ছেন অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। অন্য বন্দিদের সঙ্গে তিনিও তেমন কথাবার্তা বলেন না, থাকেন নিজের মতো করেই। বই পড়েন, মাঝে মাঝে পরিচিতদের সঙ্গে গল্প করেন। তবে অপরিচিতদের সঙ্গে তিনি একদমই মেশেন না।
এদিকে সবশেষ গত বৃহস্পতিবার মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহকে। উন্নয়নকাজের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে গত ১৮ জুন সাবেক দুই উপাচার্য কলিমউল্লাহ এবং একেএম নূর-উন-নবীসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বেরোবির উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি ডিভিশন সুবিধা নিয়ে কারাগারে রয়েছেন। সময় কাটাচ্ছেন বই পড়েই।
এর আগে গত ১৮ নভেম্বর বেরোবির সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলামকে গ্রেফতার করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত আবু সাঈদ হত্যা মামলার আসামি তিনি। ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে পুলিশকে গুলি করতে নির্দেশ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
অবৈধভাবে নিয়োগ এবং সরকারি ৬১ লাখ ৩১ হাজার ৭৩২ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০২৩ সালের ২১ আগস্ট যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আবদুস সাত্তারের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। ওই মামলায় গত ১৬ জুন তাকে গ্রেফতার করা হয়। বর্তমানে তিনি যশোর কারাগারে রয়েছেন। এর বাইরে পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তানের (টিটিপি) সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছেন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শামিন মাহফুজ।
কারা সূত্রে জানা যায়, অধ্যাপক শামিন মাহফুজ ঢাকার কারাগারে রয়েছেন। বই পড়ার পাশাপাশি তিনি নিয়মিত নামাজ আদায় করছেন। তিনি অবশ্য অন্য বন্দিদের সঙ্গে কম-বেশি গল্প করেন। ঢাকার বাইরে যশোর কারাগারে রয়েছেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আবদুস সাত্তার। তারও সময় কাটছে বই পড়ে আর গল্প করে।
জানতে চাইলে কারা অধিদপ্তরের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ শাখার সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) জান্নাতুল ফেরদৌস বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দুর্নীতি, অনিয়মসহ নানা মামলায় গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে দেশের কারাগারগুলোয় মোট ছয়জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছেন অধ্যাপক আবুল বারকাত, শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম, শরিফুল ইসলাম, আবদুস সাত্তার, শামিন মাহফুজ ও নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ।’ বন্দিদের সুরক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এ প্রসঙ্গে আর কোনো মন্তব্য করতে চাননি কারা কর্মকর্তা জান্নাতুল ফেরদৌস।