Image description

আসছে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচন শতভাগ সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, সহিংসতা ও পেশিশক্তিমুক্ত রাখতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীতে নতুন করে প্রায় ২০ হাজার জনবল নিয়োগ দেবে সরকার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি, প্রায় ১১ হাজার জনই নিয়োগ দেওয়া হবে বাংলাদেশ পুলিশে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশে (বিজিবি) নিয়োগ দেওয়া হবে পাঁচ হাজার ৫১৩ জন।

এ ছাড়া আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীতে দুই হাজার ১৪৫ জন এবং কোস্ট গার্ডে ৬৩৪ জন নিয়োগ দেওয়া হবে। এসব বাহিনীতে দ্রুত নিয়োগ দিয়ে নির্বাচনী দায়িত্বভিত্তিক প্রশিক্ষণ আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্দেশ দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি ও সংস্কার সংক্রান্ত এক সভায় এই নির্দেশনা দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেই নির্দেশনা বাস্তবায়নে শিগগিরই সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারি করবে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।

উল্লিখিত বিষয়ের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পুলিশ ও এনটিএমসি) আতাউর রহমান খান। তিনি বৃহস্পতিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর তা অর্থ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। তাদের সম্মতি পেলেই আমরা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারির সিদ্ধান্ত দেব। এরপর নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারি করবে।

নতুন লোকবল নিয়োগের কারণ কেউই স্পষ্ট করে বলছেন না। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা জানান, গত ১৬ বছরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীতে হাজার হাজার নিয়োগ হয়েছে। এর বেশির ভাগই গোপালগঞ্জের এবং আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে পুলিশে বেছে বেছে আওয়ামী লীগ মতাদর্শের লোকবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর তাঁদের কিছু সদস্য আত্মগোপনে গেলেও বড় একটি অংশ পুলিশে ঘাপটি মেরে আছে।

তারা সরকারকে নানাভাবে বিব্রত করার অপচেষ্টা করছে বলে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। তাই আগামী নির্বাচনে বিদ্যমান আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পাশাপাশি নতুন নিয়োগ হওয়া সদস্যরাও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবেন। তাঁরাই মূলত নির্বাচনে বর্তমান সরকারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সফল করতে মরিয়া থাকবেন। সেভাবেই তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। যেকোনো ধরনের পেশিশক্তি ও সহিংসতা কঠোর হস্তে দমন করবেন তাঁরা।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে তাঁর বাসভবন যমুনায় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি ও সংস্কার নিয়ে বৈঠক করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বৈঠকে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশনা দেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের জন্য বাংলাদেশ পুলিশে ১১ হাজার কনস্টেবল, বিজিবিতে পাঁচ হাজার ৫১৩ জন, আনসারে দুই হাজার ১৪৫ জন এবং কোস্ট গার্ডে ৬৩৪ জন নতুন সদস্য নিয়োগ দিতে হবে। দ্রুত নিয়োগ দিয়ে তাঁদের নির্বাচনী দায়িত্বভিত্তিক প্রশিক্ষণের প্রক্রিয়া শুরু আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। এ সময় বৈঠকে আরো সিদ্ধান্ত হয় যে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীগুলোকে আরো কঠোর হতে হবে। নির্বাচনে আট লাখ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন এবং তাঁদের সবাইকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এর মধ্যে পুলিশ থাকবে এক লাখ ৪১ হাজার, অঙ্গীভূত ও সাধারণ আনসার অস্ত্রসহ থাকবে ৪৭ হাজার, অস্ত্র ও লাঠিসহ আনসার থাকবে ৪৭ হাজার, লাঠিসহ আনসার চার লাখ ৭০ হাজার, লাঠিসহ গ্রাম পুলিশ, দফাদার ও মহল্লাদার ৯৪ হাজার। এ ছাড়া নির্বাচনের সময় ভোটকেন্দ্রে ১৮ থেকে ৩৩ বছর বয়সী ভোটারদের জন্য আলাদা বুথ রাখা যায় কি না, সে ব্যাপারেও আলোচনা করা হয় বৈঠকে। নির্বাচনে দায়িত্বরতদের দ্বারা কোনো নির্বাচনী অনিয়ম ও অপরাধ সংঘটিত হলে তাৎক্ষণিক বিচার নিশ্চিত করা হবে এবং দোষী সাব্যস্ত হলে ডোসিয়ারে সংরক্ষণ করা হবে। এ ছাড়া আরপিও অনুযায়ী যেসব ব্যক্তি ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত থাকার যোগ্য তাঁদের একটি তালিকা ভোটকেন্দ্রের প্রকাশ্য স্থানে সবার অবগতির জন্য টানিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কোনো অবস্থায় কোনো অবাঞ্ছিত ব্যক্তিকে ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেওয়ার নির্দেশনা জারি করতে হবে।

সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে পুলিশে কনস্টেবল থেকে আইজিপি পর্যন্ত দুই লাখ ১৩ হাজার সদস্য রয়েছেন। বাংলাদেশের জনসংখ্যার বিপরীতে পুলিশ সদস্যের অনুপাত ৮০০ জনের জন্য একজন পুলিশ। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর পুলিশ দৃশ্যত সম্পূর্ণ নেতৃত্বহীন হয়ে পড়েছিল। শীর্ষ পর্যায়ের অভিযুক্তরা গা ঢাকা দিলে অধস্তন কর্মকর্তা ও সদস্যরা দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন। ভয়, আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতায় উদ্বিগ্ন ছিলেন পুলিশ সদস্যরা। ঢাকাসহ দেশের চার শতাধিক থানা ও পুলিশ স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের পর ৬ আগস্ট থেকে পুলিশের নন-ক্যাডারভুক্ত সদস্যরা কাজে যোগদান থেকে বিরত থেকেছেন। পুলিশের অধস্তন কর্মচারী সংগঠন পুলিশ অ্যাসোসিয়েশন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের গুলি করে হত্যা করার জন্য ক্ষমা চেয়ে বিবৃতি দিয়েছে। এর আগে নবনিযুক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শকও আন্দোলন-বিক্ষোভ ঘিরে পুলিশের ভূমিকার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তার পরও বাহিনীগুলোর মধ্যে কাঙ্ক্ষিত গতি ফেরেনি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এ অবস্থায় তাঁদের দিয়ে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব কি না, তা সরকারের নীতিনির্ধারকদের ভাবিয়ে তুলেছে। এসব বিষয় বিবেচনা করেই মূলত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীতে নতুন সদস্য নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।